শনিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:২১ পূর্বাহ্ন

শুরুটা মধুর শেষে অন্য কিছু

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় বুধবার, ১২ জানুয়ারী, ২০২২

র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে মোজাম্মেল হক

ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রথমে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের বিদেশী নাগরিকেরা। এরপর গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে দেশি প্রতারকদের সহযোগিতায় জড়িয়ে পড়ছে অভিনব প্রতারণায়। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও বিপুল পরিমাণ টাকা প্রতারণায় আত্মসাৎ করতে থেকে যাচ্ছেন দেশে। প্রতারকচক্রের বিদেশি নাগরিকরা প্রথমে ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ফেসবুকে নিজেদেরকে পশ্চিমা দেশের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেয়। এরপর বিপরীত লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে। কখনো দামি উপহার, পার্সেল, অতি মূল্যবান সামগ্রীর দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বন্ধুত্ব করে মূল্যবান উপহার (পার্সেল) পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে অভিনব কায়দায় প্রতারণার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎকারী সাত বিদেশি নাগরিকসহ সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের ৯ সদস্যকে গ্রেফতারের পর এমন তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। গতকাল বুধবার (১২ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ইতোপূর্বে টাকাকে ডলারে রূপান্তরিত করা ও পার্সেল পাঠিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এবং মাদকসহ ১৫-২০ জন বিদেশি নাগরিককে গ্রেফতার করে র‌্যাব-৪।
তিনি বলেন, সম্প্রতি আমরা ফের তথ্য পাই একই কায়দায় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করে দামি উপহার পাঠানোর প্রলোভনে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও তথ্য উপাত্তের ভিত্তিতে গত ১১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১১টা থেকে আজ বুধবার সকাল ৭টা পর্যন্ত র‌্যাব-৪ এর একটি দল র‌্যাব-৮ এর সহযোগিতায় রাজধানীর পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় অভিযান চালায়। এ সময় ৮টি পাসপোর্ট, ৩১টি মোবাইল, ৩টি ল্যাপটপ, একটি চেক বই, ৩টি পেন ড্রাইভ ও নগদ ৯৫ লাখ ৮১৫ টাকাসহ ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতাররা হলেন, নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন (৪২), ইফুন্যা ভিভিয়ান নাবুইকে (৩১), সানডে শেডেরাক এজিম (৩২), চিনেদু মোসেস নাজি (৩৩৬, কলিমস ইফেসিনাছি তালিকে (৩০), চিদিম্মা এবেলে আইলোফো (২৬) ও দক্ষিণ আফ্রিকার এনটোম্বিখোনা গেবুজা (৩৬)। দেশীয় দুজন হলেন ফেনীর মো. নাহিদুল ইসলাম (৩০) ও নরসিংদীর সোনিয়া আক্তার (৩৩)।
প্রতারণার কৌশল: গ্রেফতাররা র‌্যাবের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকে নিজেদেরকে পশ্চিমা দেশের নাগরিক পরিচয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে। এক পর্যায়ে দামি উপহার বাংলাদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণার জাল ছড়ায়।
টার্গেট নির্ধারণ: প্রথমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মেয়েদের নামে ভুয়া আইডি খুলে বিভিন্ন প্রোফাইল ঘেঁটে ঘেঁটে বড় বড় ব্যবসায়ী, হাই প্রোফাইল চাকরিজীবীসহ উচ্চবিত্ত মানুষদেরকে ভিকটিম হিসেবে টার্গেট করে থাকে।
বন্ধুত্ব স্থাপন: ভিকটিম নির্ধারণের পর তাদেরকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করে। ভিকটিমদের কাছে নিজেকে পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশের সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পরিচয় দেয়। ভিকটিমকে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তার ভুয়া ছবি পাঠায় বিশ্বাস স্থাপনের জন্য। সম্পর্কের এক পর্যায়ে বিভিন্নভাবে ভিকটিমকে তার প্রতি বিশ্বাস স্থাপনে প্রলুব্ধ করে থাকে।
নিজের অসহায়ত্বের কথা প্রকাশ: বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার পর প্রতারকরা জানায় তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা রয়েছে কিন্তু তারা তা খরচ বা নিজেদের দেশে নিতে পারছে না। প্রতারকরা সেই ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রা ভিকটিমের কাছে পাঠাতে চায় এবং বলে তোমার কাছে রেখে দিও পরবর্তীতে আমি নেব। চাকরিজীবীদের বলে যে তাদের দিয়ে জনসেবামূলক কাজে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করবে এবং এতে তারা একটি নির্দিষ্ট হারে কমিশন পাবেন। আর যারা ব্যবসায়ী তাদেরকে বুঝায় যে তার ব্যবসায় অর্থ লগ্নি করবে এবং সে ৩৫ থেকে ৪৫ শতাংশ কমিশন পাবেন। এতে করে সহজ সরল মানুষ প্রলুব্ধ হয়ে তাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে প্রতারিত হয়।
উপহার প্রদান: ভিকটিমকে আকৃষ্ট করতে প্রতারক চক্রটি বিভিন্ন উপহার পাঠানোর প্রলোভন দেখায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভিকটিমের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার নাম ঠিকানা নিয়ে ছোট ছোট উপহার পাঠায়। উপহার পেয়ে ভিকটিম বিশ্বাস স্থাপন করে এবং এক পর্যায়ে প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলে আমি তোমার নামে একটি দামি পার্সেল পাঠিয়ে দিয়েছি।
অর্থ সংগ্রহ: পার্সেল পাঠানোর কিছুদিন পর তাদের এ দেশের নারী সহযোগী বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসার পরিচয়ে ভিকটিমকে ফোন করে বলে তার নামে একটি পার্সেল বিমানবন্দরে এসেছে। পার্সেলটি ডেলিভারি করতে কাস্টমস চার্জ হিসেবে মোটা অংকের টাকা বিকাশ বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বরে পরিশোধ করতে বলা হয়। যেহেতু পার্সেলে অতি মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে ও এভাবে বিদেশ থেকে কোনো পার্সেল দেশে আনা আইনসিদ্ধ নয় তাই চার্জ একটু বেশি দিতে হবে। নকল টিন সার্টিফিকেট ও অন্যান্য কাগজ বানাতে অনেক অর্থের প্রয়োজন হবে। কেউ কেউ টাকা না দিতে চাইলে তাদেরকে মামলার ভয়ভীতি দেখায়। বাংলাদেশি সহজ সরল মানুষ তাদের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে, কখনো মামলার ভয়ে সংশ্লিষ্ট বিকাশ বা ব্যাংক একাউন্টে টাকা পাঠিয়ে দেয়। এভাবে সাধারণ মানুষ প্রতারিত হয়ে আসছে।
মোজাম্মেল হক বলেন, গ্রেফতার আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকেরা ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে এসে ঢাকার পল্লবী, রূপনগর ও দক্ষিণখান এলাকায় ভাড়া বাসায় অবস্থান করে গার্মেন্টস ব্যবসা শুরু করেন। গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে তারা বাংলাদেশি সহযোগীদের নিয়ে এ অভিনব প্রতারণার সাথে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ এবং গ্রেফতার দুজনের নামে পূর্বের মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার সোনিয়া আক্তার ও নাহিদুল ইসলাম এই আন্তর্জাতিক চক্রের এ দেশীয় সহযোগী। মূলত তাদের মাধ্যমেই এই প্রতারক চক্রের বিদেশি নাগরিকরা ভিকটিম সংগ্রহ, বন্ধুত্ব স্থাপন, কাস্টমস অফিসার পরিচয় এবং শেষে অর্থ সংগ্রহ করে আসছিল। গ্রেফতার নাইজেরিয়ান উদেজে ওবিন্না রুবেন গত ২০১৭ সালে ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসে এবং ২০২০ সালে তার নামে র‌্যাব-৪ কর্তৃক প্রতারণার মামলা হওয়ায় তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয়। সে নিজেকে একজন গার্মেন্টস ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে প্রতারণাই তার মূল পেশা। তিনি এই আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের প্রধান। দক্ষিণ আফ্রিকান এনটোম্বিখোনা গেবুজা ২০২০ সালের গত ১৫ জানুয়ারি ভ্রমণ ভিসায় বাংলাদেশে আসেন। তার ভিসার মেয়াদ এ বছরের জুন পর্যন্ত। তিনি নিজেকে রুবেনের স্ত্রী বলে পরিচয় দেন।
গ্রেফতার নাহিদুল ২০০৮ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে একটি ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্ট ও একটি কল সেন্টারে কাজ করেন। ২০১৭ সালে ফ্যাশন ডিজাইন বিষয়ে ডিপ্লোমা করে ২০১৮ সালে মালয়েশিয়া গিয়ে ২০২১ সালে দেশে ফিরে আসেন। তিনি গ্রেফতার হওয়া সোনিয়া আক্তারের স্বামী। গ্রেফতার সোনিয়া ২০০৬ সালে ঢাকার একটি স্কুল থেকে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত একটি অ্যাম্বাসিতে ২৫ হাজার টাকা বেতনে চুক্তিতে চাকরিও করেন। ২০১৮ সালের শেষের দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয়ের মাধ্যমেই তিনি এই প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। প্রতারণার কাজে সহযোগিতার জন্য রুবেন ভিকটিম প্রতি প্রতারণার ২৫ শতাংশ অর্থ সোনিয়াকে দিতেন। সোনিয়ার নিজের নামে দক্ষিণখানে একটি চারতলা বাড়ি ও একটি প্রাইভেটকার রয়েছে। সোনিয়া ও নাহিদুল নাইজেরিয়ান নাগরিক রুবেনের সঙ্গে উত্তরার জসিমউদ্দীন এলাকায় মাসে ও সপ্তাহে ২/৩ বার দেখা করতেন। গত এক বছরে ৩০ থেকে ৩৫ জন ভিকটিমকে প্রতারিত করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন বলে তিনি র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com