জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিবেদন
‘বাংলাদেশ: শকস, এগ্রিকালচারাল লাইভলিহুড অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি মনিটরিং রিপোর্ট ২০২২’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে এফএওর এ পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে করোনা সঙ্কটকালে বাংলাদেশের কৃষকদের নানান সমস্যা ও সঙ্কট। গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে সারা দেশের প্রায় ৩ হাজার ৭১৬ কৃষক ও সংশ্লিষ্ট খানার তথ্যের ভিত্তিতে। গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসে এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) পর্যবেক্ষণে উল্লেখ্য করা হয়েছে, আত্মবিশ্বাসের সংকট ও দুশ্চিন্তা নিয়েই শস্য উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন দেশের কৃষক। কভিডকালে এ সংকট তাদের মধ্যে আরো প্রকট হয়ে উঠেছে। দেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে শস্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে বেশি। উৎপাদন বাড়ানোর প্রত্যাশা থাকে কৃষকেরও। কিন্তু এ প্রত্যাশাও কোনো ধরনের আত্মবিশ্বাস তৈরি করতে পারছে না অধিকাংশ কৃষকের মধ্যে। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎপাদন হ্রাসের আশঙ্কাই মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। আবার উৎপাদন বাড়লেও এর ন্যায্যমূল্য পাওয়া যাবে কিনা বা বাড়তি ফসল ঘরে তোলা যাবে কিনা, সে বিষয়গুলো নিয়েও দুশ্চিন্তায় থাকেন অধিকাংশ কৃষক।
শস্য উৎপাদন ও এর মুনাফা নিয়ে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান দেশের কৃষকের আত্মবিশ্বাসে বড় ধরনের চিড় ধরিয়েছে। এফএওর তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৩ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, চলতি বছর তাদের শস্য উৎপাদনে কোনো পরিবর্তন আসবে না। নানা মাত্রায় উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি কৃষক। ৩২ শতাংশ কৃষকের আশঙ্কা, তাদের উৎপাদন ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। ২ শতাংশ কৃষক আশঙ্কা করছেন, তাদের শস্য উৎপাদন কমতে পারে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। ফলে সব মিলিয়ে শস্য উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন ৩৬ শতাংশ কৃষক। আবার কোনো ধরনের উৎপাদন প্রত্যাশা করেন না এমন কৃষকের সংখ্যা কম নয়। দেশের ৫ শতাংশ কৃষক মনে করেন, তারা এবার উৎপাদনবি ত হতে পারেন। সব মিলিয়ে দেশের ৭৪ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, তাদের উৎপাদন এবার কোনোভাবেই বাড়বে না।
উৎপাদন নিয়ে কৃষকের এ মনোভাবের সঙ্গে জাতীয়ভাবে শস্যের উৎপাদন বৃদ্ধির সংগতি খুঁজে পাচ্ছে এফএও। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে শস্য বেড়েছে মাত্র ৫ শতাংশ। যদিও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রাক্কলন অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে শস্য ও শাকসবজি খাতের প্রবৃদ্ধি দশমিক ৫৮ শতাংশ।
জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গেও শস্য উৎপাদন খাতের বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষায়ও উঠে এসেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ভিত্তিমূল্যে শস্য ও শাকসবজি খাতে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা ছিল ২ দশমিক ৫ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে এর আশপাশেই ঘুরপাক খেয়েছে শস্য ও শাকসবজির উৎপাদন প্রবৃদ্ধি, যা কভিডকালে আরো নিচে নেমে এসেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের এ উৎপাদন প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয়েছে দশমিক ৫৮ শতাংশ। কৃষির এ উপখাতে প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে আসার পেছনে প্রধানত কৃষককে যথাসময়ে ও সঠিক মানের বীজ না দিতে পারা, শস্যের ন্যায্যমূল্য দিতে না পারা, দেশে খাদ্যশস্যের উৎপাদন ভালো হলেও কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিতের বদলে আমদানি অবারিত করে রাখা, কৃষি উপকরণ সুবিধার অভাব ইত্যাদি বিষয়কে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা।
তারা বলছেন, কৃষককে ন্যায্যমূল্য না দেয়ার পাশাপাশি বিপণন ও বাণিজ্যনীতিকে কৃষকের পুরোপুরি অনুকূলে আনা হচ্ছে না। তবে কৃষিতে এমন নানাবিধ সংকট সত্ত্বেও অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তনের জমি, উন্নত বীজ ও প্রযুক্তির অভাব মোকাবেলা করেই কৃষককে এগিয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি কৃষকের জ্ঞানের স্বল্পতা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকিও মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণে জোর দিতে হবে। সেজন্য উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষককে আরো বেশি গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। এছাড়া শস্য খাতের প্রথাগত প্রতিবন্ধকতা ছাড়াও পোস্ট-হারভেস্ট লস বা ফসলোত্তর ক্ষতি, উন্নত কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে যন্ত্রাংশের অভাব, দুর্বল বিপণন ও গুদামজাতের ব্যবস্থা এবং অপচয় কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিলে কৃষকের আত্মবিশ্বাস ফিরে আসবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন ফসলের স্বল্পমেয়াদি জাতসহ ঘাতসহিষ্ণু, বিশেষ করে খরা, বন্যা এমনকি লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া কৃষিবিষয়ক সংস্থাগুলোর কার্যক্রমে সমন্বয় করা প্রয়োজন, যাতে কৃষকরা দ্রুত এসব সংস্থার কাছ থেকে সেবা নিতে পারেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. এমএ সাত্তার মন্ডল বলেন, দেশের কৃষকের মধ্যে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা প্রবলভাবে তৈরি হয়েছে। সরকারের নানা ধরনের চেষ্টা রয়েছে কৃষকদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার। তবে সেখানে কৃষককে কোনোভাবেই ভারাক্রান্ত করে রাখা যাবে না। কৃষকের আত্মবিশ্বাসের মাত্রাটা আসলে নির্ভর করবে কখন কী পরিস্থিতি এবং কীভাবে কৃষকের সাক্ষাৎকার নেয়া হচ্ছে। তবে হ্যাঁ এটা সত্য, যাদের আয় কেবল শস্য আবাদের ওপর নির্ভরশীল তারাই সবচেয়ে বেশি সংকটে থাকেন। এছাড়া ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকরা এর পরই ঝুঁকিতে থাকেন। ফলে এ দুই শ্রেণীর কৃষকদের আত্মবিশ্বাস এমনিতেই কম। কৃষক কী চান সেটি বুঝতে হবে নীতিনির্ধারকদের। সে অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
এফএওর তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে শস্য উৎপাদন ৫-২০ শতাংশ বাড়তে পারে এমন প্রত্যাশা করছেন ২৩ শতাংশ কৃষক। ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়ার প্রত্যাশা করছেন ২ শতাংশ কৃষক। ১ শতাংশ কৃষক মনে করছেন, উৎপাদন বাড়তে পারে ৫০ শতাংশের বেশি।
এছাড়া চলতি বছরে গত বছরের তুলনায় উৎপাদন বেশি মাত্রায় হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা বরিশাল ও খুলনা অ লের কৃষকদের মধ্যে বেশি। অন্যদিকে উৎপাদন আগের বছরের মতোই থাকার সম্ভাবনা বেশি দেখতে পাচ্ছেন চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের কৃষকরা। পরিবেশগত ঝুঁকি ও অন্যান্য ক্ষতির কারণে একেবারেই উৎপাদন না হওয়ার আশঙ্কা সিলেট ও ঢাকা বিভাগের কৃষকদের বেশি। অন্যদিকে উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি বাড়ার সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন ময়মনসিংহ বিভাগের কৃষকরা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজীর আলম বলেন, কৃষকের আত্মবিশ্বাসটা ধরে রেখে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ানোই আমাদের প্রধান কাজ। সেটি সঠিকভাবে করতে পারার কারণেই খাদ্যশস্যসহ সব ধরনের কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়ছে। কৃষকের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য আমরা তাদের কাছে সঠিক সময়ে সঠিক তথ্যের পাশাপাশি নানা ধরনের প্রযুক্তি ও সরকারের সুবিধাগুলো পৌঁছে দিচ্ছি। প্রদর্শনীর মাধ্যমে নতুন প্রযুক্তির বিষয়ে কৃষকের আস্থা আনছি। সেটি দেখেই তারা নতুন প্রযুক্তি গ্রহণের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছেন। কৃষকের জন্য সহায়ক সব ধরনের প্রযুক্তি দ্রুততার সঙ্গে তাদের কাছে পৌঁছানো হচ্ছে। কৃষিকে লাভজনক পর্যায়ে উন্নীত করতে বাণিজ্যিক কৃষিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বিশেষ করে রফতানি বাড়ানোর জন্য আমাদের নানা ধরনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। উপকরণ সহায়তা, অপ্রচলিত শস্যকে জনপ্রিয় করা এবং কৃষিপণ্যকে রফতানিমুখী করতে নীতিসহায়তা বাড়ানো হচ্ছে।