একান্ত সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন
ড. কামাল হোসেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ। সভাপতি, গণফোরাম। সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী। জন্ম বরিশালের শায়েস্তাবাদে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতাদের অন্যতম। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭২-এর ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাকেও মুক্তি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবের সঙ্গে ১০ জানুয়ারি লন্ডন হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে বরাবরই সোচ্চার এই রাজনীতিক।
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর চলমান সংলাপ ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন প্রসঙ্গ নিয়ে ড. কামাল এক একটি নিউজ পোর্টালের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে বলেছন, তবে চলমান সংলাপ নিয়ে আমি আশাবাদী না। কারণ এ সংলাপ আন্তরিক তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকারের আচরণে বিশেষত কোনো পরিবর্তন আসেনি যাতে মানুষ সংলাপে আস্থা পাবে। আলোচনার মধ্য দিয়েই রাজনীতির চলমান সংকট নিরসন করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারের আন্তরিকতার ওপরই সব নির্ভর করছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু। জাগোনিউজ২৪.কম-এর সৌজন্যে সাক্ষাৎকারটি দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।
প্রশ্ন: আপনি আবারও জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং এই ঐক্য গড়ার প্রচেষ্টা বহুদিনের। এখনকার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কী বলবেন?
ড. কামাল হোসেন: একটি মহান উদ্দেশ্য নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করা হয়েছিল। আমরা জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। বঙ্গবন্ধুর সারাজীবন কেটেছে মানুষের ভোট আর ভাতের অধিকারের আন্দোলন নিয়ে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশ তার গতি হারায়। সেই হারানো পথেই আছে দেশ ও দেশের মানুষ। সরকারগুলো মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে গণতন্ত্রের কথা বলে। মানুষ ভোট দিতে পারে না। ভোট রাতেই হয়ে যাচ্ছে। অথচ প্রশাসন রাষ্ট্রের মালিক জনগণের পাহারাদার। আজ পাহারাদাররাই মালিক হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন: এই অধিকার প্রতিষ্ঠা কতটুকু সহজ মনে করছেন?
ড. কামাল হোসেন: কোনোভাবেই সহজ নয়। অত্যন্ত কঠিন এ পথ। মানুষকে পরিকল্পিতভাবে বিপথে নিয়ে যাওয়া হয়েছে নানা আদর্শ আর চেতনার কথা বলে। এভাবেই মানুষকে ভুলিয়ে রাখা হয়েছে। কঠিন জেনেও আমি বারবার জাতীয় ঐক্যের কথা বলছি। বলতেই হবে। আমি না বললে অন্যজন বলবে। মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এটি।
প্রশ্ন: গত নির্বাচনের আগে বিরোধী জোটে নেতৃত্ব দিয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলেন। পরিবর্তন আসেনি। আপনার প্রচেষ্টাকে ব্যর্থ বলা যায় কি না?
ড. কামাল হোসেন: হ্যাঁ। আপনি আমার প্রচেষ্টাকে অবশ্যই ব্যর্থ বলতে পারেন। দৃশ্যমান কোনো সফলতা না এলে ব্যর্থতাকেই সামনে আনতে হয়। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি বলে শেষ হয়ে যাইনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চেষ্টা করবো, বাঙালি জাতির মধ্যকার ঐক্য প্রতিষ্ঠায়। মৃত্যুর পর অন্য কেউ চেষ্টা করবে। মানুষ তো এই অবস্থার মুক্তি চায়। তাহলে কেউ না কেউ এগিয়ে আসবে। আমি আশাবাদী মানুষ। হতাশ হলে মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। আমি তরুণদের ওপর ভরসা করি। তরুণরাই পথ দেখাবে। আপনি যদি গত ক’বছরের কয়েকটি আন্দোলনের কথা সামনে আনেন, দেখবেন তরুণরাই সফল হয়েছে। নিরাপদ সড়কের দাবি আর কোটাবিরোধী আন্দোলনে তরুণ শিক্ষার্থীদের অর্জন অভাবনীয়। রাজনীতি নিয়েও তরুণরা সফল হবে।
প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতি সংলাপের আয়োজন করছেন। কেমন দেখছেন এই আয়োজনকে?
ড. কামাল হোসেন: আমি যে কোনো আলোচনাকে সাধুবাদ জানাই। আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান আসবে। সমাধান কোনো সময় ধরে আসে না। একবার আলোচনায় সমাধান না হলে বারবার আলোচনা হতে পারে। শত বিরোধ থাকার পরেও আলোচনার টেবিলে বসা মানে সমাধানের পথ বের হবেই এবং এটিই রাজনৈতিক পদ্ধতি।
তবে চলমান সংলাপ নিয়ে আমি আশাবাদী না। কারণ এই সংলাপ আন্তরিক তা মনে করার কোনো কারণ নেই। সরকারের আচরণে বিশেষত কোনো পরিবর্তন আসেনি, যাতে মানুষ সংলাপে আস্থা পাবে।
প্রশ্ন: আপনার দলও সংলাপে অংশ নিয়েছে। কী প্রস্তাব রাখলো?
ড. কামাল হোসেন: আমাদের দলের প্রতিনিধিরা মূলত নির্বাচন কমিশনের প্রতি জনমানুষের যে অনাস্থা তা নিয়ে আলোচনা করেছে এবং এই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য রাষ্ট্রপতির প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
প্রশ্ন: নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনে আইনের পরিবর্তনের কথা বলছে কেউ কেউ। আপনি কী মনে করেন?
ড. কামাল হোসেন: আইন শতবার পরিবর্তন হতে পারে জনগণের দাবি ও চাহিদার ভিত্তিতে। জনগণ চাইলে এ নিয়ে অবশ্যই সংলাপের প্রয়োজন রাখে। কী আইন হতে পারে তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এবং আইনজ্ঞদের সঙ্গে সরকার আলোচনা করতে পারে।
প্রশ্ন: আইন তো রয়েছে। পরিবর্তন হলেই কী সমাধান?
ড. কামাল হোসেন: না, আইনের পরিবর্তন হলেই সমাধান আসবে আমি তা মনে করি না। সমাধানের জন্য সবার আগে সরকারের আন্তরিকতার দরকার। দেশে আইনের অভাব নেই। সব বিষয়েই ভালো আইন রয়েছে। উৎকৃষ্ট মানের সংবিধান রয়েছে। তবুও কেন এত অসঙ্গতি? তার মানে আইনের শাসন নেই। দুঃশাসন চললে আইন সর্বত্রই চাপা পড়ে যায়। এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি না হলে দেশ আরও বিপদে পড়বে। কেউ রক্ষা পাবো না। সরকারকেও এটি অনুধাবন করতে হবে। আর সবকিছু নির্ভর করছে মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামের ওপর।
প্রশ্ন: কোন ধরনের আন্দোলনের কথা বলছেন?
ড. কামাল হোসেন: আমরা একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি। এটি চলমান প্রক্রিয়া। মুক্তিযুদ্ধ থেকে মানুষ তার চেতনার অধিকার নিয়ে শিক্ষা নিয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর যতটুকু অর্জন তা আন্দোলনের মাধ্যমেই। আমি এখনো তাই বিশ্বাস করি তরুণ-উদ্যমীরা নেতৃত্বে এলেই সফলতা আসবে। জনমানুষ তাতে শামিল হবে।