শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:২২ অপরাহ্ন

প্রশ্নফাঁস: চাকরি গেল পূবালী ব্যাংক কর্মকর্তার

সাদেক মাহমুদ পাভেল:
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১১ নভেম্বর, ২০২১

সরকারি পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার মো. মোস্তাফিজুর রহমানকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বুধবার (১০ নভেম্বর) ব্যাংকটির মানবসম্পদ উন্নয়ন (এইচআরডি) বিভাগের এক আদেশে তাকে বরখাস্ত করা হয়। বহিষ্কার করা ওই কর্মকর্তা ব্যাংকের রাজধানীর ইমামগঞ্জ শাখায় কর্মরত ছিলেন।
ব্যাংকের জেনারেল ম্যানেজার আহমেদ এনায়েত মনজুর এবং ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার শহিদ খান স্বাক্ষর করা বহিষ্কারাদেশ মো. মোস্তাফিজুর রহমান বরাবর পাঠানো হয়েছে। তিনি এখন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা পুলিশের কাছে গ্রেফতার আছেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। গত শনিবার (৬ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) নিয়োগের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ উঠে।
এদিকে ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কাছে ব্যাখ্যা তলব করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কেন কালো তালিকাভুক্ত করা হবে না, তা জানতে বুধবার (১০ নভেম্বর) বিকালে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে থাকা ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটি। একইসঙ্গে ওই পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ও ভাবা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির কর্মকর্তারা।
১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন:স¤প্রতি পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র ৫ থেকে সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা করে বিক্রি হয়েছে। এই ফাঁস চক্রের সঙ্গে দুটি ব্যাংক ও একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তারা জড়িত ছিল। বুধবার (১০ নভেম্বর) বিকাল ৩টায় ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানান ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত পাঁচ ব্যাংকের (অফিসার ক্যাশ পদ) শুন্যপদের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে জালিয়াতি করার অভিযোগে ৫ জনকে গ্রেফতারের পর ডিবি এই তথ্য জানায়।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- পূবালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল অফিসার (বরখাস্ত) মো. মোস্তাফিজুর রহমান , মোক্তারুজ্জামান রয়েল, শামসুল হক শ্যামল, জানে আলম মিলন, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন। ৬ থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত ধারাবাহিক অভিযানে রাজধানীসহ আশপাশের এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়।
তাদের কাছ থেকে ১টি ল্যাপটপ, বিভিন্ন মডেলের ৫টি মোবাইল, ৪টি প্রশ্নপত্র, উত্তরপত্র ৪টি, হোয়াটসঅ্যাপে রক্ষিত উত্তরপত্রের ছবি, ১টি প্রবেশপত্রের ফটোকপি ও নগদ ৬ লাখ টাকা জব্দ করা হয়।
ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুষ্ঠিত ৫টি ব্যাংকের ১৫১১টি ‘অফিসার ক্যাশ’ শূন্যপদের নিয়োগ পরীক্ষা গত ৬ নভেম্বর বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত ঢাকার বিভিন্ন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হয়। আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাংকার সিলেকশন কমিটি পরীক্ষাটি সম্পাদন করে।
দীর্ঘদিন যাবত পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কাজ করতে থাকা গোয়েন্দা তেজগাঁও বিভাগের তেজগাঁও জোনাল টিম তথ্য পায় ৫ নভেম্বর দিবাগত রাতে এই পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতে পারে। এমন তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির তেজগাঁও জোনাল টিমের এক সদস্য ছদ্মবেশে পরীক্ষার্থী সেজে পরীক্ষার দিন (৬ নভেম্বর) সকালে প্রশ্নপত্রসহ উত্তর পাওয়ার জন্য চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের হোতা রাইসুল ইসলাম স্বপনকে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করা হয়। সে ছদ্মবেশে থাকা পরীক্ষার্থীকে বুথে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে ওই পরীক্ষার উত্তরপত্রসহ তাকে হাতেনাতে গ্রেফতার করা হয়। স্বপনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত ৬ নভেম্বর সাভার শাখার শ্রীনগর থেকে রূপালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার জানে আলম মিলনকে গ্রেফতার করা হয়। জানে আলম মিলনের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর দক্ষিণ বাড্ডা থেকে শামসুল হক শ্যামলকে গ্রেফতার করা হয়। শামসুল হক শ্যামল প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস করার কথা স্বীকার করেন। পরে এই চক্রের মূল হোতা মুক্তারুজ্জামান রয়েলকে বাড্ডার আলিফনগর থেকে গ্রেফতার করা হয়।
মুক্তারুজ্জামান রয়েল আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে আইসিটি টেকনিশিয়ান হিসেবে কর্মরত। মুক্তারুজ্জামান আহছানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অন্যান্য সহযোগীদের সহায়তায় পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তরপত্র সংগ্রহ করেছে বলে স্বীকার করে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের দেওয়া তথ্য, মোবাইল ফোনে থাকা তথ্য এবং হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর লালবাগ থেকে প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের অন্যতম হোতা পূবালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার মোস্তাফিজুর রহমান মিলনকে গ্রেফতার করা হয়।
অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে রাজধানীর বাড্ডা, বসুন্ধরা, উত্তরা, মোহাম্মদপুর, কল্যাণপুর, রূপনগর, মিরপুর, মাতুয়াইল, শেওড়াপাড়া, শেরেবাংলা নগর, পল্লবী এলাকায় তারা বুথ (যেখানে পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগে নিজস্ব লোকের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীদের ফাঁস করা প্রশ্ন ও উত্তরপত্র মুখস্থ করানো হয়) তৈরি করে। প্রশ্ন ও উত্তরপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যদের তত্বাবধানে প্রত্যেক বুথে ২০/৩০ জন পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর মুখস্থ করিয়ে তাদের কেন্দ্রে পাঠানো হয়। মুক্তারুজ্জামান ও শ্যামল সুকৌশলে ৩ বার বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস করেছে। এই চক্র পরীক্ষার ৫/৬ ঘণ্টা আগেই বিভিন্ন সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করে প্রায় ২ হাজার পরীক্ষার্থীদের মাঝে পরীক্ষার প্রশ্ন ও উত্তর সরবরাহ করেছে। প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে নিয়োগ পাওয়ার আগ পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপে ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় একটি মামলা হয়েছে।
আহ্ছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ জন বহিষ্কার: ব্যাংকার্স সিলেকশন কমিটির আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স¤প্রতি অনুষ্ঠিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকায় আহছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বুধবার (১০ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. মোশারফ হোসেন স্বাক্ষরিত অফিস আদেশে তাদের বহিষ্কার করা হয়। আদেশে বল হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তে আহ্ছানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’র একজন কর্মকর্তা ও দুইজন কর্মচারীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। বহিষ্কারের কারণ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। বহিষ্কৃত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হলেন- হার্ডওয়্যার ও নেটওয়ার্কের টেকনিশিয়ান মো. মুকতাররুজ্জান, ল্যাব সহকারী মো. পারভেজ মিয়া ও অফিস অ্যাটেডেন্ট মো. দেলোয়ার হোসেন। নির্দেশনা জারির পরে এটি কার্যকর হবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা সামছুল হকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, কর্তপক্ষের সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এ নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গুরতর অভিযোগ ও প্রাথমিকভাবে তা প্রমাণিত হওয়ায় কর্তৃপক্ষ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের সদস্যরা ছদ্মবেশ ধারণ করে প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করেন। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে ডিবি বলছে, ব্যাংকের পরপর চারটি নিয়োগ পরীক্ষায়ই প্রশ্নফাঁস করেছে চক্রটি। আর চক্রে জড়িত ও গ্রেফতারকৃতদের তিনজনই সরকারি বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা। ডিবির প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। জড়িত সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র প্রণয়নসহ পরীক্ষা আয়োজনের দায়িত্বপ্রাপ্ত আহছানউল্লা ইউনির্ভাসিটি অব সাইন্স অ্যান্ড টেকনোলজির আইসিটি বিভাগ থেকে প্রশ্নফাঁস হয়েছে। এ পর্যন্ত চক্রটি প্রশ্নপত্র ও উত্তরপত্র ফাঁসের মাধ্যমে চাকরিপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে ৬০ কোটি টাকা।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com