বাংলাদেশ ব্যাংক একটি রেগুলেটরি সংস্থা। রাষ্ট্রের পক্ষে এটি দেশের ব্যাংক ও ব্যাংক বহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি শেয়ার বাজার ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। আমানতকারীদের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংক ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে ব্যাংকগুলোকে নিরুৎসাহিত করে নিয়ম মেনে বিনিয়োগের পরামর্শ দিচ্ছে। এরই মধ্যে নিয়মবহির্ভূত বিনিয়োগ করায় সরকারি সোনালী ব্যাংকসহ বেশক’টি ব্যাংককে জরিমানা ও ডজনখানেক ব্যাংককে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিকে শেয়ারবাজারের দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিদ্যমান দূরত্ব সন্দেহ বাড়িয়েছে বিনিয়োগকারীদের। এতে বাজার থেকে হারাতে বসেছে হাজার হাজার কোটি টাকার মূলধন।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে বিএসইসির দূরত্বের বিষয়টি বেশ পুরনো। তবে ইদানিং এটি প্রকাশ্যে আসে বেসরকারি ব্যাংক ওয়ান ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদনকে কেন্দ্র করে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত বেসরকারি ওয়ান ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পরিবর্তনের নির্দেশ দিলে এর সরাসরি বিরোধিতা করে বিএসইসি। গত আগস্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনাকে ঘিরেও দুই সংস্থার মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে প্রতিদিনের প্রতিবেদন চেয়ে চিঠি দেয়। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ খতিয়ে দেখতে ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউস পরিদর্শনও শুরু করে। এতে বিএসইসি’র সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিরোধ দেখা দেয়। দুই সংস্থার মধ্যে বিপরীতমুখী অবস্থান দেখা গেছে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির অবণ্টিত লভ্যাংশের ইস্যুতেও। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, অদাবিকৃত লভ্যাংশের অর্থ শেয়ারবাজারে স্থিতিশীলতায় গঠিত তহবিলে যাওয়ার সুযোগ নেই। যেসব ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের অর্থ তহবিলে জমা দিয়েছে, তা ফেরত আনতে হবে। অপরদিকে বিএসইসি বলছে, এ টাকা বিনিয়োগকারীর। শেয়ারবাজারের তহবিলেই এ অর্থ স্থানান্তর হবে। এসব ইস্যুতে দুই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানকে আলোচনার জন্য আগামী ৭ ডিসেম্বর উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে ডেকেছে অর্থমন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। সচিবালয়ের অর্থমন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
বৈঠকে অংশ নিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। একইসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবি আর) চেয়ারম্যান এবং আইসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালককেও বৈঠকে অংশ নিতে অনুরোধ করা হয়েছে।
দ্বন্দ্ব থেকে আতঙ্ক, বিজ্ঞপ্তিতে স্বস্তি:: মূলত, গত মঙ্গলবার (৩০ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএসইসি’র সভার বিষয়বস্তু নিয়ে দুই সংস্থার পরস্পরবিরোধী অবস্থান তৈরি হয়। সভা শেষে বিএসইসির পক্ষ থেকে সভার কিছু সিদ্ধান্তের কথা জানানো হয়। কিন্তু বুধবার বিকালে বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, মঙ্গলবারের সভায় আলোচনা হলেও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
এতে বুধবার সন্ধ্যা থেকে শেয়ারবাজারের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়। যার প্রভাব সপ্তাহের শেষ দিন বৃহস্পতিবার লেনদেনের শুরুতেই দেখা যায়। শুরুর ৫ মিনিটের মধ্যেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৯০ পয়েন্ট পড়ে যায়। এরপর সূচক কিছুটা বেড়ে আবার পড়ে। এভাবেই দুই ঘণ্টা লেনদেন চলে। ততক্ষণে আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তি। ১ ডিসেম্বর প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিটিতে শেয়ারবাজার নিয়ে একটি সভার কথা জানানো হয়। ওটা ছড়িয়ে পড়ার পর বিনিয়োগকারীরা আশান্বিত হয়ে ওঠেন। তাতে থামে আতঙ্কের বিক্রি। এতে দিন শেষে ডিএসইএক্স সূচক ৮৯ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৯৩৬ পয়েন্টে।
বিএসইসির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য: বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সভায় কোনও বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়নি বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বন্ড এক্সপোজার লিমিটের (পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ সীমা) বাইরে রাখা হবে, এ তথ্যও সঠিক নয় বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বুধবার (১ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংক এক বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানায়। এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খানের সভাপতিত্বে মঙ্গলবার বিএসইসির একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পূর্বনির্ধারিত সভা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সভা শেষে বিএসইসির প্রতিনিধির বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে ওই সভায় কতিপয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে তা সঠিক নয় বলে দাবি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবারের বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে কেউ কথা বলেননি। তবে বিএসইসি কমিশনার শেখ শামসুদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক ও সহকারী মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সভায় বিএসইসির উদ্যোগে ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ড গঠনের ফলে তফসিলি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন এবং পুঞ্জিভূত লোকসান বিদ্যমান থাকলেও সংশ্লিষ্ট বছরের মুনাফা হতে নগদ লভ্যাংশ বিতরণ নিয়ে আলোচনা হয়। সভায় ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১-এর ৩৫ (১) (গ) ধারা ও ২২ ধারা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এর ১০ ধারার বিষয়গুলো ব্যাখ্যাপূর্বক ক্যাপিটাল মার্কেট স্ট্যাবিলাইজেশন ফান্ডে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অদাবিকৃত তহবিল স্থানান্তরের এবং পুঞ্জিভূত লোকসান বিদ্যমান থাকলেও সংশ্লিষ্ট বছরের মুনাফা থেকে নগদ লভ্যাংশ বিতরণের বিষয়টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে আইনসম্মত নয় বলে বিএসইসি প্রতিনিধিদলকে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একইসঙ্গে এ বিষয়ে বিএসইসির নোটিফিকেশনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।
ব্যাংক কোম্পানি আইন, ১৯৯১ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩-এ পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগের বিষয়ে বিদ্যমান কতিপয় আইনি সীমাবদ্ধতার বিষয়েও বিএসইসি প্রতিনিধি দলকে স্পষ্টীকরণ করা হয়। তবে এ সব বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
টাকার অঙ্কে কমেছে লেনদেন: এদিকে দুই নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের দূরত্বের কারণে এক সপ্তাহে ১৫ হাজার কোটি টাকা হাওয়া হয়ে গেলেও বিদায়ী সপ্তাহে (২৮ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বর) পৌনে সাত হাজার কোটি টাকা ফিরে পেয়েছে বিনিয়োগকারীরা। এ সপ্তাহে আবার সব সূচকই বেড়েছে। বেড়েছে লেনদেনে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট দর। তবে টাকার পরিমাণে লেনদেন কমেছে।
জানা গেছে, সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে লেনদেন শুরুর আগে স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই)-এ বাজার মূলধন ছিল প্রায় ৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৭ কোটি টাকা। সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসের লেনদেন শেষে মূলধন দাঁড়ায় প্রায় ৫ লাখ ৫২ হাজার ৮৪০ কোটি টাকায়। অর্থাৎ সপ্তাহের ব্যবধানে বিনিয়োগকারীরা প্রায় ৬ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা বা ১.২৩ শতাংশ মূলধন ফিরে পেয়েছেন। বিদায়ী সপ্তাহে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার ৩০৬ কোটি টাকার। সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইতে লেনদেন প্রায় এক হাজার ২৬৬ কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ কমেছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ৮৪.১১ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ছয় হাজার ৯৩৬.২০ পয়েন্টে। শরিয়াহ সূচক ১৬.৫৩ পয়েন্ট এবং ডিএসই-৩০ সূচক ৩৩.০৭ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে এক হাজার ৪৫৮.৯২ পয়েন্টে এবং দুই হাজার ৬৩৫.৯৪ পয়েন্টে। বিদায়ী সপ্তাহে ডিএসইতে মোট ৩৮০টি প্রতিষ্ঠান শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দর বেড়েছে ১৭৬টির, কমেছে ১৬৮টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ৩৬টির শেয়ার ও ইউনিট দর। অপর শেয়ার বাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) বিদায়ী সপ্তাহে টাকার পরিমাণে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২৪২ কোটি ৬৬ লাখ টাকার। আগের সপ্তাহে লেনদেন হয়েছিল প্রায় ২৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকার। সপ্তাহের ব্যবধানে সিএসইতে লেনদেন প্রায় ১৯ কোটি ২৬ লাখ টাকা বা ৭ শতাংশ কমেছে। সপ্তাহজুড়ে সিএসইতে ৩৩৯টি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিট লেনদেনে অংশ নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ১৫৩টির দর বেড়েছে, ১৬২টির কমেছে এবং ২৪টির দর অপরিবর্তিত রয়েছে।- বাংলাট্রিবিউন