নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচন ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে আজ রোববার (১৬ জানুয়ারি)। টান টানা উত্তেজনার মধ্য দিয়ে শুক্রবার মধ্যরাতে শেষ হয়েছে সকল নির্বাচনী প্রচার প্রচারণা। কার্যকর হয়েছে যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা। ভোটের বাকি মাত্র এক দিন। রাজধানীর পাশ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ এ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন ঘিরে শেষ মুহূর্তে চলছে নানা সমীকরণ। গত শুক্রবার (১৪ জানুয়ারি) সারাদিন শেষ মুহূর্তে প্রচারণার ব্যস্ত সময় পার করেছেন মেয়র, কাউন্সিলর, সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থীরা। সকাল থেকেই প্রার্থী ও সমর্থকদের প্রচারণা ও পদচারণায় মুখরিত ছিল নারায়ণগঞ্জ শহর। ভোটারদের কাছে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরতে একের পর এক শো-ডাউন করেছেন তারা ।
ইসির যুগ্ম-সচিব ও পরিচালক (জনসংযোগ) এসএম আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, শুক্রবার ১৪ জানুয়ারি রাত ১২টা থেকে ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া শনিবার (১৫ জানুয়ারি) রাত ১২টা থেকে ১৬ জানুয়ারি মধ্যরাত পর্যন্ত ট্রাক ও পিক আপ চলাচল বন্ধ থাকবে।
নারায়ণগঞ্জ সিটির বিগত দুটি নির্বাচনে ভোটারদের মধ্যে এত উৎসাহ- উদ্দীপনা দেখা যায়নি। জয়ের জন্য প্রতিনিয়ত নিজেদের মতো করে কৌশল নিয়ে এগোচ্ছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকার। ভোটারদের মন জয়ে দিচ্ছেন নানা প্রতিশ্রুতি। নির্বাচনে মেয়র পদে জয়-পরাজয়ে নিয়ামক বা ফ্যাক্টর কারা হবেন, তা নিয়ে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। প্রার্থীর যোগ্যতা-অযোগ্যতা নাকি দলীয় প্রতীক, নারী নাকি নতুন ভোটারÍকারা নির্ধারণ করবেন নগরপিতা-নগর জুড়ে এমনই আলোচনাই সবার মধ্যে।
নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিন উৎসবের নগরীতে পরিণত হয় নারায়ণগঞ্জ। বিকেলে শহরের দুই নম্বর রেলগেট এলাকায় চলিয়েছেন আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী পথসভা। সেখানে দল থেকে তাকে সমর্থন জানাতে উপস্থিত হয়েছে জাতীয়, স্থানীয় ও তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। একইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে সমর্থকের ঢল। ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীর পথসভা জনস্রোতে পরিণত হয়। এ সময় নারায়ণগঞ্জ শহরের যানচলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। জনসভা শেষে সেই জনস্রোত নিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহরে বিশাল শো-ডাউন করেন আইভী। বন্দরে শো-ডাউন করেন হাতি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এড. তৈমুর আলম খন্দকার। কর্মী সমর্থকদের নিয়ে তিনিও যেন নেমেছেন নিজের শক্তি প্রদর্শনে। গাড়িতে চড়ে নেতাকর্মীদের বহর নিয়ে বন্দরের বিভিন্ন এলাকার শো-ডাউন করেন তিনি।
প্রচারণার শেষ দিন সকালে হাজার নেতাকর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে শহরে শো-ডাউন করেন ইসলামী আন্দোলনের মনোনীত প্রার্থী মাওলানা মাসুম বিল্লাহ। শহরের ডিআইটি মসজিদের সামনে থেকে দলীয় প্রতীক হাতপাখা হাতে নিয়ে শহরে মিছিল করেন তারা। জুম্মার পর একই স্থান থেকে ছয় থেকে সাতশ নেতাকর্মী ও সমর্থক নিয়ে শো-ডাউন করেন খেলাফত মজলিশের প্রার্থী এ বি এম সিরাজুল মামুন। দলীয় প্রতীক দেয়ালঘড়ি নিয়ে তারা শহর প্রদক্ষিণ করেন।
নির্বাচনের সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জায়েদুল আলম শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে জানান,মোট ১৯২টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে ৩০টিকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সব কেন্দ্রেই মোবাইল টিম, স্ট্রাইকিং ফোর্স প্রস্তুত থাকবে। এছাড়া পুলিশের বিশেষায়িত যেসব ব্যাটালিয়ন আছে, তারাও মোতায়েন থাকবে। পাশাপাশি প্রতিটি ওয়ার্ডে বিজিবির টিম মোতায়েন থাকবে।
জায়েদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমি আপনাদের মাধ্যমে বলতে চাই, নির্বাচন ঘিরে কোনো প্রার্থীর নেতাকর্মী বা সমর্থকদের গ্রেপ্তার বা কোনো ধরনের হয়রানি করা হয়নি। আমরা শুধু রুটিন ওয়ার্ক হিসেবে কাজ করছি। যারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি বা অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত এবং যাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, শুধু তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে অথবা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। নির্বাচনের পরিবেশ বজায় থাকবে এবং কোনো ধরনের বিশৃঙ্খল ঘটনা ঘটবে না বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি। উল্লেখ্য, নারায়ণগঞ্জ সিটিতে ২৭টি ওয়ার্ডের ১৯২টি কেন্দ্রের ১ হাজার ৩৩৩ ভোটকক্ষে চলবে ভোটগ্রহণ। পাঁচ লাখ ১৭ হাজার ৩৬১ জন ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পাবেন। নির্বাচনে মেয়র পদে ৬ জন, সাধারণ ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে ১৪৫ জন ও সংরক্ষিত নারী ওয়ার্ডে ৩৪ জনসহ মোট ১৮৯ প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন।
মেয়র পদে ৬ প্রার্থী হলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মো. মাছুম বিল্লাহ, খেলাফত মজলিসের এবিএম সিরাজুল মামুন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মো. জসীম উদ্দিন, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির মো. রাশেদ ফেরদৌস, আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। ২০১১ সালে সিটি কর্পোরেশন হিসেবে যাত্রা শুরুর পর তৃতীয়বারের মতো এই সিটিতে নির্বাচন হতে যাচ্ছে। গত ৩০ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে কমিশন।
ভোট চুরির জন্যই সিসি ক্যামেরা সরানোর নির্দেশ দিয়েছে ইসি: নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে হঠকারিতা ও ভোট চুরি করার জন্যই কেন্দ্রগুলোতে থাকা সিসি ক্যামেরা সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বতন্ত্র মেয়রপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জের প্রতিটি স্কুলে সিসি ক্যামেরা দিয়েছেন। অথচ ভোটকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশন থেকে বলা হয়েছে, সব সিসি ক্যামেরা সরিয়ে নিতে। হঠকারিতা, ভোট চুরি, আমার নেতাকর্মীদের ওপর হামলা ও পুলিশি নির্যাতনের জন্যই সিসি ক্যামরা তুলে নেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ গত বৃহস্পতিবার (১৪ জানুয়ারি) রাত ১০টায় তার বাসভবনে জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডেকে এসব কথা বলেন তৈমূর আলম খন্দকার।
পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করে তৈমূর আলম বলেন, রেশমা নামের একটা মেয়েকে পোস্টার লাগনোর সময় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। স্বপন নামের একজনকেও ধরে নিয়ে গেছে। এছাড়া মহানগর যুবদলের সাবেক সভাপতি জসিমের বাড়িতে তালা ভেঙে তাকে ধরতে গিয়েছিল। তিনি এক ছাদ থেকে আরেক ছাদে লাফ দিতে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেছেন। পুলিশ অধিকাংশ নেতাকর্মীর বাড়িতে তল্লাশির নামে গিয়ে ভয়ভীতি ও হয়রানি করছে।
তিনি বলেন, আজ সর্বশেষ বন্দরে নির্বাচনী প্রচারণা করতে গিয়েছি, আমার সাথে কোনো বহিরাগত লোক ছিল না। সবাই ছিল নারায়ণগঞ্জের ভোটার। অথচ সেখানে আমার প্রতিদ্বন্দ্বি যখন প্রচারণায় গিয়েছেন, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বাইরের মেহমানরা। আমরা এখন খুব আতঙ্কের মধ্যে আছি।
তৈমূর বলেন, শুনেছি কেন্দ্রে একজন অপারেটর দেয়া হবে, মেশিনে কোন সমস্যা হলে ঠিক করার জন্য। তবে সেই অপারেটর যা করুক আমাদের এজেন্ট এর সামনে করতে হবে। আমাদের এজেন্ট এবং নেতাকর্মীরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তারা কেন্দ্র ছেড়ে যাবে না। কিন্তু নির্বাচন কমিশনকে এজেন্ট বের করে দেয়া হবে না এবং তাদের ওপর কোন আক্রমণ হবে না সে নিশ্চয়তা দিতে হবে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন কেন্দ্রে লোক সেট করা হয়ে গেছে, জয় তাদের পক্ষে নেয়ার জন্য। নারায়ণগঞ্জের সার্কিট হাউজসহ সব জায়গায় এখন বহিরাগত লোক দিয়ে ভরা। তারা উস্কানিমূলক কাজ এবং বক্তব্য দেয়ার জন্য আসছে। ভোটের দিনে তাদের কোনো কাজ নেই। তারা যেন রাস্তাঘাটে চলাফেরা করতে না পারে। এছাড়া ভোটার ছাড়া যারা রাস্তায় চলাফেরা করবে, তারা যেন আইডি কার্ড ব্যবহার করে। আইডি কার্ডের বাইরে কোনো বহিরাগত লোক যেন নির্বাচনের দিন নারায়ণঞ্জে প্রবেশ করতে না পারে, সেজন্য আমি প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ভোটের দিনের রেজাল্ট নিয়ে তিনি বলেন, ভোটের দিনে এক কেন্দ্রে ৫-৭ টা করে বুথ থাকতে পারে। ভোট শেষ হওয়া মাত্রই আমদের এজেন্টের উপস্থিতিতে গণনা করে প্রিন্ট দিতে হবে।