আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম এখন পড়তির দিকে। মূল্যসূচক নি¤œমুখী প্রাকৃতিক গ্যাসেরও। কভিড-উত্তরণ পরিস্থিতিতে জ্বালানির দামের ব্যাপক উল্লম্ফন দেখে বাজার বিশ্লেষণকারী বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান আভাস দিয়েছিল, নতুন বছরেও বৈশ্বিক জ্বালানির বাজার আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠবে। যদিও মার্কিন জ্বালানি খাতের গবেষণা ও তথ্য সেবাদাতা ফেডারেল সংস্থা এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (ইআইএ) বলছে, নতুন বছরে তেল-গ্যাসের দাম ঊর্ধ্বমুখী নয়, বরং কমে যাবে।
সংস্থাটি বলছে, কভিড পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা বজায় থাকলে জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস উত্তোলন যেমন বাড়বে, তেমনি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থাপনায়ও গতি ফিরবে। বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্য কমে গেলে বৃহৎ আমদানিকারক দেশগুলো মজুদ বাড়াবে। বাংলাদেশও এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, মজুদ সক্ষমতা ও ক্রয় চুক্তি বাড়ানো গেলে জ্বালানি খাতে বর্ধিত মূল্য ধরে রাখারও প্রয়োজনীয়তা কমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিকভাবে জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে এখনই আলোচনা শুরু করা উচিত সরকারের, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারের কম মূল্যের সুযোগ সংকটকালে কাজে লাগানো যায়। এক্ষেত্রে মজুদের বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
জ্বালানির বাজার বিশ্লেষণকারী সংস্থা ইআইএ তাদের পূর্বাভাসে বলছে, আগামী বছরের শুরুতে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমে আসবে। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে (প্রথম প্রান্তিক) যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটের (ডব্লিউটিআই) স্পট মূল্য থাকবে ব্যারেলপ্রতি ৭৪ ডলার ৯২ সেন্ট। বছর শেষে অর্থাৎ চতুর্থ প্রান্তিকে মূল্য পতন হয়ে ৬২ দশমিক ৯৮ ডলারে দাঁড়াবে। একই সঙ্গে জ্বালানি তেলের আন্তর্জাতিক বাজার আদর্শ ব্রেন্টের দাম বছরের শুরুতে ব্যারেলপ্রতি ৭৮ দশমিক ২৬ ডলার থাকবে, যা বছর শেষে কমে ৬৬ দশমিক ৯৮ ডলারে দাঁড়াবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে ডব্লিউটিআইয়ের দাম ৭৮ ডলার ৬০ সেন্ট ও ব্রেন্টের দাম ৮২ দশমিক ৫০ সেন্ট। গত এক সপ্তাহে পণ্য দুটিতে ব্যারেলপ্রতি অন্তত ৬ ডলার কমে গেছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন দুই দেশ নিজেদের মজুদ জ্বালানি তেল বাজারে ছাড়ার পর সূচক নি¤œমুখী হতে শুরু করে। স¤প্রতি যুক্তরাষ্ট্র তাদের জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঠেকাতে কেন্দ্রীয় মজুদাগার থেকে পাঁচ কোটি ব্যারেল জ্বালানি তেল বাজারে ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছে। গত সাত বছরে দেশটিতে জ্বালানি তেল সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি চীন, জাপান ও প্রতিবেশী দেশ ভারতও তেলের বাজার ঠেকাতে পদক্ষেপ নেবে বলে পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। জ্বালানি উত্তোলনকারী দেশ ও আমদানিকারকদের এসব উদ্যোগের সঙ্গে ইআইএর প্রক্ষেপণও মিলে যাচ্ছে। ইআইএর পূর্বাভাস অনুযায়ী, জ্বালানি তেলের দাম কমে যাওয়ার পাশাপাশি গ্যাসের দামেও পতন হবে। গত অক্টোবরের মাঝামাঝিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতি এমএমবিটিইউ গ্যাসের দাম সাড়ে ৬ ডলারের কাছাকাছি ছিল। তখন এশিয়ার স্পট মার্কেটে প্রতি এমএমবিটিইউ ডিসেম্বরে সরবরাহ চুক্তি মূল্য ছিল ৩৫ ডলারের কিছু বেশি। আন্তর্জাতিক জ্বালানি গবেষণা সংস্থা এনার্জি ইন্টেলিজেন্সের তথ্যানুযায়ী, স্পট মার্কেটে বর্তমানে প্রতি এমএমবিটিইউ এলএনজি বিক্রি হচ্ছে ৩৪ ডলার। এর আগে গ্যাসের বাজার উত্তপ্ত হয়ে উঠলে অক্টোবরে ৫৬ ডলারে উঠে যায়। যদিও পরে তা ৩৫ ডলারে নেমে আসে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে গ্যাসের দাম আগের অবস্থায় ফিরে গেলে এশিয়ার বাজারেও তার প্রভাব পড়বে বলে সংস্থাটির পূর্বাভাসে উঠে এসেছে।
দেশের বাজারে জ্বালানি পণ্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করা হয় অপরিশোধিত জ্বালানি। দেশে আনার পর তা পরিশোধন করে বাজারে সরবরাহ করে রাষ্ট্রায়ত্ত জ্বালানি তেল আমদানিকারক সংস্থা বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। সংস্থাটি বর্তমানে ৪০-৪৫ দিনের জ্বালানি তেল মজুদ রাখতে পারে। সব মিলিয়ে দেশে ১৩ লাখ টন জ্বালানি মজুদ সক্ষমতা রয়েছে। তবে এ সক্ষমতা পর্যাপ্ত নয় বলে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে বছরের যে সময়ে অস্থিরতা বিরাজ করে, অন্তত সে সময়ের জন্য মজুদ সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বদরূল ইমাম বণিক বার্তাকে বলেন, জ্বালানি পণ্যের দামে ওঠানামা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে অতিমাত্রায় মূল্যবৃদ্ধিতে ভোগান্তিতে পড়তে হয় আমাদের মতো আমদানিকারক দেশগুলোকে। আমদানির ওপর নির্ভরতার কারণে আমাদের আন্তর্জাতিক বাজার অনুসরণ করতে হচ্ছে। গ্যাসের ক্ষেত্রে দাম কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে হবে। অন্যদিকে স্পট এলএনজির সুযোগ কাজে লাগাতে হলে মজুদ সক্ষমতার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। জ্বালানি তেল আমদানিতেও মজুদ সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আমাদের মজুদ সক্ষমতা কম, মাত্র দেড় মাসের। এটি কয়েক মাসের জন্য যাতে করা যায় সেজন্য দ্রুত পরিকল্পনা করতে পারে বিপিসি। জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, দেশে গ্যাসের চাহিদা রয়েছে অন্তত ৪০০ কোটি ঘনফুটের। এর মধ্যে সরবরাহ করা হয় ৩২০ কোটি ঘনফুটের মতো। সরবরাহকৃত গ্যাসের মধ্যে ৭০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হয় আমদানির মাধ্যমে। আমদানিনির্ভরতার কারণে বিশ্ববাজারে এলএনজির দামে ঊর্ধ্বমুখিতার প্রভাব পড়ছে দেশে পণ্যটি সরবরাহের ক্ষেত্রে। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, অন্তত দুই মাসের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো গেলে দেশে জ্বালানি তেলের দামে অস্থিতিশীলতা কিছুটা হলেও কমিয়ে আনা সম্ভব। অনদিকে কম মূল্যের জ্বালানি হিসেবে গ্যাস মজুদ করতে হবে। চাহিদা মেটাতে দেশীয় সক্ষমতার পাশাপাশি প্রতি বছর এলএনজি আমদানি করতে হয়। দেশে মজুদ সক্ষমতা গড়ে তোলা হলে গ্যাস আমদানিতে যে আর্থিক চাপ তৈরি হচ্ছে, তা মোকাবেলা করা যাবে।