মেহমানদারি বা অতিথি আপ্যায়নে রয়েছে মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি। মেহমানদারির ব্যাপারে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূল সা:কে খুব জোর তাকিদ দিয়েছেন। যার কারণে রাসূল সা: বলতেন, ‘আমার মনে হয় আমার কাছে মেহমানদের হক রয়েছে। তাই রাসূল সা: সাহাবায়ে কেরামদের অতিথি আপ্যায়নের ক্ষেত্রে খুব নজর দিতে বলেছেন। কিন্তু বর্তমান আমাদের সমাজে মেহমানদারিটা একটি ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়েছে। আমরা মেহমান দেখলেই বিপদ মনে করি এবং নাক ছিটকে উঠি। কিন্তু রাসূল সা: ইরশাদ করেন, ‘মেহমান কারো রিজিকে হস্তক্ষেপ করে না। বরং সে তার নিজের রিজিক ভক্ষণ করে যায়। এক সময় আমাদের দেশে মেহমানদের অনেক সেবাযতœ করা হতো। তাদের জন্য বাড়ির সামনেই বাংলো ঘর বানিয়ে রাখা হতো। যেন তারা সেখানে অবস্থান করতে পারে এবং মেহমানদের ঘরগুলো নিজেদের ঘরের চেয়েও সুন্দর করে তৈরি করা হতো। যেন তাদের কোনো কষ্ট না হয়। একসময় কোনো বাড়িতে মেহমান এলে সে বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। মেহমানদারি মহান আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি লাভের অন্যতম কারণ। আল্লাহর রাসূল সা: বলেছেন, ‘যে মানুষের সেবা করে সেই শ্রেষ্ঠ।’ (বায়হাকি) অন্য এক হাদিসে রাসূল সা: ইরশাদ করেছেন, ‘একটি ছুরি যেমন খুব তাড়াতাড়ি উটের কুঁজের দিকে চালানো হয় যার ফলে তার গর্দান শরীর থেকে অতি দ্রুত আলাদা হয়ে যায়, ঠিক তেমনি সে ঘরের দিকে অতি দ্রুত কল্যাণ অগ্রসর হতে থাকে, যে ঘরে অধিক মেহমানের আগমন ঘটতে থাকে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ) হাদিস শরিফে পাওয়া যায়, রাসূল সা: নিজের শত্রুকেও মেহমানদারি করতেন। একবার এক ইহুদি ব্যক্তি আবু জাহেলের নির্দেশ অনুযায়ী রাসূল সা:-এর মাথা মোবারক কেটে নেয়ার জন্য তার কাছে এসে বললেন, হে মোহাম্মদ! আমি তোমার বাড়িতে আজ মেহমান হতে চাই। রাসূল সা: তাকে অত্যন্ত খুশির সাথে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে মেহমান হিসেবে গ্রহণ করে নিলেন এবং রাতে অতি যতেœর সাথে আপ্যায়ন করলেন (সতর্কতা অবলম্বন করে)। যদিও তিনি জানতেন তার মাথা নেয়ার জন্য এ ব্যক্তি এসেছে। তারপরও তিনি তাকে ফিরিয়ে দেননি। সাহাবিরা হতবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! একজন অমুসলিম মেহমানের প্রতি আপনি এত সম্মানজনক আচরণ জানালেন কী কারণে? তিনি উত্তর দিলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা এ পৃথিবীতে মানুষকে সম্মানিত করে সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা বনি ইসরাইল : ৭০) হজরত সালমান ফারসি রা: বলেন, একবার আমি নবীজির খেদমতে হাজির হলাম, তিনি চেয়ারে বসা ছিলেন। আমাকে দেখে তাঁর চেয়ারটি সামনে বাড়িয়ে দিলেন আর বললেন, ‘হে সালমান! যে ব্যক্তি কোনো মেহমানের সম্মানে তার আসনটি বাড়িয়ে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তার সব গোনাহ মাফ করে দেন।’ (হায়াতুস সাহাবা)
অতিথিপরায়ণতা পরস্পর ভালোবাসা ও সহানুভূতি সৃষ্টি করে। ইবনুস সাকানের বরাতে সাহাবি আবু রুশদ ইবনে আবদুর রহমান বলেন, ইসলাম গ্রহণের আগে আমি রাসূলুল্লাহ সা:-এর মেহমান হয়েছিলাম। তিনি আমাকে তাঁর কাছে বসালেন। ভালো-মন্দ খাবার দিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে তাঁর চাদর হাদিয়া দিলেন। আমি তাঁর হৃদয়স্পর্শী আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলাম। (হায়াতুস সাহাবা)
রাসূল সা: মেহমান দেখলে অত্যন্ত আনন্দ চিত্তে তাকে ‘মারহাবা’ বলে অভ্যর্থনা জানাতেন। (ইবনুল কায়্যিম, যাদুল মাআদ) হজরত আব্বাস রা: বর্ণিত হাদিসে নবীজি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সালাত আদায় করে, জাকাত প্রদান করে, রমজানের সাওম পালন করে এবং মেহমানের আদর আপ্যায়ন করে, সে বেহেশতে প্রবেশ করবে।’ তিনি বলেন, ‘যার ঘরে মেহমানের জন্য দস্তরখানা বিছানো থাকে, ফেরেশতারা ওই ব্যক্তির জন্য রহমতের দোয়া করতে থাকেন।’ (আত্তারগিব ওয়াত তারহিব) হজরত মিকদাম আবু করিমা সামি রা:-এর রেওয়ায়েতে প্রিয়নবী বলেন, ‘রাত্রিবেলা আগন্তুক মেহমানকে আপ্যায়িত করা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর ওয়াজিব। সকাল পর্যন্ত থাকলে তখনো মেহমানদারি করা তার পাওনা। তবে মেহমান ইচ্ছা করলে এটি গ্রহণ করতে পারেন আবার ছেড়েও দিতে পারেন।’ (আদাবুল মুফরাদ) হজরত আবু হুরায়রা বর্ণিত হাদিসে নবীজি সা: ইরশাদ করেন, ‘একদিন একরাত পর্যন্ত মেহমানকে উত্তম খাদ্য প্রদান করা তার পাওনা। আর মেহমানদারি হলো সর্বনি¤œ তিন দিন। অধিক করলে তা সাদাকা হিসেবে গণ্য হবে।’ (সহিহ বুখারি) হজরত উকবা ইবনে আমিরের বর্ণনায় প্রিয় নবী সা: বলেন, ‘তোমরা যদি কোনো স¤প্রদায়ের কাছে উপস্থিত হও আর যা শোভনীয় তা দ্বারা তারা তোমাদের আপ্যায়ন করে, তবে তা সাদরে গ্রহণ করো। আর যদি তা না করে তবে মেজবানের অবস্থা অনুযায়ী তোমরা মেহমানদারির হক আদায় করে নিতে পারো।’ (সহিহ বুখারি) এই হাদিসের বিষয়ে আহমদ বলেন, ক্ষুধার তীব্রতায় যখন প্রাণনাশের আশঙ্কা দেখা দেয় অথবা জনমানবহীন এলাকার জন্য এটা প্রযোজ্য (ফাতহুল বারি)। মেহমানের সেবাযতœ করতে গিয়ে রাসূলে আকরাম সা: এবং তাঁর পরিবার পরিজনকে অনেক সময় অর্ধাহারে-অনাহারে থাকতে হতো। তবুও তিনি কখনো মেহমানের আগমনকে অনাকাক্সিক্ষত মনে করতেন না এবং বিরক্ত হতেন না।
জনৈক আনসারি সাহাবির মেহমানদারি : একবার এক বেদুইন লোক রাসূল সা:-এর দরবারে এসে উপস্থিত হলেন। রাসূল সা: তাকে মেহমানদারির জন্য নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন। তখন তার বিবি রাসূল সা:কে বলতে লাগলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা:! আজ আমাদের ঘরে পানি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
এ কথা শুনে রাসূল সা: সাহাবিদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের মাঝে কে আছ, যে এই বেদুইনকে মেহমানদারির ব্যবস্থা করবে? তখন এক আনসারি সাহাবি তাকে মেহমান হিসেবে নিজের বাড়ি নিয়ে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে শুনতে পেলেন তার ঘরে শুধুমাত্র দু’টি রুটি ছাড়া আর কিছুই নেই। আনসারি সাহাবি মোটেও ঘাবড়ালেন না, বরং রাত্রিবেলায় বেদুইন ব্যক্তিকে নিয়ে একসাথে খেতে বসলেন এবং দুটি রুটিই তার প্লেটে দিয়ে নিজে খালি প্লেট নিয়ে বসে আছেন। খাওয়ার সময় নিজের কুপি বাতিটি (কৌশলে) নিভিয়ে দিলেন যেন বেদুইন লোকটি কোনো কিছু দেখতে না পায়। সকালে আনসারি সাহাবি বেদুইন লোকটিকে নিয়ে যখন রাসূল সা:-এর দরবারে উপস্থিত হলেন তখন রাসূল সা: তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি গত রাতে কী করেছ যার কারণে আল্লাহ তায়ালা তোমার ওপর পরিপূর্ণ রাজি ও খুশি হয়ে গেলেন? আনসারি সাহাবি জবাব দিলেন, নিজে না খেয়ে মেহমানের মেহমানদারি করেছি। এই হলো মেহমানদের প্রতি সাহাবিদের ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। লেখক: খতিব, মসজিদে বায়তুন নূর, মাওনা, গাজীপুর