বুধবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:২৪ অপরাহ্ন

ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারগুলো

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় রবিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০২১

দেশে বিদ্যুতের মোট উৎপাদন সক্ষমতায় অবদানের দিক থেকেও এখন ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি)গুলো। গত অর্থবছরে ২ হাজার ১৮০ মেগাওয়াট নতুন বিদ্যুৎ সক্ষমতা যুক্ত হয়েছে। এর ফলে দেশে মোট বিদ্যুতের উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। সে হিসেবে গত অর্থবছরে দেশের সক্ষমতা বেড়েছে ৮ শতাংশ। এক্ষেত্রে আইপিপিগুলোই বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখায় এ সময় বিপিডিবির নিট বিদ্যুৎ উৎপাদন কমেছে ১০ শতাংশ। এর বিপরীতে আইপিপির বেড়েছে প্রায় ৩১ শতাংশ। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ম. তামিম বলেন, উৎপাদন খরচ কম এমন সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ ধরনের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সার্বক্ষণিক চালু রাখা দরকার। এক্ষেত্রে দেখা যাবে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ নেয়া কমে গিয়েছে। তবে আইপিপি থেকে সবসময় বিদ্যুৎ কেনা হবে এমন চুক্তিতেই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো নির্মাণ করা হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখলে সেখানে সরকারকে মোটা অংকের অর্থ গুনতে হয়।
নিজস্ব উৎপাদনের পাশাপাশি ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারসহ (আইপিপি) বিভিন্ন উৎস থেকে প্রতি বছর বিদ্যুৎ ক্রয় করে থাকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এ ক্রয়ের ক্ষেত্রে বর্তমানে আইপিপির ওপরেই বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ খাতের একক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। সর্বশেষ গত অর্থবছরেও (২০২০-২১) আইপিপিগুলোকে ২৮ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি অর্থ পরিশোধ করেছে বিপিডিবি, যা বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ সংস্থাটির মোট ব্যয়ের ৫৬ শতাংশ। বিদ্যুৎ ক্রয় ও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে আইপিপিগুলোকে এ অর্থ পরিশোধ করেছে বিপিডিবি। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সক্ষমতার বিচারে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারি খাতের অবদান থাকার কথা বেশি। যদিও এক্ষেত্রে বেসরকারি খাতই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখছে। বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বেশি অর্থ চলে যাচ্ছে আইপিপি খাতে। বিভিন্ন উৎসের মধ্যে আইপিপি থেকে সংগৃহীত বিদ্যুতের দামই সবচেয়ে বেশি। এতে বিদ্যুৎ ক্রয়ে সরকারের ব্যয় ও ভর্তুকিÍদুটোই বাড়ছে। তার পরও আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয় বেশ ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে চলেছে।
বিপিডিবির তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে সংস্থাটি বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ৪৯ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। এর মধ্যে আইপিপি থেকে কেনা হয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। সে হিসেবে সরকারের বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ ব্যয়কৃত অর্থের ৫৬ শতাংশেরও বেশি ব্যয় হয়েছে আইপিপিগুলোর পেছনে। আগের অর্থবছরে (২০১৯-২০) এর পরিমাণ ছিল অর্ধেকেরও কম। ওই সময় আইপিপি থেকে বিপিডিবি বিদ্যুৎ কিনেছিল ১৭ হাজার ৫১৯ কোটি টাকার।
এ সময় আইপিপি থেকে বিদ্যুতের গড় ক্রয়মূল্যও বেড়েছে। গত অর্থবছরে বিপিডিপির নিজস্ব উৎপাদনকৃত প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম ছিল ৪ টাকা ৪৬ পয়সা। আইপিপি থেকে কেনা বিদ্যুতের কিলোওয়াটপ্রতি দাম ছিল ৮ টাকা ২ পয়সা। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৭ টাকা করে। সে হিসেবে সময় আইপিপির সরবরাহকৃত বিদ্যুতের গড় দাম বেড়েছে কিলোওয়াটে ১ টাকা ২ পয়সা করে।
আইপিপি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে কেনা বিদ্যুতের মূল্য পরিশোধ করতে গিয়ে গত অর্থবছরে বিপিডিবির আর্থিক চাপ আরো বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কমমূল্যে বিক্রি করায় এমনিতেই আর্থিক চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় বিপিডিবিকে। তার ওপর আইপিপির সরবরাহকৃত বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বিপিডিবির লোকসানের বোঝাকে আরো ভারী করে তুলেছে। গত অর্থবছরে সংস্থাটিকে লোকসান গুনতে হয়েছে প্রায় সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকা। এদিকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও বেড়েছে। সে হিসেবে এবারো বিপিডিবির ভর্তুকির বোঝা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিপিডিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে এমন পরিকল্পনা থেকে আইপিপি খাতে অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হয়। যেগুলো বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। আবার কোনো কোনোটি উৎপাদনে না থাকলেও চুক্তি অনুযায়ী সেগুলোকে প্রতি বছর বসিয়ে রেখেই প্রচুর অর্থ গুনতে হয়। এসবই সামগ্রিকভাবে বিপিডিবির ব্যয়ের বোঝাকে বাড়িয়ে তোলে। শুধু বিদ্যুৎ কেনায় ব্যয় নয়, গোটা বিদ্যুৎ খাতেই আইপিপিগুলো ক্রমেই প্রভাবশালী হয়ে উঠছে। যদিও সক্ষমতার বিচারে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই এগিয়ে। দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহের মোট সক্ষমতা ২২ হাজার ৩১ মেগাওয়াট। এর মধ্যে সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ১২ হাজার ৮০১ মেগাওয়াট। আইপিপি ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের সক্ষমতা ৯ হাজার ২৩০ মেগাওয়াট। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টদের বক্তব্য হলো সরকার এখন বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি তেলনির্ভরতা কমাচ্ছে। উৎপাদন খরচ বিবেচনায় বিদ্যুৎ ক্রয়ে গুরুত্ব পাচ্ছে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো। দেশে চালু আইপিপিগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই গ্যাসভিত্তিক। এ কারণে বিদ্যুৎ ক্রয়ে আইপিপির আধিপত্য দেখা যাচ্ছে। বিদ্যুতের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, মূলত জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন কমানোয় আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনা বেড়েছে। সরকারি জ্বালানি তেলভিত্তিক অনেকগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। এগুলোর উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। এ উৎপাদন খরচ বিবেচনায় বিদ্যুৎ ক্রয়ের ক্ষেত্রে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পায়। আইপিপির আওতায় অনেকগুলো গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। তাছাড়া বিশ্ববাজারে এলএনজির দাম বাড়ায় গত অর্থবছরে আমাদের সরকারি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। কিন্তু চুক্তি অনুযায়ী আইপিপিগুলো থেকে আমাদের বিদ্যুৎ কিনতেই হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইপিপির পরিবর্তে দেশের উৎপাদন সক্ষম হয়ে ওঠা সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে ক্রয় বাড়ালে তাতে সবারই লাভ হবে বেশি। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি সরবরাহ করা হয় কম দামে। বিদ্যুতের উৎপাদন খরচও কম। অন্যদিকে আইপিপিসহ বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রে জ্বালানি ব্যয় সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় অনেক বেশি। সেখানে উৎপাদন খরচও বেশি। বিপিডিবিকেও বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বেশি মূল্য পরিশোধ করতে হয়। বিপিডিবির গত কয়েক বছরের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আইপিপি থেকে বিদ্যুৎ কেনায় সরকারের ব্যয় হয়েছিল ৮ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। পরের অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১০ হাজার ৪১০ কোটি টাকায়। এরপর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরো বেড়ে ১৫ হাজার ৭৪৮ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এ ধারা পরের দুই অর্থবছরেও অব্যাহত থাকে। সর্বশেষ গত অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকায়।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com