নাগরিক জীবন ছাপিয়ে সিলিন্ডার গ্যাস বহু আগেই পৌঁছে গেছে নিভৃত পল্লীতেও। এতে নারীদের রান্নাঘরের কাজ অনেকটাই সহজ হয়েছে। কমেছে কাঠখড় পুড়িয়ে প্রথাগত রান্নার কষ্ট। সেই সঙ্গে নতুন উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ক্রমবর্ধমান দুর্ঘটনা। দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত কমে আসায় এলপি গ্যাসের চুলায় রান্নাবান্নার প্রচলন বাড়ছে। শহরাঞ্চলের অনেক বাসাবাড়ি, হোটেল, রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ না পাওয়ায় রান্নার কাজে সিলিন্ডারের গ্যাস অপরিহর্য হয়ে পড়েছে। গ্রামাঞ্চলেরও আয় বৃদ্ধির ফলে অনেক পরিবার এখন খড়ি-লাকড়ির চুলার পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্না করছে। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করছে সিলিন্ডারের গ্যাস।
এটা দেশের অগ্রগতির লক্ষণ। তবে সিলিন্ডার গ্যাসের চুলা ব্যবহারে যে ঝুঁকি আছে এবং সেই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য যে সচেতনতা প্রয়োজন, দেশে তার ঘাটতি রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অসচেতনতার পাশাপাশি নিম্নমানের সরঞ্জামের কারণে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকা-ের ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। এসব বিস্ফোরণে মানুষ মারা যাচ্ছে। গুরুতরভাবে জখম হয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারাচ্ছে। হচ্ছে সম্পদের বিপুল ক্ষতি। ঢাকার বিভিন্ন বস্তি ও আশপাশে বিভিন্ন এলাকায় অবৈধভাবে অনেক গ্যাসপাইপ সংযোগ নেয়া হয়েছে; অনেক গ্যাস পাইপলাইনে কারিগরি ত্রুটি রয়েছে। পাইপলাইনের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ ঘটে মানুষের হতাহত হওয়ার খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর মুগদায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে চারজন দগ্ধ হন। দগ্ধ চারজনের মধ্যে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন, প্রিয়াঙ্কা (৩০) ও তার পাঁচ বছরে ছেলে অরূপ।
গ্যাস সিলিন্ডার ফেটে বিস্ফোরণ, চুলার ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ ইত্যাদি নানাভাবে দুর্ঘটনা ঘটে মানুষ মারা যাচ্ছে। কিন্তু এসব দুর্ঘটনার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায় না। ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রকাশিত সংবাদের সূত্রে এমন দুর্ঘটনার হিসাব থেকে দেখা যাচ্ছে, গ্যাস–দুর্ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ ও ১৯ সালে ২০৪টি। অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটলেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০৬টিতে। ২০২০-২১ সালে এই পরিসংখ্যান হচ্ছে ৩৯৮টি। এর আগে গত ৯ জুলাই দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে পাঁচ জন দগ্ধ হন। এরমধ্যে দুই জনের মৃত্যু হয়।
গত ১৩ নভেম্বর (শনিবার) রাজধানীর সায়েদাবাদে আওয়াল আমিরুল মোটরপার্টস মার্কেটের নিচতলায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনায় ৬ জন দগ্ধ হয়। এ ঘটনায় দগ্ধ একজনের মৃত্যু হয়েছে।
এছাড়াও শনিবার (৬ নভেম্বর) বাগেরহাটের মোংলা বন্দরের শিল্পাঞ্চলে বসুন্ধরা গ্যাস কারখানায় সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৬ জন গুরুতর দগ্ধ হয়। সন্ধ্যায় কারখানার মেইন পয়েন্ট থেকে ৪৫ কেজি ওজনের একটি বড় সিলিন্ডার ভর্তি করার সময় এ বিস্ফোরণ ঘটে।
বারবার সিলিন্ডার বিস্ফোরণের কারণ জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন বলেন, সবার আগে মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর হতে হবে। প্রয়োজনে কোনো সংস্থার মাধ্যমে একটা স্ট্যান্ডার্ড করতে হবে। সেই স্ট্যান্ডার্ড মানছে কি-না তা কঠোরভাবে মনিটর করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সিলিন্ডার ব্যবসার লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন ও সব সিলিন্ডার ব্যবসায়ীকে এ আদেশ দেয়া যে সিলিন্ডার বিক্রির আগে তারা অবশ্যই ক্রেতাকে এমএসডিএস (ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডেটা শিট) দেখাবে। সিলিন্ডারের সঙ্গে তা ব্যবহারের নিয়মকানুন ও প্রয়োজনীয় সতর্কতাসংবলিত লিফলেট বিতরণ করবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। দুর্ঘটনায় অপমৃত্যুর তালিকায় গ্যাস দুর্ঘটনার ভূমিকা ক্রমেই বেড়ে যাওয়া উদ্বেগের বিষয়। কিন্তু কোনো কর্তৃপক্ষ এই সমস্যা নিয়ে ভাবছে বলে মনে হচ্ছে না। দুর্ঘটনার খবর পেলে ফায়ার সার্ভিস সেখানে যায়। কিন্তু দুর্ঘটনা যেন না ঘটে, সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।
জানা যায়, দেশে প্রায় ৩০টির বেশি এলপি গ্যাস কোম্পানি রয়েছে। আর এলপিজি সরবরাহকারী একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। দেশে এখন বাৎসরিক চাহিদা ১০ লাখ টনের মধ্যে। আর বিপিসি মাত্র ১৬ হাজার টন সরবরাহ করে। ৩০টা এলপি গ্যাস কোম্পানির বেশিরভাগ কোম্পানিই বিদেশ থেকে সিলিন্ডার আমদানি করে থাকে। সে ক্ষেত্রে সিলিন্ডারগুলোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ সেগুলোর মান পরীক্ষার জন্য সরকারি বা বেসরকারি কোনো পরীক্ষাগার নেই। আবাসিক গ্রাহকদের নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ করার পর থেকে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসব কোম্পানির কর্মকর্তারা বলছেন, গ্যাস সরবরাহে সর্বাধিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়, সরকারি নিয়ম অনুযায়ী গ্যাস সিলিন্ডারগুলোকে পরীক্ষা করা হয়। গ্রাহকরা যেন নিরাপদে এলপি গ্যাস ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে গুরুত্ব দেয়া হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগেই সতর্ক হতে হবে। সবার আগে যে বিষয়টি দেখতে হবে তা হচ্ছে, সিলিন্ডারের মেয়াদ আছে কিনা। সিলিন্ডারের মেয়াদ দেখার পর এটির সঙ্গে সংযুক্ত ভাল্বটির মেয়াদও দেখতে হবে। সেখানে কোনো ছিদ্র আছে কিনা, তা যাচাই বাছাই করতে হবে। মূলত এই দুই কারণে সিলিন্ডার থেকে লিকেজের কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।
এবিষয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের প্রধান বিস্ফোরক পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ জার্নালকে বলেন, সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হচ্ছে না। বিস্ফোরণ হচ্ছে সিলিন্ডারের এক্সসরিজ (যন্ত্রাংশ)। এটার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, গ্রাহক হিসেবে বাজার থেকে যারা এসব নিম্নমানের এক্সসরিজ কেনে তারাই এর জন্য দায়ী। রেগুলেটর ও হোসপাইপের অথোরাইজ আমরা না বা এগুলো দেখার দায়িত্বও আমাদের না।
তিনি বলেন, বাজারে বেক্সিমকো ওমেরাসহ ৩০-৪০ টা গ্যাস কোম্পানির রয়েছে। তাদের সিলিন্ডার নিয়ে গুণগতমানের কোনো অভাব নেই। তবে এগুলোর নিম্নমানের যন্ত্রাংশের ব্যবহার এবং যত্রতত্র বিক্রির কারণকে আমরা চিহ্নিত করেছি। একই ঘুমানোর ঘরে এসব সিলিন্ডার রাখা হচ্ছে যা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। আর এটা ব্যবাহারের পর ঠিকমতো বন্ধ না করলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ এখন পর্যন্ত সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে এমন কোনো রেকর্ড নেই। তাই ব্যক্তি পর্যায়ে সতর্ক হতে হবে। পাশাপাশি আমরাও সতর্কতার জন্য বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। টিভিসি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিতে হবে সবাইকে।
জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সারাদেশে যে এলপিজি গ্যাস বিক্রি হয়, সেই সিলিন্ডারগুলো নির্দিষ্ট সময় পরপর পরীক্ষা করা হলেও সিলিন্ডারের মুখের ভাল্ব একেবারে গ্রাহকের ঘরেই থাকে। সেই দায়িত্ব গ্রাহককে নিতে হবে। সাধারণত দুই বছর পর পর ভাল্ব বদল করা উচিত হলেও গ্রাহক বছরের পর বছর একই ভাল্ব ব্যবহার করেন। এতে ভাল্বে ছিদ্র তৈরি হয়। আর সেখান থেকে গ্যাস বের হয়ে ঘরের মধ্যে জমে থাকে। বদ্ধ ঘরে এভাবে গ্যাস জমে গেলে আগুনের সংস্পর্শে এলেই দুর্ঘটনা ঘটে। ব্যাপকভাবে সচেতনতামূলক প্রচার চালিয়েই এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাদের মতে, দেশে যে সব দুর্ঘটনা ঘটে, তার বেশিরভাগই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য গ্রাহকদের সচেতন হওয়া জরুরি।
জ্বালানি বিভাগ গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ ও দুর্ঘটনার কারণ বিশ্লেষণ করে একটা পরিপত্র জারি করেছে। ওই পরিপত্রে তিনটি ধাপে সতর্কতা অবলম্বনের উপায় বলে দেয়া হয়েছে। সেগুলো হলো ১. সিলিন্ডার রাখার জন্য নিরাপদ জায়গা নির্ধারণ ২. রান্না শুরুর আগে ও শেষ হওয়ার পরে সতর্কতা এবং সিলিন্ডার রাখার সতর্কতামূলক ব্যবস্থা, ৩. রেগুলেটরসহ সিলিন্ডারের খুঁটিনাটি সব পরীক্ষা করে রান্নাঘরে যথাযথভাবে বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।