জন্মলগ্ন থেকেই নানা সংকটের মোকাবেলা করতে হয় নদীরক্ষা কমিশনটিকে। নদী রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত বিদ্যমান দুটি মন্ত্রণালয়ের কোনোটিই দেশের নদী, খাল-বিল ও অজস্র উন্মুক্ত জলাশয়ের দেখভাল ও উন্নয়নের জন্য বিশেষায়িত নয়। এর মধ্যে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব প্রধানত সমুদ্র পরিবহন ও বন্দরের দেখভাল করা। অন্যদিকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ও দেশের বিপুলসংখ্যক নদী-খাল-বিল-হাওর ও অন্যান্য উন্মুক্ত জলাশয়ের দূষণ, অপদখল ও ক্রমান্বয়ে ভরাট হয়ে যাওয়া প্রতিরোধে সম্পূর্ণ অক্ষম। সাত বছর ধরে ক্রিয়াশীল নদী রক্ষা কমিশন এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি। এটিকে জনবল, অবকাঠামো ও আইনিভাবে শক্তিশালী করার প্রয়োজন রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিশনের কাছে কাক্সিক্ষত সেবা পেতে হলে এর শক্তি ও লোকবল বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
কমিশনের প্রতিবেদনেও নতুন মন্ত্রণালয় গঠনের পাশাপাশি সংস্থাটির নিজস্ব সক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, দেশের সব বিভাগ ও জেলায় কমিশনের কার্যালয় স্থাপন করাসহ এর অবকাঠামো, জনবল ও আইনি সক্ষমতা বাড়ানো হলে প্রস্তাবিত নদী ও জলাভূমিবিষয়ক মন্ত্রণালয় দেশের সব নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে এবং নাব্যতা পুনরুদ্ধারে ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারবে।
এছাড়া প্রস্তাবে আরো বলা হয়েছে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে সাংবিধানিক কমিশনে রূপান্তর করতে হবে। নদী ও জলাশয় অপদখল ও দূষণের জন্য দায়ী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পৃথক আদালত স্থাপন করতে হবে। দেশের আটটি বিভাগীয় সদরে এ আদালত স্থাপন করা যেতে পারে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের আওতাধীন নদী সমীক্ষা প্রকল্পের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে স্বল্প সময়ে দেশের বিপুলসংখ্যক নদীর ওপর সমীক্ষা চালিয়ে সংশ্লিষ্ট সব নদীর ক্ষেত্রে মৌজা পর্যায় পর্যন্ত তথ্যভা-ার গড়ে তোলা যায় ।
দেশের নদ-নদীগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করে মূলত নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়। ‘অতিরিক্ত কাজের বোঝায় আক্রান্ত’ মন্ত্রণালয় দুটির পক্ষে এ দায়িত্ব পালন করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছে নদী রক্ষা কমিশন। এ অবস্থায় দেশের নদ-নদীগুলোর যথাযথ দেখভালের জন্য কমিশন আলাদা একটি মন্ত্রণালয় গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
নদী রক্ষা কমিশন বলছে, দেশে এখনো ৭০০টি নদ-নদী রয়েছে। এগুলোর তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রণালয় দুটি আরো নানা ধরনের কার্যক্রমে জড়িত। এজন্য নদী সংরক্ষণের দায়দায়িত্বগুলোও অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। নদ-নদীগুলোর প্রয়োজনীয় যতœ ও পরিচর্যা হচ্ছে না। সমাধান মিলছে না এ-সংক্রান্ত নানামুখী সংকটেরও। কমিশন সম্প্রতি নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির একটি সুপারিশের আলোকে একটি প্রস্তাব তৈরি করেছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, দেশের নদীনালা ও খাল-বিলের জন্য পৃথক কোনো মন্ত্রণালয় নেই। পৃথক মন্ত্রণালয় হলে এসব নদ-নদীর সঠিকভাবে দেখভাল করা সম্ভব হবে।
প্রয়োজনীয় তদারকি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দেশের নদ-নদীগুলোর বর্তমান পরিস্থিতি বড় ধরনের উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ছোট-বড় নদীগুলোর পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে প্রায়ই আশঙ্কা প্রকাশ করে বক্তব্য দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের এ বক্তব্যের বাস্তব প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে অনেক।
ঢাকার হাজারীবাগ, তেজগাঁও ও ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরার নদী রক্ষা বাঁধ ঘিরে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের কারখানা। এসব শিল্প-কারখানার শিল্পবর্জ্য সরাসরি পড়ছে বুড়িগঙ্গা নদীতে। বুড়িগঙ্গা থেকে এ শিল্পবর্জ্য গিয়ে মিশছে তুরাগ, টঙ্গী খাল, বালু, শীতলক্ষ্যা ও ধলেশ্বরীতে। এর বাইরে রাজধানীর গৃহস্থালি বর্জ্যেরও গন্তব্য হচ্ছে বুড়িগঙ্গা। কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই এসব বর্জ্য এসে নদীটিতে মিশছে। সেখান থেকে তা আবার বিভিন্ন মাত্রায় ছড়াচ্ছে আশপাশের অন্যান্য নদীতে। একইভাবে দূষিত হচ্ছে বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রধান নদী কর্ণফুলীও। আর এ দূষণ বিভিন্ন মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন নদীতে। করতোয়া, তিস্তা, আত্রাই, পদ্মাসহ দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান ও অপ্রধান নদ-নদীগুলোর স্বাস্থ্যও খুব একটা ভালো নয়। নানা মাত্রার দূষণের হাত থেকে রেহাই পায়নি এসব নদীর কোনোটিই। দূষণ দখলে বিপর্যস্ত হয়ে হারিয়েও গেছে অনেক নদী।
এ বিষয়ে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সচিব মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, যে যার প্রয়োজনে নদী ব্যবহার করে চলেছে। নদীর স্বাস্থ্য বিবেচনায় না নিয়েই নদীকেন্দ্রিক বিভিন্ন অবকাঠামো তৈরি করা হচ্ছে। আবার নদ-নদী রক্ষায় যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়, সেসবের মধ্যেও সমন্বয় নেই। এজন্য দেশের নদ-নদী রক্ষা করতে পৃথক মন্ত্রণালয়ের বিকল্প নেই।
নদী ও জলাভূমি মন্ত্রণালয়ের আওতায় কোন কোন সংস্থা রাখা যেতে পারে, প্রস্তাবে এ-সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনাও দিয়েছে নদী রক্ষা কমিশন। এতে যেসব সংস্থাকে প্রস্তাবিত মন্ত্রণালয়ের আওতায় আনা যেতে পারে বলে মত দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন, বি আইডব্লিউটিসি, বি আইডব্লিউটিএ, জাতীয় ড্রেজিং কর্তৃপক্ষ, ফরিদপুরের নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, যৌথ নদী কমিশন, হাওর উন্নয়ন বোর্ড, উপকূল উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি।
কমিশনের এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, একক মন্ত্রণালয় গঠন করা হলে দেশের নদী ও জলাভূমিগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ ও সংশ্লিষ্ট উন্নয়নমূলক কার্যক্রমগুলো আরো গতিশীলভাবে পরিচালনা ও সমন্বয় করা যাবে। প্রস্তাবটির সঙ্গে একমত পোষণ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ও হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়কারী অধ্যাপক ড. মো. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, দেশের নদ-নদীর জন্য সেই অর্থে কোনো অভিভাবক নেই। একটি নদী যখন বিপদগ্রস্ত হয়, তখন কেউ দায়িত্ব নিতে চায় না। যে যেভাবে পারে নদী ব্যবহার করে। নদী রক্ষা কমিশন হওয়ার পর আমরা ভেবেছিলাম একটি অভিভাবক পাওয়া গিয়েছে, এবার দেশের নদ-নদীগুলোর একটি গতি হবে। তবে নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নদী রক্ষা কমিশন আমাদের সে আশা-আকাক্সক্ষা পূরণ করতে পারেনি।
তিনি বলেন, আমাদের নদীমাতৃক বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে নদীকে জীবিত রাখতে হবে। নদী মানে শুধু নিছক একটি নদী নয়। আমাদের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য, পরিবেশ, জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ সবকিছু নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পরিবেশগত, অর্থনৈতিকভাবে বেঁচে থাকতে নদী বাঁচানোর বিকল্প নেই। অথচ সেই নদীই সবচেয়ে অবহেলিত। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই দেশের নদ-নদীর জন্য একটি পৃথক মন্ত্রণালয়ের কথা বলে আসছি। এর আগে গত জুলাইয়ে হাইকোর্টের এক রায়ে সব জলাভূমির সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনার জন্য অনতিবিলম্বে পৃথক মন্ত্রণালয় তথা ‘জলাভূমি মন্ত্রণালয়’ সৃষ্টি করার কথা বলা হয়। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নে ইউনিক প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেডের সোনারগাঁ রিসোর্ট সিটি ও সোনারগাঁ ইকোনমিক জোনের মাটি ভরাট কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন নির্দেশনা দেয়া হয়।
রায়ে বলা হয়, যেহেতু বাংলাদেশ ‘রামশার কনভেনশন’ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদন করেছে, সেহেতু ওই অঙ্গীকার ও চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে দ্রুত নীতিমালা গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের আইনি দায়িত্ব ও কর্তব্য। এছাড়া রায়ে ‘জলাভূমি সুরক্ষা, উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন’ দ্রুত প্রণয়নের কথাও বলা হয়েছে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে জারীকৃত এক আইনের বলে পরের বছর থেকে কার্যক্রম শুরু করে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
গবেষকসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, দেশের নদ-নদী রক্ষায় এখন সবারই এগিয়ে আসা প্রয়োজন। কেবল শাস্তি দিয়ে বা সরকারের একার পক্ষে নদীগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব না। এজন্য সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের কাছে নদীর উপযোগিতার কথা ব্যাখ্যা করতে হবে। পাশাপাশি দূষণের সঙ্গে জড়িতরা যাতে যথাযথ শাস্তি পায়, তা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এটি নীতিনির্ধারণ সংশ্লিষ্ট বিষয়। সরকারের নিয়ম-নীতি রয়েছে। সে অনুযায়ী সবকিছু হয়। এটি এককভাবে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।