শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:৩৬ অপরাহ্ন

‘বাবা ছাড়া আমি ভাত খাবো না’

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২১
মায়ের কোলে জান্নাতুল ফেরদৌস আনিকা

‘বাবা ছাড়া আমার ছয় বছরের মেয়ে জান্নাতুল ফেরদৌস আনিকা ভাত খায় না। তাকে আমি কী করে বোঝাবো যে তার বাবা আর কখনও ভাত খাওয়াবে না। আর কখনও আদর করবে না। সে শুধু আমাকে প্রশ্ন করেÍ মা বাবা কখন আসবে? বাবা ছাড়া আমি ভাত খাবো না।’
খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের প্রফেসর ড. মো. সেলিম হোসেনের স্ত্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা কান্নাজড়িত কণ্ঠে মঙ্গলবার (৭ ডিসেম্বর) দুপুরে রাইজিংবিডিকে এ কথা বলেন। স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে তিনি চুয়াডাঙ্গায় বাবার বাড়িতে অবস্থান করছেন। অভিযোগ আছে, ছাত্রলীগ নেতাদের মানসিক নির্যাতনে স্ট্রোক করে ড. মো. সেলিম হোসেনের মৃত্যু হয়।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, ‘কী অপরাধ ছিলো আমার স্বামীর? তিনি সুস্থ অবস্থায় বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। আর অসুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে আসেন। তারপরই মারা গেলেন। কেন আমার স্বামীকে অকালে জীবন দিতে হলো? আমার স্বামীর মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী আমি তাদের ফাঁসি চাই।’এ সময় তিনি নার্সারিতে পড়ুয়া তার একমাত্র শিশু কন্যার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলেন।
ড. সেলিম হোসেনের স্ত্র্রী সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, ‘আমার ভাইয়ের ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আনিকা টেলিভিশন দেখতে বসলেও বার বার বাবার কথা বলছে। কোনোভাবে মেয়েকে সামলানো যাচ্ছে না। মেয়েকে নিয়ে আমি নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ছি।’
সাবিনা খাতুন রিক্তা অভিযোগ করে বলেন, ‘‘স্বামীর মৃত্যুর পর আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ি। এ কারণে চুয়াডাঙ্গায় বাবা ও ভাইয়ের বাড়িতে অবস্থান করছি। কিন্তু বিভিন্ন মোবাইল নম্বর থেকে ফোন করে এক ব্যক্তি আমাকে ভয়ভীতি দেখাচ্ছেন। কখনও বলছেনÍ ‘যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় এখনই মেয়েকে নিয়ে থানায় চলে আসেন। আবার বলছেন এখনই মেডিকেলে চলে আসেন। এমনকি কখনও ঢাকা, কখনও খুলনার কথা বলে বলা হচ্ছে, আপনাকে রিমান্ডে নেওয়া হবে…ইত্যাদি ইত্যাদি।’ এ কারণে শুভাকাক্সক্ষীদের পরামর্শে অপরিচিত নম্বর রিসিভ করা থেকে বিরত আছি। বর্তমানে মেয়েকে নিয়ে আমি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’ বিষয়টি গোয়েন্দা সংস্থা ও কুয়েট শিক্ষক সমিতিকে জানিয়েছেন বলে জানান সাবিনা খাতুন রিক্তা।
সাবিনা খাতুন রিক্তা ওই দিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘সেদিন (৩০ নভেম্বর) দুপুরের আগে তিনি (ড. সেলিম) আমাকে ফোনে বলেনÍ তুমি রান্না করে রেখো। ১টা ১৫মিনিটে ল্যাব আছে। কিন্তু তিনি সময়মতো বাসায় না ফিরে পৌনে ২টার দিকে ফিরে আসেন।’
সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, ‘‘তিনি (ড. সেলিম) ক্যাম্পাস থেকে ফিরে প্রথমে মেয়েকে কোলে নিয়ে আদর করতেন। কিন্তু সেদিন মেয়েকে কোলে নেননি। তার চোখমুখ ছিলো লাল। বিমর্ষ চেহারা। কী হয়েছে?- জানতে চাইলে বলেন- ‘ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। অফিসে গিয়ে হল প্রভোস্টের দায়িত্ব ছেড়ে দেবো’। আর তার চলে যাওয়ার পর থেকে মেয়ে শুধু সেই কথাই বলছে- ‘বাবা আমাকে কোলে নিলো না, আমার সঙ্গে কথাও বললো না’।’’
সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, ‘এরপর তিনি গোসলের জন্য ওয়াশরুমে যান। কিছুক্ষণ পর তার মেয়ে ওয়াশরুমের সামনে গিয়ে বাবাকে ডাকে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া মিলছিল না। পরে আমি গিয়ে ডাকাডাকি করি। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। পরে আশপাশের লোকজন ডাকি। তারা এসে ওয়াশরুমের দরজা ভেঙে দেখা যায়, তিনি অচেতন হয়ে দেওয়ালের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তাকে প্রথমে কুয়েট মেডিকেলে নেওয়া হয়। পরে সিটি মেডিকেলে। সেখানে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
রিক্তা বলেন, ‘ড. সেলিম কুয়েটের লালন শাহ হলের প্রভোস্ট ছিলেন। এ কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতারা হল ডাইনিংয়ের ম্যানেজার পদে নিজেদের লোক নির্বাচন করতে তাকে চাপ দিয়ে আসছিলো। মৃত্যুর দুইদিন আগেও ড. সেলিমকে ফোন করে কঠোর ভাষায় কথা বলেছিল ছাত্রলীগের এক নেতা।’ সাবিনা খাতুন রিক্তা বলেন, ‘মৃত্যুর ঠিক দুই দিন আগে রাত ১০টার দিকে ড. সেলিমের ফোনে কল আসে। এ সময় আমি ও আমার মেয়ে তার কাছেই ছিলাম। মোবাইল ফোনে অপর প্রান্ত থেকে খুব জোরে জোরে কথা বলা হচ্ছিলো। তার কথা শুনে ড. সেলিমের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। পরে তিনি জানানÍ ছাত্রলীগের এক নেতা হল ডাইনিংয়ের ম্যানেজারের পদের জন্য চাপ দিচ্ছে।’
স্বামীকে ‘মানসিক নির্যাতনে হত্যা করা হয়েছে’ অভিযোগ এনে আইনগত পদক্ষেপের বিষয়ে সাবিনা খাতুন রিক্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি চাই, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মামলা করুক। কিন্তু সোমবার (৬ ডিসেম্বর) কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, আমাকেই মামলা করতে হবে। তারা সব ধরণের সহযোগিতা করবে। এখন বিষয়টি পরিবারে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবো।’ সিসি ক্যামেরায় যাদের দেখা গেছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করবেন বলে জানান রিক্তা।
এ বিষয়ে কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. কাজী সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর আমরা পদক্ষেপ নেবো। কমিটির প্রতিবেদন ও সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব হবে।’ খানজাহান আলী থানার ওসি (তদন্ত) শাহরিয়ার হাসান বলেন, ‘পারিপার্শ্বিক বিষয় ও সাধারণ ডায়েরির আলোকে ড. সেলিম হোসেনের লাশ উত্তোলনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তার স্ত্রীকে হুমকির বিষয়টিও গুরুত্ব সহকারে দেখছি।’
সিসিটিভির ফুটেজ অনুযায়ী ৩০ নভেম্বর কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা ড. সেলিমকে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে প্রবেশ করে। আনুমানিক আধা ঘণ্টা শিক্ষকের কক্ষে অবস্থান করে তারা। সেখানে কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে কিছু সাধারণ ছাত্রের বিরুদ্ধে জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে। পরে ড, সেলিম ক্যাম্পাস সংলগ্ন বাসায় যান। সেখানে দুপুর ২টার দিকে ওয়াশরুমে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন, পরে মারা যান। এ ঘটনায় দুই দফা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শিক্ষক সেলিমের মৃত্যুর ঘটনায় দোষীদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ পাঁচ দফা দাবি জানিয়েছে শিক্ষক সমিতি। এছাড়াও তারা কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধেরও দাবি জানান।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৩ ডিসেম্বর প্রশাসনিক ভবনে সিন্ডিকেট সভায় ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত কুয়েট বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ওই সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ ৯ শিক্ষার্থীকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়। এছাড়াও পাঁচ সদস্যের নতুন তদন্ত কমিটি গঠন করে তদন্ত শুরু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।- রাইজিংবিডি.কম




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com