ইলিশ উৎপাদন বাড়লেও বছরের অধিকাংশ সময় পরিবার-পরিজন ছেড়ে সাগরে থাকতে হয় জেলেদের। তবু ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অর্থ সংকটে থাকায় ভালো পোশাক পরতে পারেন না। এমনকি সরকারি সহায়তা তেমন পান না। এ কারণে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকলে ধারদেনা অথবা দিনমজুরি তাদের আয়ের একমাত্র ভরসা। এসব সমস্যার মাঝেও জাল ভরে ইলিশ উঠলে সবকিছু ভুলে যান। জেলেদের দাবি, রেশনিং পদ্ধতিতে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য সহায়তা দেওয়ার। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে সোমবার দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে সাগর ও নদীতে জাল ফেলছেন জেলেরা। এই লক্ষ্যে সকাল থেকেই বরিশাল নগরীর ইলিশ মোকাম হিসেবে পরিচিত পোর্টরোড খাল থেকে ফিশিং বোট নিয়ে সাগরে রওনা হয়েছেন। ইলিশ শিকারের জন্য ২৩-২৫ জন একটি ফিশিং বোট থেকে ৫০০ ফুট লম্বা জাল ফেলবেন। জেলেরা আশা করছেন, মা ইলিশ ডিম ছেড়ে এখন সাগরমুখী। বাইরের দেশের জেলেরা ইলিশ শিকার না করলে বড় ইলিশ উঠবে জালে। ফিশিং বোট তমা-৫-এর জেলে মো. রাসেলসহ একাধিক জেলে জানান, বছরের অধিকাংশ সময় সাগরে ইলিশ শিকারে সময় কাটে। নিষেধাজ্ঞাকালীন তারা পোর্ট রোডে এসে জাল ও ট্রলারে সমস্যা থাকলে ঠিক করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটান। এই সময়টা বাড়িতে না থাকায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন সরকার থেকে যে ২০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়, তা তাদের পরিবার পায় না। এবছরও ব্যত্যয় হয়নি। তাদের ফিশিং বোটের ২৩ জেলের একজনের পরিবারও সহায়তার চাল পাননি। তাদের দাবি, জেলেদের অনুপস্থিতিতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তা ভাগ করে নেন। তবে বাড়িতে থাকলে ওসব জনপ্রতিনিধিকে ম্যানেজ করে চাল নিতে পারেন। যাদের জেলে তালিকায় চাল দেওয়া হচ্ছে তাদের অধিকাংশ জেলে নন। তাদের মধ্যে রয়েছেন পোশাককর্মী, ছোটখাটো ব্যবসায়ী ও কৃষিশ্রমিক। এ ছাড়া অধিকাংশ জেলের তালিকায় নাম নেই। তাদের কার্ডও দেওয়া হয় না। এ জন্য জরিপ চালিয়ে তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে খাদ্য সহায়তা দেওয়ার দাবি জানান। একই সঙ্গে সারা বছর রেশনিং পদ্ধতিতে সব ধরনের খাদ্যদ্রব্য দিতে সরকারের কাছে অনুরোধ জানান। জেলেরা বলছেন, বছরের ৭-৮ মাস কাটে ফিশিং বোটে। তেমন আয় না থাকায় ভালো পোশাক পরতে পারি না। ভালো পোশাক কিনবো না পরিবার-পরিজনের মুখে খাবার দেবো। এই কাজে যে পরিশ্রম সে অনুযায়ী টাকা নেই। যে সময় বাড়িতে থাকা পড়ে ওই সময় সংসার চালাতে হয় সুদে টাকা এনে। আবার আয় করে পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া দিনমজুর ও ধানকাটাসহ যে কাজ পাই তা করতে হয়। না হলে সংসার চলে না। বরিশাল নগরীর পোর্টরোড খাল থেকে ফিশিং বোট নিয়ে সাগরে রওনা হয়েছেন জেলেরা জেলেরা অভিযোগ করেন, নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন ভারত, বার্মা ও থাইল্যান্ডের জেলেরা বাংলাদেশের মধ্যে ঢুকে ইলিশ শিকার করে। প্রতিবছর মা ইলিশের নিষেধাজ্ঞা চলাকালীন আমরা সাগর ছেড়ে চলে আসি। ওসব দেশের জেলেরা ইলিশ শিকার করে চলে যায়। এ কারণে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের পর সাগরে জাল ফেললেও ইলিশের সংখ্যা থাকে কম। আমরা জানি, মা ইলিশ ডিম ছেড়ে সাগরমুখী হয়। বাইরের দেশের জেলেরা ইলিশ শিকার না করলে আমাদের জালে বড় এবং বেশি ইলিশ উঠতো। সাত দিন ৫০০ ফুট জাল দুই বার করে ফেলে যে পরিমাণ ইলিশ পাওয়া যায় তা নিয়ে মোকামে চলে আসি। অনেক সময় ইলিশ বেশি না উঠলে মাসের অর্ধেক সময় সাগরে কাটাতে হয়। স্থানীয় জেলে বাদশা বলেন, দেশের জেলেরা আমাদের ক্ষতি করে। বড় বড় জাহাজ কেটে ফিশিং বোট বানিয়ে ইলিশ শিকারে নামে। আমাদের জালের ওপর দিয়ে বোট চালিয়ে যায়। এতে বড় ধরনের ক্ষতি হয়। তাদের বোটের নিচে আমাদের জাল আটকে যায়। এরপর জালসহ বোট চালিয়ে চট্টগ্রাম গিয়ে খুলে বিক্রি করে দেয়। বছরের পর বছর এই কাজ করছে তারা। অথচ ইচ্ছা করলে জালের বাইর দিয়ে বোট চালিয়ে যেতে পারে। জেলেরা জানান, সরকার থেকে বিভিন্ন সময় যে নির্দেশনা দেওয়া হয় তা পালন করেন। এতে ইলিশের উৎপাদন অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু সে অনুযায়ী আয় বাড়ে না। তারপরও বাপদাদার পথ ধরে ইলিশ শিকার করছেন। অন্য কাজ জানা নেই। মাছ শিকারে গিয়ে অনেক জেলে সাগরে ডুবে নিহত হন। এতে পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পান না। সরকারের কাছে নিহত জেলে পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানান তারা। তারা জানান, আগে আবহাওয়ার মধ্যেও জাল ফেলায় বোট ডুবে অনেকেই নিহত হয়েছেন। কিন্তু এখন আর কেউ আবহাওয়া খারাপ হলে সাগরে থাকেন না। সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদ স্থানে চলে যান। তারপরও মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনা ঘটে। জেলে নেতা খোরশেদ আলম বলেন, সরকার থেকে যে সহায়তা দেওয়া হয় তাতে আমাদের কিছুই হয় না। আমরা নিহত জেলেদের ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু ক্ষতিপূরণ পেতে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আবেদন করে না। আবেদন করার পর তদন্ত সাপেক্ষে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। তবে তা পেতে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। প্রমাণ করতে হয় মাছ শিকারে গিয়ে নিহত হয়েছে। বিষয়টি আরও সহজ করা দরকার। বছরের অধিকাংশ সময় সাগরে ইলিশ শিকারে সময় কাটে জেলেদের বরিশাল মৎস্য কর্মকর্তা (ইলিশ) বিমল চন্দ্র দাস বলেন, সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি সফলভাবে বাস্তবায়ন হওয়ায় মৌসুম ছাড়াও বাজারে ইলিশ মিলছে। এমনকি ইলিশের সাইজও বড়। এর সঙ্গে ইলিশের গড় উৎপাদনও প্রতি বছর বাড়ছে। ২০ হাজার মেট্রিক টন থেকে ৪০ হাজার মেট্রিক টনে দাঁড়িয়েছে ইলিশের উৎপাদন। গত বছর ইলিশের উৎপাদন ছিল ৪০ হাজার মেট্রিক। আশা করছি, এ বছর আরও বাড়বে। তিনি বলেন, এখন আমাদের জেলেরা অনেক সচেতন। প্রচরণার আগেই সাগর থেকে চলে আসে তারা। তবে যারা নিষেধাজ্ঞার মধ্যে জাল ফেলে তারা পেশাদার জেলে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করা হয়। বরিশাল জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শতভাগ সফল না হলেও ৯৯ ভাগ সফল। জেলেদের তালিকা ভুক্তির বিষয়ে তিনি বলেন, জেলেরা নিজ নিজ উপজেলায় তালিকাভুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। আর যেসব জেলে ইলিশ শিকারে গিয়ে নিহত হন তাদের জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা রয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে মাছ শিকারে নিহত হওয়ার বিষয়টি উঠে এলে ক্ষতিপূরণের আওতায় আসেন। নিহত জেলেদের পরিবার ক্ষতিপূরণ যাতে দ্রুত পান সে বিষয়টি দেখবো। বরিশাল মৎস্য অধিদফতর থেকে জানানো হয়, ২১ দিনের অভিযানে বিভাগের ছয় জেলায় ৮৮৫ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। ৭.৮৭ মেট্রিক টন ইলিশ, ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকার ৫৪.৭৭ লাখ মিটার নিষিদ্ধ কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়। ৭৩৬টি মামলা দায়ের, ৬২৬ জেলেকে কারাদন্ড ও ১৮ লাখ ১৩ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়।