গাজীপুরের শ্রীপুরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কটি এশিয়ার সর্ববৃহৎ সাফারি পার্ক। যা ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডের ‘সাফারি ওয়ার্ল্ড’ ও ইন্দোনেশিয়ার ‘বালি সাফারি পার্ক’-এর আদলে গড়ে তোলা হয়েছিল। তবে নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতায় আজ তার জৌলুস হারাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলা ও অনিয়মের ছাপ পার্কের থরে থরে লক্ষ্য করা গেছে। কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের দায়িত্বহীনতা, স্বেচ্ছাচারিতা ও অতি লোভের বলি হচ্ছে একের পর এক প্রাণী। সম্প্রতি মারা যাওয়া জেব্রাগুলোকে দেয়া ঘাসে মিলেছে সিসা ও বায়ুদূষণের উপস্থিতি। এদিকে পার্কে ১১টা জেব্রা, একটি বাঘ ও একটি সিংহের মৃত্যুর ঘটনায় সবার দৃষ্টি কেবল কোর সাফারির দিকেই। অন্য পশু-পাখিদের প্রতি যেন কারো দৃষ্টি নেই। পার্কের মূল ফটক, বঙ্গবন্ধু স্কয়ার, সাফারি কিংডম, পশু পাখির শেড, বাগান, ড্রেন, লেক, অডিটরিয়ামসহ বিভিন্ন স্থাপনার গায়েও অবহেলার ছাপ। পার্ক ঘুরে দেখা যায়, মূল ফটকটি বিবর্ণ। ঝলসে যাওয়া সাইনবোর্ডটি লাগানো হয়েছে চার থেকে পাঁচদিন আগে। ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়বে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার। গাঢ় সবুজবেষ্টিত স্কয়ারের ফোয়ারাটির গায়ে লেপ্টে আছে রাজ্যের শেওলা, এটি সচল থাকে কদাচিৎ।
বাগানে গজিয়েছে আগাছা, হয়তো অনেকদিন মালীর হাত পড়েনি। বাগানগুলোর ভেতরে যেখানে সেখানে পড়ে আছে গাছের শুকনো ডাল-পাতা। ড্রেনগুলো অপরিষ্কার, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে চার পাশেই। নিয়মিত ছাঁটা হয় না রাস্তার পাশের শোভাবর্ধনকারী বিদেশী গাছগুলো। প্রজাপতি পার্কের সামনের ফোয়ারাটি ছেয়ে আছে বনলতায়। শেডের ভেতর আছে অল্প সংখ্যক প্রজাপতি। বিশাল মৎস্য অ্যাকুরিয়ামটিরও একপাশ অচল। পার্কের ভেতরের রেস্টুরেন্টটির দরজা খোলা হয়নি বহুদিন। রঙ ঝলসে বিবর্ণ হয়ে গেছে রেস্টুরেন্টের সামনের বিশাল আকৃতির ডিমটিও। পাশেই রয়েছে লেক, যেখানে রঙিন মাছের সমাহার থাকার কথা। অথচ পানিতে ভাসতে দেখা যায় আবর্জনা। প্যাডেল বোটগুলোও অযতœ অবহেলায় দীর্ঘদিন ধরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। ঝোপঝাড়ে ভরে আছে লেকের মাঝের সোয়ানদের আবাসভূমি। বিভিন্ন পশু-পাখির শেডের রঙও ঝলসে গেছে অনেক আগেই। জরাজীর্ণ অবস্থা নেটগুলোর। উটপাখি ও ইমু শেডের পশ্চিম পাশে খালের ওপর নির্মিত ছিল কাঠের সেতু। এর পাটাতনগুলো খুলে গেছে বহু অগেই। বাগানের ভেতর স্থানে স্থানে বসার বেঞ্চগুলো ভেঙে পড়েছে।
পার্কের সৌন্দর্য অবলোকন করতে নির্মাণ করা হয়েছিল সু-উঁচ্চ টাওয়ার। ঝোপ-জঙ্গলে ঘেরা টাওয়ারটি এখন আর ব্যবহার হয় না। কাঁটা দিয়ে বন্ধ করা হয়েছে টাওয়ারের পথ। সামনে গাছের ডালে বন্ধের নোটিশ ঝুলিয়েই দায় সেরেছে কর্তৃপক্ষ। ফাঁকা ক্যাঙ্গারুর শেডটিও ছেয়ে গেছে লতাপাতায়। অব্যবস্থাপনায় বন্ধ রয়েছে শিশু পার্কটি। গেটের সামনে লাগানো আছে সাময়িক বন্ধের নোটিশ। যাত্রী ছাউনির চালও খসে পড়েছে। কোর সাফারির সামনে স্থাপন করা বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার গুলো ভেঙে পড়ে আছে অনেক দিন ধরে।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, পার্ক প্রতিষ্ঠার পর থেকে এই এলাকার গুরুত্ব বেড়ে যায়। পার্কে প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী আসতো। বিভিন্ন দিবসকে ঘিরে ধারণ ক্ষমতার চার-পাঁচ গুণ দর্শনার্থী আসতো পার্কে। তাদের পদচারণায় মুখরিত থাকত পার্ক এলাকা। কিন্তু দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা আর অবহেলার কারণে জৌলুস হারাতে বসেছে পার্কটি। তাদের অবহেলা আর অযত্মেই নষ্ট হচ্ছে কোটি কোটি টাকার এসব সম্পদ।
পার্কের একাধিক কর্মকর্তা জানান, সাবেক প্রকল্প পরিচালক আর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতায় পার্কের ব্যবস্থাপনায় বাসা বেঁধেছিল অনিয়ম, দুর্নীতি আর অবহেলা। এখন এর ফল ভোগ করছে পার্কের অবুঝ প্রাণীগুলো। মূলত ২০১৯ সাল থেকে পার্কের দায়িত্বে ছিলেন সহকারী বন সংরক্ষক মো: তবিবুর রহমান। আর প্রকল্প পরিচালক ছিলেন জাহিদুল কবির। এ দুই কর্মকর্তার দায়িত্বকালেই পার্কের অব্যবস্থাপনা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এদিকে সম্প্রতি পার্কে জেব্রা, বাঘ ও সিংহীর মৃত্যুতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। গত ৩১ জানুয়ারি প্রত্যাহার করা হয় পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তবিবুর রহমান ও ভেটেরিনারি অফিসার হাতেম সাজ্জাদ জুলকারনাইনকে। আর ২ ফেব্রুয়ারি সরিয়ে দেয়া হয় প্রকল্প পরিচালক জাহিদুল কবিরকে। সরেজমিন পার্কের পরিস্থিতি দেখতে আসেন মন্ত্রী, এমপি, সচিবসহ উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা। এতেই পরিচ্ছন্নতায় তৎপর হয়েছেন দায়িত্বশীলরা। কদিন ধরেই করা হচ্ছে বাগান পরিষ্কার। রঙ করা হচ্ছে পশু-পাখির শেড। বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে সদ্য যোগদানকারী পার্কের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহকারী বন সংরক্ষক মো: রফিকুল ইসলাম জানান, সবেমাত্র নতুন দায়িত্ব পেয়েছি, যেসব সমস্যা ও অসঙ্গতি আছে তা যথা সম্ভব দ্রুত সমাধান করার চেষ্টা করব। সাফারি পার্কের নতুন প্রকল্প পরিচালক মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, পার্কে কী সমস্য আছে তা চিহ্নিত করে খুব দ্রুতই সমাধান করা হবে।