ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের তিরুনেলভেলি জেলায় নির্মাণ করা হচ্ছে দেশটির বৃহত্তম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র কুদানকুলাম নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিট এরই মধ্যে উৎপাদনে গিয়েছে। নির্মাণাধীন রয়েছে আরো চারটি। প্রতিটির এক হাজার মেগাওয়াট করে বর্তমানে চালু ইউনিটগুলোর মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দুই হাজার মেগাওয়াট। বাকিগুলোর কাজ শেষ হলে মোট সক্ষমতা দাঁড়াবে ছয় হাজার মেগাওয়াটে। বর্তমানে এর তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিটের কাজ চলছে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগের ভিত্তিতে এটি নির্মাণ করছে রুশ প্রতিষ্ঠান রোসাটমের শতভাগ মালিকানাধীন সাবসিডিয়ারি অ্যাটমস্ট্রয়এক্সপোর্ট।
এ রোসাটমই পাবনার রূপপুরে নির্মাণ করছে বাংলাদেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সবকিছু ঠিক থাকলে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের আগামী বছরেই উৎপাদনে যাওয়ার কথা। বাংলাদেশ ও ভারতের বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটির নির্মাণ ও উৎপাদনসংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখিয়েছেন বাংলাদেশের নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ও যুক্তরাজ্যের বোর্নমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন গবেষক। আন্তর্জাতিক জার্নাল স্প্রিঙ্গারে স¤প্রতি তাদের এ বিশ্লেষণ এস্টিমেটিং দি ইকোনমিক কস্ট অব সিটিং আপ আ নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্ট অ্যাট রূপপুর ইন বাংলাদেশ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রেরই নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এক। যদিও বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টায় উৎপাদন ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৯ দশমিক ৩৬ সেন্ট করে, যেখানে কুদানকুলামে নির্মাণাধীন তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিটের ক্ষেত্রে তা প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ দশমিক ৩৬ সেন্ট করে। সে হিসেবে রূপপুরে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যয় হচ্ছে কুদানকুলামের চেয়ে প্রায় ৭৫ শতাংশ বেশি। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদকাল ও গড় উৎপাদন হিসাব করে ইউনিটপ্রতি এ উৎপাদন ব্যয় (লেভেলাইজড কস্ট অব এনার্জি বা এলসিওই) বের করা হয়েছে।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূলধনি ব্যয়ের একটি অংশ হলো ওভারনাইট কস্ট। নির্মাণ খরচ, পদ্ধতিগত খরচ, মালপত্র কেনার খরচ, প্রকৌশলসংক্রান্ত খরচ, প্রথম জ্বালানির জোগান এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ (সুদ ছাড়া) যোগ করে এটি হিসাব করা হয়। বিশ্ব পরমাণু সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যাবতীয় সুদ বাদ দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে মূলধনি ব্যয়ের পরিমাণ ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার। কুদানকুলামের নির্মীয়মান ইউনিট দুটিতে মোট ব্যয়ের পরিমাণ ৬২৫ কোটি ডলার। সে হিসেবে রূপপুরের ক্ষেত্রে কিলোওয়াটপ্রতি ওভারনাইট কস্ট দাঁড়াচ্ছে ৫ হাজার ২৭১ ডলারে। অন্যদিকে কুদানকুলামের বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্ষেত্রে তা ৩ হাজার ১২৫ ডলার। সে হিসেবে রূপপুরে ওভারনাইট কস্ট বেশি পড়ছে ৬৮ শতাংশেরও বেশি। আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ে যেকোনো পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ওভারনাইট কস্টের ওপর প্রভাব পড়ে। বিশ্লেষকদের হিসাব অনুযায়ী, সেক্ষেত্রে তামিলনাড়ুর বিদ্যুৎকেন্দ্রে ওভারনাইট কস্ট ওঠানামা করতে পারে কিলোওয়াটপ্রতি ২ হাজার ৫০০ ডলার থেকে ৩ হাজার ৭৫০ ডলারের মধ্যে। অন্যদিকে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা পড়তে পারে প্রতি কিলোওয়াটে ৪ হাজার ২১৭ থেকে ৬ হাজার ৩২৬ ডলারে।
মোট ২১টি মানদ-ের ভিত্তিতে দুই দেশের নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট ব্যয়গুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে উভয় বিদ্যুৎকেন্দ্রেই সক্ষমতার সম্ভাব্য গড় ব্যবহার (ক্যাপাসিটি ফ্যাক্টর) দেখানো হয়েছে ৮৫ শতাংশ। এছাড়া কিলোওয়াটপ্রতি বার্ষিক মূলধন স¤প্রসারণের ব্যয় কুদানকুলামে হতে পারে ৩১ ডলার ২৫ সেন্ট। বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য পরিমাণ ৫১ ডলার ৭১ সেন্ট।
এদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ দ্রুতগতিতে এগোলেও অনিশ্চয়তা তৈরি করছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের অগ্রগতি। এখন পর্যন্ত সম্ভাব্যতা সমীক্ষা, জরিপ ও কিছু নকশা তৈরির বাইরে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের কাজ এগিয়েছে সামান্যই। বিষয়টি উদ্বিগ্ন করে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, সঞ্চালন লাইন সময়মতো নির্মাণ না হলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা যাবে না। সেক্ষেত্রে বৃহৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অলস বসিয়ে রাখতে হবে। এর বিপরীতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির সক্ষমতার বিপরীতে গুনতে হবে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এর ধারাবাহিকতায় আর্থিকভাবে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়বে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ফুয়েল লোড করা হবে। তার আগে অর্থাৎ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই গ্রিড লাইনের কাজ শেষ করতে হবে। যদি তা করা না যায় তাহলে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের মতো রূপপুরকেও সঞ্চালন লাইনের জন্য বসিয়ে রাখতে হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন নির্মাণ প্রকল্পের কাজ তত্ত্বাবধান করছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)। প্রতিষ্ঠানটির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চারটি মূল প্যাকেজের অধীনে সঞ্চালন লাইনটি নির্মাণের কথা। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। করোনার কারণে গত অর্থবছরেও অনেকটা স্থবিরতার মধ্যেই ছিল প্রকল্পটির বাস্তবায়নকাজ। এখনো অগ্রগতি খুব একটা সন্তোষজনক পর্যায়ে যায়নি। পিজিসিবি নিজেও মনে করছে না, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন শেষ হবে। এজন্য প্রকল্পটির মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানোর জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগে (আইএমইডি) প্রস্তাব জমা দিয়েছে পিজিসিবি।- সূত্র:বণিকবার্তা