বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মানচিত্রে প্রায় সবটুকু এলাকা জুড়ে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শক্তিশালী রাষ্ট্র ভারত। বাংলাদেশের এই অভিন্ন সীমান্তে ফেব্রুয়ারী মাসের ১৩ তারিখ ২০২২ পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফএর গুলিতে গত ২০১০ দশকে নির্বিচারে প্রায় ৪৫ জনের প্রান হারিয়েছে বাংলাদেশী নাগরিক। বারবার ভারত ও বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়। সীমান্তে হত্যার মতো কোন ঘটনা ঘটবে না। নেই প্রতিশ্রুতির কোন বাস্তবায়ন ভারতীয় বিএসএফ এর। প্রতিশ্রুতির পুরোটাই যেন প্রহসন। বারবার বাংলাদেশি নাগরিকের রক্তে রঞ্জিত হচ্ছে ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত। কান্নার রোল যেন থামছে না পরিবারের। বিএসএফ এর গুলিতে নিহত হচ্ছে বেশীর ভাগই গরীব নিরীহ দিন মজুর। মাত্র ৫০০শত টাকা থেকে ৮০০শত টাকার কামলা দিতে গিয়ে চোরাকারবারী মহাজনদের কিংবা গরুর ঘাস কাটতে, ধান কাটতে এবং মাছ ধরতে গেলে কারনে অকারনে নিজের জীবনটা উৎসর্গ করে দিয়েছে ভারতীয় হিং¯্রাে থাবা বিএসএফএর গুলিতে। মৃত্যুর আগে নিজের অপরাধটা পর্যন্ত যানার সুযোগ থাকেনা। পশুর মতো গুলি খেয়ে মরা এই দুর্ভাগাদের। মৃত্যুর পর দু’একদিন পত্র পত্রিকায় একটু আধটু হৈচৈ হলেও আজ পর্যন্ত মনে হয় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বা দ্বিপাক্ষিক কিংবা আর্ন্তজাতিক ভাবে এ সব মৃত্যুর সরে জমিনে কোন তদন্ত করে অসহায় পরিবারের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে জানা যায় নি। যেন গুলি খেয়ে মরাটাই এদের ভাগ্য। কেউ একবারের জন্য খোঁজ করে না। বুকের মধ্যে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে কেমন করে বেচে আছে তাদের পরিবার পরিজন। কোন দিক থেকে সাহায্য করা তো দুরে থাক। সীমান্তবর্তী জনপদ গুলোতে কান্না যেন কখনো থেমে থাকেনা। ২০১০ সালের পর থেকে ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৪৫ জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ এবং ককটেল নিক্ষেপে আহতের মতো ঘটনাও অনেক। অন্যদিকে বাংলাদেশী সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিজিবি) সীমান্তে তাদের টহল জোরদার না থাকায় প্রতিনিয়তেই হচ্ছে চোরাকারবারিদের গরু ও মাদক ব্যবসা। চোরাকারবারিরা সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট নির্ধারন করে রাতের আধারে দেধারছে চালিয়ে যাচ্ছে এ ব্যবসা। ব্যবসায়ীকদের সাথে সক্ষতা রয়েছে পাইলট (দালাল) নামের চাঁদা আদায়কারী কিছু অসাধু মানুষ। যাদের মাধ্যমে সীমান্তে চোরাকারবারিরা গরু ও মাদক ব্যবসা জমজমাট ভাবে পাচার করার সুযোগ দিচ্ছে। মাদক গুলি বাস, মটর সাইকেল, নৌকা যোগে দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে। প্রায় প্রতি মাসে মাদক আটক করছে পুলিশ। বিধিবাম, দুঃখ্য জনক হলেও সত্য বিজিবি সীমান্ত রক্ষী বাহিনী হলেও তাদের তেমন সাধ্য হচ্ছে না, মাদক ও গরু পাচারকারী কোন ব্যবসায়ীকে আটক করার। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী প্রায় বাংলাদেশী যুবককে গুলি করে হত্যা করছে। অথবা গরু পাচারকালে আড়কির বাঁশ মাথায় পড়ে মৃত্যু বরণের ঘটনা ঘটছে। বিজিবির পক্ষে কোন একদিন শোনা যায়নি ভারতীয় চোরাকারবারি একটিকে গুলি করে হত্যা কিংবা গরু পাচার কালে তাদের কাউকে আটক করে রাখা হয়েছে। বিজিবির টহল জোরদার কম থাকায় চোরাকারবারিরা ব্যবসার সুযোগে প্রায় ভারতীয় বিএসএফ এর গুলিতে এবং আড়কির বাঁশ মাথায় পড়ে হত্যার ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে। বিএসএফ এর গুলিতে নিহতদের মধ্যে ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ দাঁতভাঙ্গার হরিণধরা গ্রামের মজিবুরের পুত্র ফরিদুল ইসলাম(১৯), আমবাড়ি গ্রামের ইরাজ আলী ছেলে সহিবর রহমান(৩৭), জাকির হোসেনের ছেলে মোহাম্মদ আলী(২০), পূর্ব কাউয়ারচর গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে শাহাবুদ্দিন(৩২), চরের গ্রামের খয়বুল্লাহর ছেলে ছলিম উদ্দিন(৩৫), ধর্মপুর গ্রামের লালকু মিয়ার ছেলে রায়হান মিয়া(১৩), খাটিয়ামারি গ্রামের আবুল হাশেমের ছেলে হাসিনুর রহমান ওরফে ফকির চাঁন(৩৬), ছাটকরাইবাড়ি গ্রামের বক্তার হোসেন এর পুত্র বাহারুল ইসলাম(২৬), ফকির পাড়া গ্রামের আব্দুল হাই এর পুত্র দুখু মিয়া(২৭), বিএসএফ এর নির্যাতনে হত্যা বকবান্দা গ্রামের কেরামত আলীর ছেলে নুরু ইসলাম(৫০), খেতারচর সীমান্তে গুলি বিদ্ধে নিহত মোকছেদ আলী ছেলে নুরুল আমিন(৩৫) পাথর নিক্ষেপে ইজলামারী গ্রামের লুৎফর রহমানের পুত্র নিহত রাশেদুল ইসলাম(২৭)। বামনেরচর পশ্চিম পাড়া গ্রামে নিহত মনছের আলী(৪৩) ছবিয়াল হোসেনের পুত্র জাকির হোসেন(৩০) গুলিবিদ্ধ হয়। আহতদের মধ্যে নওদাপাড়া গ্রামের সাজু(১৮), পিতা: আনোয়ার হোসেন, রোকন(২২) পিতা: রেজাউল করিম, মানিক(১৬), বাবলু(২০), মজনু মিয়া(২৮), স্কুল শিক্ষার্থী আনিছুর রহমান(১৩), একরামুল হক(১৭), ময়নাল হোসেন(১৪), আরিফুল হক(১৬), মিজানুর রহমান(১৫), ফারুক মিয়া(৪০), আবেদ আলী(৩৫) ও জহুরুল ইসলাম(৪৫) মমিনুল ইসলাম মুন(২৮)। নিহত ও আহতদের মধ্যে ১৬ বছরের বালক থেকে ৫৫ বছরের বৃদ্ধ বয়সী পর্যন্ত রয়েছে। কথা রাখেনি বিএসএফ তাদের উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের আলোচনায় হত্যা বন্ধে প্রতিশ্রুতির কথা। এখনো তাদের বিধবা স্ত্রী, পিতৃহারা সন্তান, পুত্র হারা বাবা মাসহ নিকট আত্মীয়দের আহাজারিতে ঐ জনপদের বাতাস ভারী থাকে প্রতিনিয়তেই। নিহতদের অনেকেই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জন ব্যাক্তি। আবার আয়ের উপর বহুলাংশে নির্ভর করতো তাদের পরিবার। কিন্তু তাদের মৃত্যুর পর তাদের পরিবারে অনিশ্চয়তা নেমে এসেছে। তা থেকে উত্তোরনের উপায় অনেকেরই নেই। তাই এসব পরিবারের যে অবর্ণণীয় কষ্ট দেখার বা খোঁজ নেয়ার কেউ নেই। অপর দিকে ২০০১ সালে ১৮ এপ্রিল ভোর ৫ টায় বাংলাদেশের বিওপি ক্যাম্প দখলের চেষ্টায় ভারতীয় রক্ষী বাহিনী বিএসএফ এর অতর্কিত হামলার সেই রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ী সীট মহল যুদ্ধাস্ত এলাকার মর্মান্তিক কাহিনী। বড়াইবাড়ী ক্যাম্প গুলি দ্বারা ক্ষত আজোও চেয়ে আছে কালের স্বাক্ষী হয়ে। যেমন চেয়ে আছে ১৯৭১ সালের পাকিস্থান হানাদার বাহিনীর যুদ্ধ স্মৃতি ফলক। ঐ সময় সীমান্ত যুদ্ধে বিএসএফ এর গুলিতে তিন বিডিআর জোয়ান ল্যান্স নায়েক ওয়াহেদ, সিপাহী আব্দুল কাদের ও সিপাহী মাহফুজ শহীদ হন। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল কুড়িগ্রাম জেলার পুর্বাঞ্চল ব্রম্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল ভারতীয় আসাম ও মেঘালয় প্রদেশের সীমান্ত ঘেষা আঁকাবাঁকা বয়ে যাওয়া জিঞ্জিরাম নদী সংলগ্ন উপজেলা রৌমারী ও রাজিবপুর সীমান্তে প্রায় ৩০ টি গ্রাম সরে জমিনে ঘুরে ফিরে দেখা গেছে বিএসএফএর গুলিতে নিহত ও আহত পরিবারের হৃদয় বিদারক কাহিনী যেন কান্নার রোল কখনো থেমে থাকে না।