স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মানুষের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও গণতান্ত্রিক মুক্তি মেলেনি। একদিনে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি যেমন তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে সুষ্ঠু ব্যাংক ব্যবস্থাও গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সময় সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে পুঁজি জোগান দিয়েছে। মূলত খেলাপি ঋণের কারণেই এটা করতে হয়েছে। এভাবে সরকার যত পুঁজি জোগান দিয়েছে, তা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি। অর্থাৎ এখানে সম্পদ বণ্টনে বড় ধরনের অন্যায্যতা রয়েছে।
গত শুক্রবার বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ২১তম দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথি হিসেবে এসব কথা বলেন অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান। তিনি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে (আইইবি) আয়োজিত এ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতকে অর্থনীতিশাস্ত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘মুজিব স্বর্ণপদক’ দেয়া হয়। মুজিব জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে প্রদান করা এ পদক তুলে দেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ সদস্য সুফি মিজানুর রহমান ও ড. নারায়ণ চন্দ্র নাথ।
অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, বঙ্গবন্ধু মুক্তি ও স্বাধীনতার সংগ্রামের কথা বলেছেন। কিন্তু স্বাধীনতা এলেও এখনো মুক্তি মেলেনি। আমাদের রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বাজার অর্থনীতি জনগণের হাতের নাগালে আসেনি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা যায়নি। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি হয়নি। বরং একটি অন্যায্যতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষের খাসজমি দখল করছে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি হচ্ছে। সেগুলোর সুফল সাধারণ মানুষ যেভাবে পাওয়ার ন্যায্যতা রয়েছে, সেটি তারা পাচ্ছে না। যে কৃষক পণ্য-ফসল করছে, সে কিছুই পাচ্ছে না। যারা (মধ্যস্বত্বভোগী) কিছুই করছে না, তারা সুবিধা পাচ্ছে। এসব বৈষম্য দূর করতে হলে বাজার ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।
তিনি বলেন, গণতন্ত্র শুধু সংবিধানে লেখা থাকলে চলবে না। এর বাস্তব রূপ থাকতে হবে। এজন্য সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন পর্যন্ত সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। সবার অংশগ্রহণে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই। একটি গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি দাঁড় করাতে না পারলে, দুর্নীতি দূর করতে না পারলে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেও কোনো সুফল আসবে না। মানুষের স্বাস্থ্যসেবা খাতও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। জনস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। না হয় উন্নয়ন জনগণের কল্যাণ যতটা প্রত্যাশা করা হচ্ছে, ততটা করতে পারবে না।
অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত বলেন, দারিদ্র্যের ঋণের নামে অরাজকতা চলছে। ক্ষুদ্রঋণের নামে কয়েক গুণ বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে। ক্রেডিট কার্ড পদ্ধতি এবং ব্যাংকের বিভিন্ন ঋণে দেখা যায় ৫০ বা তার বেশি হারে সুদ আদায় করা হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থায় লুকোচুরি, সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। আবার ক্ষমতাবানদের খেলাপি ঋণের পরিমাণও বাড়ছে। ধনীদের সুবিধা দিতে গিয়ে গরিবদের শোষণ করা হচ্ছে। ঋণ নিয়ে মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশে চলমান মামলার ৮০ শতাংশই ভূমির মালিকানাসংক্রান্ত। আমাদের দেশের যা আয়তন, সেটি তো কোনোভাবেই বাড়বে না। মানুষ ভূমির অধিকার প্রতিষ্ঠায় এসব মামলা চালিয়ে যায়। সেটি চলতে থাকে ৪০-৪৫ বছর ধরে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। ফলে কেউ কেউ নিঃস্ব হচ্ছেন। যারা এসব মামলায় জেতেন আসলে তারাও হারেন। যিনি হারলেন তিনি তো হারলেনই। কারণ এসব মামলার খরচ জমির দামের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি হয়ে যায়। অন্যদিকে, বাধ্যতামূলক সমবায়ের কথা বলার পর বঙ্গবন্ধু বেশিদিন বেঁচে থাকেননি। কারণ আওয়ামী লীগের নেতারাই উনার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন। অনেকে অন্যের সম্পদ জবরদখল করছেন। দেশে এমন পরিস্থিতি চলছে, যা বঙ্গবন্ধু প্রণীত সংবিধানবিরোধী। এমন পরিস্থিতি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী।
দুদিনব্যাপী এ আয়োজনের প্রথম দিনে আটটি অধিবেশনে বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণাপত্র উপস্থাপন করা হয়। দেশের বিভিন্ন খাতের আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে এসব গবেষণায় উঠে আসে সরকার পদ্ধতি, সুশাসন, গণতন্ত্র ও বিভিন্ন খাতে সম্ভাবনার তথ্য। আজ সম্মেলনের সমাপনী দিনে একই স্থানে চলবে দিনব্যাপী গবেষণাপত্র উপস্থাপন ও আলোচনা। সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত বিশেষ প্লেনারি অধিবেশন, সভাপতিত্ব করবেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। বক্তা অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। প্লেনারি অধিবেশনে অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ‘কভিড-১৯ থেকে শোভন সমাজ’ শীর্ষক প্রবন্ধ উত্থাপন করবেন। বেলা সোয়া ১১টা থেকে সোয়া ১টা পর্যন্ত সংগঠনের (অভ্যন্তরীণ) সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
সম্মেলনে অর্থ পাচার, কালো টাকা, কৃষির রাজনৈতিক অর্থনীতি, পাট শিল্প, ভূমি আইন, কভিড-১৯ পরিস্থিতি, জেন্ডার সমতাসহ অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে অন্তত ৮৩টি গবেষণা প্রবন্ধ উত্থাপন করা হয়। মাঠ পর্যায়ে করা এসব গবেষণায় উঠে আসে ভূমির মালিকানায় অন্যায্যতা, মামলার জট, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বাজার বৈষম্য, গণতন্ত্র, সুশাসনের অভাবসহ ৫০ বছরে এসেও নানা অসংগতিতে ভুগতে থাকা বাংলাদেশের চিত্র। এদিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন এজেডএম সালেহ। এছাড়া আরো উপস্থিত ছিলেন ড. জামালউদ্দিন আহমেদ, অধ্যাপক ড. আবদুল বায়েস প্রমুখ।