বাজারে শীতকালীন সবজির ভরা মৌসুম। তবু মাঝারি সাইজের একটি ফুলকপির দাম ৪০ টাকা। বাঁধাকপি ৪০ টাকা এবং টমেটোর কেজি ৮০-১০০ টাকা। ক্রেতারা জানতে চান, আর কত শীত পড়লে সবজির দাম নাগালে আসবে। ক্রেতারা বলছেন, এ সময় সবজির দাম খুব কম থাকার কথা। ফলনও ভালো। আগে তো এ সময় অবিশ্বাস্য কমদামে বিক্রি হতো শীতের সবজি। কিন্তু এ বছর ব্যতিক্রম কেন? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে মাঠে নেমেছিল দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থা। অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদনও দাখিল করা হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। তাতে বলা হয়েছে, মাঠ থেকে ক্রেতার হাত পর্যন্ত যেতে বেশ ক’বার হাতবদল হচ্ছে সবজি। সঙ্গে আছে পথের চাঁদাবাজি। নেই বাজার মনিটরিংও।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, প্রতিবেদনে সবজির দাম কমানোর উপায় খুঁজে বের করতে পাঁচটি সুপারিশ করেছেন গোয়েন্দারা। এগুলো হলো: ১। কৃষক থেকে ভোক্তা পর্যন্ত সবজি পৌঁছাতে হাতবদল কমাতে হবে। ২। পরিবহন ব্যয় কমাতে বিভিন্ন পর্যায়ে চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর নজরদারি করতে হবে।
৩। পাইকারি বাজার নিয়মিত মনিটরিংয়ের পাশাপাশি খুচরা বাজারের মূল্য তালিকা প্রস্তুত ও বাস্তবায়নে ব্যবস্থা নিতে হবে। ৪। সবজি ব্যবসায়ীদের এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি করাও জরুরি। ৫। নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যবসায়ীদের এর আওতায় এনে খুচরা বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জানা গেছে, সবজির দাম বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীরা ডিজেলের দামকেও দায়ী করছেন। তবে গোয়েন্দা অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে ভিন্ন তথ্য। গত ৩ নভেম্বর থেকে সরকার ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে বাড়িয়েছে ১৫ টাকা। ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধির খরচ পোষাতে সবজির দাম প্রতিকেজিতে বড়জোর ১১ পয়সা বাড়ার কথা থাকলেও বেড়েছে ৩৬ পয়সা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বগুড়ার মহাস্থান হাট মোকাম থেকে রাজধানীর কাওরানবাজারে পণ্য পরিবহনে প্রতি ট্রিপে যমুনা সেতুর টোল এক হাজার ৪০০ টাকা ও কাওরানবাজারে পার্কিং বাবদ দিতে হয় ৫০০ টাকা। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ মোড়, যমুনা সেতু গোলচত্বর ও টাঙ্গাইল মোড়ে ট্রাকপ্রতি হাইওয়ে পুলিশকে দিতে হয় মাসে ৫০০ টাকা করে। সাভারের আমিনবাজারে লাঠিয়াল বাহিনীকে দিতে হয় ১০০ থেকে ২০০ টাকা। পণ্য পরিবহনে বগুড়ায় পৌর টোল পরিশোধ ও চাঁদা দিতে হয় ২০০ টাকা। যদিও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কোনও পৌরসভা এ ধরনের টোল আদায় করতে পারে না। এদিকে পথে পুলিশের চাঁদাবাজিও সবজির মূল্য বৃদ্ধির কারণ। ট্রাকপ্রতি তিন পয়েন্টে পুলিশকে দিতে হয় ১৫শ টাকা। আবার কাওরানবাজার বা শ্যামবাজারে সবজি নামানোর জন্য পার্কিং খরচ গুনতে হয় ৫০০ টাকা। তথাপি, খুচরা বিক্রেতারা লাভ করেন যে যার মতো। মুনাফার এই হার কখনও দ্বিগুণ, কখনও আরও বেশি। একজন খুচরা বিক্রেতা আড়ত থেকে এক কেজি শিম ৩৫ টাকায় কিনলেও তা বিক্রি করছেন ৬০-৮০ টাকায়। বগুড়ার কৃষকরা মধ্যস্বত্বভোগীর কাছে প্রতিকেজি কাঁচামরিচ বিক্রি করেন ৪০ টাকায়। রাজধানীর পাইকাররা তা বিক্রি করেন ৫৫ টাকায়। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে সেটার দাম হয়ে যাচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। কিন্তু ওই কাঁচামরিচ কাওরানবাজার পর্যন্ত আনতে প্রতিকেজিতে খরচ হয় পাঁচ টাকা। পাইকাররা প্রতিকেজি কাঁচামরিচে আড়তের খাজনা দেন এক টাকা করে। দোকান ভাড়া বাবদ খরচ হয় আরও এক টাকা। এ হিসাবে প্রতি কেজি কাঁচামরিচের পেছনে পাইকারের মোট খরচ ৫০ টাকা।
সবজি দ্বিগুণ দামে কেন বিক্রি করেন জানতে চাইলে রাজধানীর কোনাপাড়া বাজারের সবজি বিক্রেতা মোবারক হোসেন বলেন, ‘পাইকারি বাজার থেকে সবজি নিজের দোকান পর্যন্ত আনতে পরিবহন খরচ দিতে হয়। এই কাজে নিয়োজিত কর্মচারীর বেতন দিতে হয়। দোকানের ভাড়াও আছে। আরেকটা বড় সমস্যা হলোÍপাইকারি বাজার থেকে এক পাল্লা (৫ কেজি) সবজি কিনলে মেপে পাই সর্বোচ্চ সোয়া চার কেজি। এই ঘাটতিও আমাদের মেটাতে হয়।’ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব তপন কান্তি ঘোষ জানিয়েছেন, ‘বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একাধিক সংস্থা বাজার মনিটরিং করছে। এর বাইরেও সরকারের একাধিক সংন্থা এ কাজ করছে। তবে দেশের লাখ লাখ সবজির দোকান নজরদারিতে আনা কঠিন কাজ।’