১৯৯০ থেকে ২০১০ পর্যন্ত সময়টুকু বাদ দিয়ে স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত জাতীয় বাজেটে পরিবহন খাতে বরাদ্দের ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ পেয়েছে রেল খাত। বিশেষ করে ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় গঠনের পর রেল খাতে বরাদ্দ বাড়তে শুরু করে। চলতি অর্থবছর রেলে বরাদ্দের পরিমাণ ১৩ হাজার ৫৫৮ কোটি টাকা। পাঁচ বছর ধরে প্রায় এ হারে বরাদ্দ পেয়ে আসছে খাতটি। এসব টাকায় কেনা হয়েছে নতুন ইঞ্জিন-কোচ। বসানো হয়েছে নতুন লাইন। আধুনিকায়ন হয়েছে স্টেশন ও সিগন্যালিং ব্যবস্থার। কিন্তু যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে এসব উন্নয়নের ছাপ খুব একটা লাগেনি।
দেশে সারা বছরের মোট যাত্রী চলাচল হিসাব করতে ব্যবহার হয় প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার (পিকেএম) একক। এক্ষেত্রে দূরত্বের পরিমাণ যা-ই হোক, একজন যাত্রী যেকোনো মাধ্যমে একবারে এক কিলোমিটারের বেশি পাড়ি দিলেই তা হিসাব করা হবে এক পিকেএম হিসেবে। জাতিসংঘের ইকোনমিক অ্যান্ড সোস্যাল কমিশন ফর এশিয়া অ্যান্ড দ্য প্যাসিফিকের (ইএসসিএপি) তথ্য অনুযায়ী, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে দেশে সড়ক, রেল ও নৌপথে এমন যাত্রার সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৭০০ কোটি। এর ৩০ শতাংশ বা প্রায় ৫১০ কোটি পিকেএম ছিল রেলপথে। ২০১৯ সালে দেশে প্যাসেঞ্জার কিলোমিটার যাত্রীর সংখ্যা ছিল সাড়ে ১৯ হাজার কোটি। এর মধ্যে রেলওয়ে পরিবহন করেছে প্রায় দেড় হাজার পিকেএম, যা যাত্রার মাত্র ৮ শতাংশ। যাত্রীর মতোই রেলওয়েতে কমেছে পণ্য পরিবহন। ১৯৭৫ সালে যেখানে দেশের মোট পরিবাহিত পণ্যের ২৮ শতাংশই পরিবহন হয়েছিল রেলপথে। ২০১৯ সালে তা নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেলে গত এক দশকে মোটা অংকের বিনিয়োগ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেসব বিনিয়োগ হয়েছে বিচ্ছিন্নভাবে ও প্রকল্পকেন্দ্রিক। ফলে এসব বিনিয়োগ যাত্রী ও পরিবহনে খুব একটা পরিবর্তন আনতে পারেনি। উল্টো অনেক সময়ই তা রূপ নিয়েছে মন্দ বিনিয়োগে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ ঢাকা-চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ ৪ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হয়েছিল। যদিও লাইন আগের মতোই মিটার গেজ থেকে যায়। এ প্রকল্পের দুই অংশের বাস্তবায়ন শেষ হয় ২০১৫ ও ২০১৮ সালে। কয়েক বছর যেতে না যেতেই এখন রেলপথটি আবার ডুয়াল গেজ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এছাড়া কোটি কোটি টাকা খরচ করে রেলের ইঞ্জিন কেনা হলেও অনেকগুলোরই মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বছরের পর বছর ব্যবহার না করেই নষ্ট করা হয়েছে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ইআরপি) সরঞ্জাম। যেখানে সরকার সিদ্ধান্ত দিয়েছে পর্যায়ক্রমে দেশের মিটার গেজ রেলপথ তুলে দেয়া হবে, সেখানে কেনা হচ্ছে সাড়ে ৪০০ মিটার গেজ ওয়াগন। রেলপথ নির্মাণ ও সংস্কার, স্টেশন ভবন আধুনিকায়ন, রোলিং স্টক সংগ্রহসহ বেশির ভাগ প্রকল্পেই এমন সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের ভাষ্যমতে, গত এক দশকে রেলে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হলেও এখনো পুরনো ইঞ্জিন-কোচ, নড়বড়ে রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু, লোকবল সংকট, যাত্রীসেবায় অব্যবস্থাপনা-অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা সমস্যা রেলওয়েতে প্রকট।
বর্তমানে দেশের রেল খাতে বড় বড় বিনিয়োগ হলেও পরিকল্পনার দুর্বলতা ও অদূরদর্শীভাবে সেগুলো বাস্তবায়ন করায় মানুষ সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক সামছুল হক। তিনি বলেন, বিগত কয়েক বছরে রেলওয়েতে বড় বড় বিনিয়োগ হচ্ছে। কিন্তু সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের একটা বড় ঘাটতি আছে। কোন কাজটি আগে করতে হবে, কোনটি পরে হবে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা হচ্ছে না। রেলের আজকের এ অবস্থার জন্য প্রধানত তিনটি বিষয় দায়ী। প্রথমত, প্রতিষ্ঠান হিসেবে রেলের সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যময় যাতায়াতের জন্য সংস্থাটি এখনো উপযোগী হয়ে উঠতে পারেনি। দ্বিতীয়ত, সরকারের ভুল নীতি। অতীতের সরকারগুলো রেলের উন্নয়নের বদলে সড়কপথে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত থাকার একটা শূন্যতা রেল খাতে তৈরি হয়েছে, যা থেকে এখনো রেল বের হতে পারেনি। তৃতীয়ত, উন্নয়ন সহযোগীদের কৌশলগত ভূমিকাও রেলকে পিছিয়ে দিয়েছে। ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে তারা সড়কপথের উন্নয়নের জন্য আমাদের সহায়তা করেছে, বঞ্চিত হয়েছে রেল খাত।
তিনি আরো বলেন, এ অবস্থা থেকে রেলকে বের করে আনতে হলে যাত্রী পরিবহনের জন্য নগরকেন্দ্রিক রেল যোগাযোগ উন্নয়নে প্রাধান্য দিতে হবে। মেট্রোরেল, সাবওয়ে, লাইট রেলের মতো অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। আর পণ্য পরিবহনের জন্য দেশের সামগ্রিক রেল নেটওয়ার্ক যুগোপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে, যেন দেশের সিংহভাগ পণ্য রেলপথে পরিবহন করা সম্ভব হয়। রেলওয়েতে গত এক দশকে সমাপ্ত হয়েছে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নকাজ। বর্তমানে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪৪০ কোটি টাকার ৩৬টি উন্নয়ন প্রকল্প চলমান। এসব টাকায় নতুন রেলপথ-সেতু নির্মাণ, পুরনো রেলপথ-সেতু সংস্কার, ইঞ্জিন-কোচ সংগ্রহ ও পুনর্বাসন, সিগন্যাল ব্যবস্থাসহ প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন হচ্ছে। তার পরও জীর্ণ অবস্থা থেকে বের হতে পারছে না সংস্থাটি। তবে এসব সমস্যা যেমন একদিনে তৈরি হয়নি, তেমনি সেগুলো একদিনে তা সমাধান সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। তিনি বলেন, রেল খাত দীর্ঘদিন উন্নয়নবঞ্চিত ছিল। ২০০৯ সালের দিকে রেলের চেহারা ছিল বিবর্ণ। পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় ট্রেন, নড়বড়ে রেলপথ, ভাঙাচোরা স্টেশনÍসবখানেই ছিল দীর্ঘদিনের অনুন্নয়নের ছাপ। এখন কিন্তু এ চিত্র বদলাতে শুরু করেছে। আমরা সারা দেশের সব রেলপথকে ডাবল লাইনে উন্নীত করার উদ্যোগ নিয়েছি। যমুনা নদীতে আলাদা রেলসেতু তৈরি করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু ও ঢাকা-যশোর রেলপথসহ দেশের সব জেলায় রেল যোগাযোগ স্থাপনে আমরা কাজ করছি। আনুষঙ্গিক সব ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়নের দিকেই আমরা জোর দিচ্ছি। এগুলোর পূর্ণ সুফল তখনই পাওয়া যাবে, যখন চলমান ও পরিকল্পনাধীন কাজগুলো বাস্তবায়ন হবে। আমরা সেদিকেই এগিয়ে যাচ্ছি।
দেশে মোট যাত্রী চলাচলে রেলের ভাগ মোটে ৮ শতাংশ। যদিও স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে এ হার ছিল ৩০ শতাংশ। গত পাঁচ দশকে উন্নয়ন যাত্রায় দেশ এগিয়ে গেলেও যাত্রী পরিবহনে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। একই সঙ্গে মোট পণ্য পরিবহনে রেলের অবদান ২৮ থেকে নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। বিপুল বিনিয়োগের পরও ফেরানো যাচ্ছে না রেলের হারানো গৌরব। উল্টো প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, ভুল নীতি ও উন্নয়ন সহযোগীদের কৌশলী ভূমিকা দেশের রেলওয়ে খাতকে ক্রমেই খাদের কিনারে ঠেলে নিয়ে গিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও রেলের কর্তাব্যক্তিরা দাবি করছেন, খাতটির উন্নয়নে তাদের নেয়া মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এ চিত্র বদলে যাবে।