নিয়ম না মেনে তৈরি হওয়া ভবন একদিকে যেমন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তেমনি শহরগুলোকে অপরিকল্পিত করতেও রাখছে বড় ভূমিকা। অনুমোদন নেয়া হয়েছে সাততলা ভবনের। কিন্তু তৈরি করা হয়েছে ১০ তলা ভবন। ঘটনাটি পুরান ঢাকার একটি ভবনের। পরে অবশ্য রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) ভ্রাম্যমাণ আদালত গিয়ে ভবনটির সাততলার ওপরের সিঁড়ি ভেঙে দেয়। অন্যদিকে ঢাকার মহাখালীর একটি ভবনে গ্যারেজের অনুমোদন নিয়ে গড়ে তোলা হয় শপিংমল। গত সপ্তাহে অভিযান চালিয়ে শপিংমলটি বন্ধ করে দিয়েছে রাজউক। শুধু অনুমোদিত নকশার চেয়ে বেশি উচ্চতা কিংবা একশ্রেণীর ভবনের অনুমোদন নিয়ে আরেক শ্রেণীর ভবন নির্মাণই নয়, ভবন তৈরির প্রায় প্রতিটি ধাপেই ঘটছে নিয়মের ব্যত্যয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশের শহরাঞ্চলের নির্মাণ করা ও নির্মাণাধীন ৬৬ শতাংশ ভবনই তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে।
গত বছরের নভেম্বরে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, কক্সবাজার, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে গড়ে তোলা ও নির্মাণাধীন ২ হাজার ৬৪৮টি ভবনে অভিযান পরিচালনা করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিভিন্ন দপ্তর ও সংস্থা। অভিযানে ১ হাজার ৫৮১টি বা প্রায় ৬০ শতাংশ ভবনেই নিয়মের ব্যত্যয় পেয়েছে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো।
সবচেয়ে বেশি নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেছে রাজউকের অধিভুক্ত এলাকায়। নভেম্বরে রাজউকের ২ হাজার ৫৯টি ভবনে অভিযান পরিচালিত হয়। এর মধ্যে ২৪২টি ছিল নির্মিত ভবন। বাকি ১ হাজার ৬১৬টি ভবন নির্মাণাধীন। নির্মাণ হয়ে যাওয়া ২৪২টি ভবনের ১৫৯টিতেই ঘটেছে নিয়মের ব্যত্যয়। অন্যদিকে নির্মাণাধীন ১ হাজার ১৮০টি ভবনেও নিয়মের ব্যত্যয় পেয়েছে রাজউকের পরিদর্শক দল। এর মধ্যে উচ্ছেদ করা হয়েছে ৫৭টি ভবন। আরো ১ হাজার ৪৪টি ভবনের মালিককে নোটিস দিয়েছে সংস্থাটি।
ঢাকায় ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে কোন অনিয়মগুলো বেশি হয়, জানতে চাইলে রাজউকের জোন-৩-এর ইমারত পরিদর্শক ইমরান হোসেন বলেন, আমরা সবচেয়ে বেশি অনিয়ম পাই ভবনের উচ্চতায়। নকশায় যত তলা ভবন তৈরির উল্লেখ থাকে, পরিদর্শনে অনেক ক্ষেত্রেই আমরা তার চেয়ে বেশি তলার ভবন দেখতে পাই। এর বাইরে ভবনের নকশায় চারপাশে যতটা জায়গা ফাঁকা রাখার উল্লেখ আছে, তাও আমরা যথাযথভাবে পাই না। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ভবনের নিচের তলা ঠিক থাকলেও উপরের তলাগুলোতে নকশার ব্যত্যয় হয়েছে। ভবন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও অনিয়ম হয়। আবাসিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে বাণিজ্যিক ভবন তৈরি হয়। বাড়ি বানানোর অনুমোদন নিয়ে বানানো হয় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
ভবন তৈরিতে নিয়মের ব্যত্যয় হলে তার প্রভাব কেমন হয়, জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনিয়ম করে তৈরি করা ভবনের যতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি নগর পরিকল্পনার পরিপন্থী। একজন মালিক যখন ভবন তৈরি করেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখি তিনি ভবনটিতে নির্মাণ সামগ্রীর মানে তেমন ছাড় দেন না। কিন্তু নকশার বাইরে ভবন তৈরি করে কিংবা একশ্রেণীর ভবনের অনুমোদন নিয়ে আরেক শ্রেণীর ভবন যারা তৈরি করেন, তারা একটি অপরিকল্পিত শহর তৈরি করছেন। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা ভবনগুলো হয়ে ওঠে অস্বাস্থ্যকর। অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি থাকে বেশি। আবার কোনো ধরনের দুর্ঘটনায় সঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে এসব ভবন পর্যন্তই পৌঁছতে পারে না উদ্ধারকারী বাহিনী।
নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, দেশের অন্যান্য শহরেও গড়ে উঠছে ভবন। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, গত বছরের নভেম্বরে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (চউক) ইমারত পরিদর্শক ও অথরাইজ কর্মকর্তারা সব মিলিয়ে ২১৭টি ভবন পরিদর্শন করেন। এর মধ্যে ৬২টি ভবনে বিভিন্ন অনিয়ম পেয়েছেন তারা। ইমারত নির্মাণ আইন অনুযায়ী, এ ৬২টি ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে চউক। এছাড়া ১২টি ভবনকে নকশা প্রদর্শনের জন্য নোটিস দেয়া হয়েছে। ব্যত্যয়কৃত ভবনের ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ উচ্ছেদ/অপসারণ করেছে সংস্থাটি।
একইভাবে খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (খুউক) ২০২১ সালের নভেম্বরে ১৪৯টি ভবন পরিদর্শন করে ৮০টি নিয়মের ব্যত্যয় পায়। কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ১০৩টি ভবন পরিদর্শন করে
৭০টিতে নিয়মের ব্যত্যয় পায়। রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউক) ৬৭টি ভবন পরিদর্শন করে ১৭টিতে নিয়মের ব্যত্যয় পায়। জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ (জাগৃক) ৫৩টি ভবন পরিদর্শন করে ১৩টিতে নিয়মের ব্যত্যয় পায়।
ভবন নির্মাণের এসব নিয়মের ব্যত্যয়ের পেছনে ভবন মালিকদের দায়ী করছেন ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা সংস্থা রাজউকের চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, ভবন মালিকদের একটা বড় অংশই কিন্তু দেশের উচ্চবিত্ত এবং শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষ। এ শিক্ষিত মানুষরাই ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে নিয়ম মানছেন না। আইন ভাঙছেন। আমরা প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও অভিযান পরিচালনা করছি। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে তৈরি করা ভবনগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু সংস্থা হিসেবে তো আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। পরিকল্পিত শহর গড়ে তুলতে ভবন তৈরির সময় মালিকদের প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ এবং সর্বোচ্চ সচেতনতা অবলম্বনের অনুরোধ করেন তিনি।