নানামুখী উদ্যোগের পরও ভোজ্যতেলের বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ‘অজুহাত’ দেখানো হচ্ছে এখনও। গত বছরের এপ্রিলের শুরুতে সয়াবিনের দাম বাড়ে বিশ্বজুড়ে। দেশে সেটার প্রভাব পড়তে সময় লাগেনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম স্থিতিশীল ও উৎপাদন বাড়লেও দেশে সেটার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
২০২০ সালের এপ্রিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম ছিল ৭০০ ডলার। ২০২১ সালের এপ্রিলে হয় ১৪৫০ ডলার। অক্টোবরে ১৬৬০ ডলার। এরপর দামও স্থিতিশীল হয়েছে, উৎপাদনও বেড়েছে। তারপরও দেশের বাজারে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দাম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে বার বার দর নির্ধারণ করে দিলেও বাজারে সেটার প্রভাব নেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের পর্যালোচনা ও পূর্বাভাস সেলের নিয়মিত পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ২০২০ সালের জুনের পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দামে ঊর্ধ্বগতি দেখা গেছে। ভোজ্যতেলের দর নির্ভর করে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর। মোট চাহিদার ৯৫ ভাগেরও বেশি আমদানি হয়। এদিকে, করোনার মধ্যেও বিশ্বে সয়াবিনের উৎপাদন বেড়েছে। তবু বেড়েছে দাম। বিশ্লেষকেরা বলছেন, উৎপাদক দেশগুলো রফতানি বাড়ালেও ডলারের বিপরীতে ওই দেশগুলোর মুদ্রা শক্তিশালী হওয়াতেই তেলের দাম বেড়েছে। মার্কিন বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনডেক্সবক্স-এর তথ্যানুযায়ী, গতবছর থেকেই সয়াবিন থেকে তৈরি প্রাকৃতিক জ্বালানি বায়োডিজেলের উৎপাদন কমেছে। এতেও বেড়েছে সয়াবিন তেলের উৎপাদন।
যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যেখানে বিশ্বব্যাপী ৫ কোটি ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয়, সেখানে ২০২০ সালে হয়েছিল ৬ কোটি ১০ লাখ টন। তারপরও কেন দাম বাড়লো? কারণ হিসেবে ইনডেক্সবক্স বলছে উৎপাদক দেশগুলো রফতানি শুল্ক বাড়িয়েছে বলেই দাম বেড়েছে।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সয়াবিন তেল উৎপাদিত হয় চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলে। এর মধ্যে ২০১৯ সালে চীন ১ কোটি ৮০ লাখ টন ও যুক্তরাষ্ট্র ৮০ লাখ টন সয়াবিন তেল উৎপাদন করে। যা বিশ্বের মোট উৎপাদনের প্রায় ৪৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালে উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫ কোটি ৮০ লাখ টন। ২০২০ সালে বিভিন্ন দেশে উৎপাদিত হয়েছে ৬ কোটি ১০ লাখ টন।
করোনার কারণে সয়াবিন তেলের উপজাত সয়ামিলের (সয়াবিন থেকে তৈরি খাবার) চাহিদাও কমে যায়, এ কারণেও বাড়তে পারে তেলের দাম। ২০২১ সালে আরও বেশি তেল উৎপাদন হবে বলে জানিয়েছে ইনডেক্সবক্স।
দেশীয় কোম্পানিগুলো আরও বাড়াতে চায়: একদিকে আন্তর্জাতিক বাজারের টালমাটাল পরিস্থিতি, অপরদিকে দেশীয় কোম্পানিগুলোর কারসাজি; দুটো মিলে দেশের ভোজ্যতেলের বাজার ক্রমশ অস্থির করছে। প্রতিলিটার সয়াবিন তেল ১৬৮ থেকে ১৭২ টাকায় কিনতে গিয়ে সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা। সরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) পণ্য বিক্রির ট্রাকের সামনের লাইনও বড় হচ্ছে প্রতিদিন। সেখানেও ১০০ টাকার সয়াবিন তেলের দাম হয়েছে ১১০ টাকা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, সয়াবিন তেলের দাম সরকার যতই ঠিক করে দিক, তা কার্যকর করা যায় না ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফার প্রবণতার কারণে। ব্যবসায়ীরা এখনও নিজেদের মতো করে দর নির্ধারণ করছেন। খুচরা ব্যবসায়ীদেরও কিছু করার থাকে না। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ভোজ্যতেলের দাম নিয়ে স্বেচ্ছাচারিতার পেছনে রয়েছে মূলত পাঁচটি পরিশোধনকারী কারখানার সিন্ডিকেট। তারাই ঠিক করে দেয় বাজারে সয়াবিন তেলের দাম।
আবার দেশের ১১টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ভোজ্যতেল আমদানিতে সবগুলো প্রতিষ্ঠান সক্রিয় নেই। এতে প্রতিযোগিতাও কমেছে। অবশ্য সম্প্রতি নূরজাহান গ্রুপ, রুবাইয়া ভেজিটেবল অয়েল ও মোস্তফা গ্রুপ ভোজ্যতেল আমদানি শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আমদানি করে সিটি গ্রুপ। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে টিকে গ্রুপ। তৃতীয় অবস্থানে মেঘনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেড। ভোজ্যতেলের বাজারের নিয়ন্ত্রণ এখনও মূলত এদের হাতেই।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, দামের কারসাজি ধরতে কয়েকবার রিফাইনারি কারখানার প্রধান কার্যালয়গুলোতে অভিযান চালানো হয়েছে। অভিযান চালানো হয় সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও টিকে গ্রুপে। এ ছাড়া, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গঠিত মনিটরিং টিম মেঘনা ও সিটি গ্রুপের মিলও পরিদর্শন করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বললেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজতেলের দর যে হারে বেড়েছে, সেই হারে দেশে এখনও বাড়ানো হয়নি। কোম্পানিগুলো অনেকটা লোকসানেই বিক্রি করছে। কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে দাম কিছুটা বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হলেও ট্রেড এন্ড ট্যারিফ কমিশন মানছে না। কতদিন এভাবে চালানো যাবে তা নিয়ে কোম্পানিগুলোই সন্দিহান বলে জানালেন বিশ্বজিৎ সাহা। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জানিয়েছেন, সয়াবিন তেল আমদানিনির্ভর বলে আন্তর্জাতিক বাজারে কঠোরভাবে নজর রাখতে হচ্ছে। সেখানে দাম কমার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বাজারে কমানো হবে। মন্ত্রী আরও জানিয়েছেন, সয়াবিন তেল নিয়ে একচেটিয়া বাণিজ্যের সুযোগ নেই। উল্লেখ্য, দেশে বছরে ভোজ্যতেলের মোট চাহিদা ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে সয়াবিনের চাহিদা ১১ লাখ টন, পামঅয়েলের ৩ লাখ টন এবং সরিষাতেলের ১ লাখ টন।-বাংলাট্রিবিউন