দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। বিদ্যুৎকেন্দ্রের মূল অংশ রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল বা পরমাণু চুল্লিপাত্র বসেছে গত অক্টোবরেই। আগামী বছর বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট ও ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের কাজ শেষ করার লক্ষ্য নিয়েছে সরকার। প্রকল্পটির প্রায় পাঁচ হাজার বিদেশী কর্মী এখন ঈশ্বরদীর রূপপুরে অবস্থান করছেন, যাদের বেশির ভাগই রুশ নাগরিক। এর মধ্যেই ইউক্রেনে শুরু হওয়া যুদ্ধ প্রকল্পটি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। রাশিয়ার ওপর একের পর এক বিধিনিষেধ দিয়ে চলেছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাৎক্ষণিকভাবে প্রকল্পটির ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব দেখা না গেলেও দীর্ঘমেয়াদে বেশকিছু বিড়ম্বনা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে রাশিয়ার আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশটি নিজ থেকেই প্রকল্পের কাজের গতিতে লাগাম টানতে পারে। আবার বিধিনিষেধের কারণে আর্থিক লেনদেনেও দেখা দিতে পারে বিপত্তি । সেক্ষেত্রে প্রকল্পের বাংলাদেশী কর্মীদের বেতন-ভাতা থেকে শুরু করে প্রকল্পের নির্মাণ উপকরণ সরবরাহকারী স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ পরিশোধ নিয়েও বিড়ম্বনার আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ শেষে জ্বালানি, পারমাণবিক বর্জ্য, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়েই যুক্ত থাকতে হবে রুশ কর্মীদের। সে বিষয়টিকেও বাধাগ্রস্ত করতে পারে চলমান যুদ্ধ ও যুদ্ধ-পরবর্তী ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা।
বিষয়টি নিয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। এক্ষেত্রে নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পরও আরো অনেক কাজ রয়েছে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে দুশ্চিন্তার কোনো কারণ না থাকলেও দীর্ঘমেয়াদের প্রভাব নিয়ে আশঙ্কা রয়ে গিয়েছে।
তিনি বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে অবকাঠামো নির্মাণ মানেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শেষ। নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর নিউক্লিয়ার প্লান্টের কমিশনিং শুরু হবে। যথাযথভাবে কমিশনিংয়ের (সচল হওয়া) জন্য সেফটি, সিকিউরিটি ও সেফগার্ডস—তিনটি ধাপ রয়েছে। মূল কমিশনিং হবে যখন জ্বালানি লোডিংয়ের পর রিঅ্যাকশন শুরু হবে। মূল জ্বালানি লোডিংয়ের সঙ্গেও অনেকগুলো অবকাঠামো জড়িত রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ব্যবস্থা হলো নিউক্লিয়ার গভর্ন্যান্স। বিষয়টি শুধু দেশের আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এর জন্য আন্তর্জাতিক আইন, চুক্তি ও সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতির বিষয়ও জড়িত রয়েছে। এসব কর্মযজ্ঞ শেষ হতে এখনো দেরি আছে। এর মধ্যে বর্তমান যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে কী হবে তা সময় গেলেই বোঝা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, রাশিয়া-ইউক্রেনে উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে প্রকল্পসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। রাশিয়া প্রকল্পের অর্থায়ন বাবদ যে অর্থ দিচ্ছে, তা বাংলাদেশে আসে না। রুশ অর্থায়নের কোনো অংশ কখনই বাংলাদেশের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় না। ১৮টি রুশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে ১ হাজার ১৩৫ কোটি ডলারের প্রকল্পটির কাজ করাচ্ছে তত্ত্বাবধানকারী সংস্থা রোসাটম। এসব প্রতিষ্ঠান কাজ করে সনদ নিয়ে রাশিয়া থেকেই পাওনা অর্থ নিয়ে নেয়। উপকরণ, যন্ত্র, নকশাসহ সবকিছুই রুশদের তত্ত্বাবধানে নির্মাণের পর বাংলাদেশকে দেয়া হয়। বাংলাদেশ শুধু বুঝে নেয়।
যুদ্ধের বর্তমান প্রেক্ষাপটে সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিষয়টি নিয়ে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে জানিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জিয়াউল হাসান বলেন, রাশিয়া আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। রূপপুর প্রকল্পটি রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায় হচ্ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালককে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদেরও বলা হয়েছে বাংলাদেশে বসবাসরত রুশ নাগরিকদের বিষয়ে সতর্ক থাকার পাশাপাশি নজরদারি জোরদার করতে। নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যেসব কথা হচ্ছে তার প্রভাব বাংলাদেশ পর্যায়ে এখনো আসেনি। বাংলাদেশ সরকার শান্তিপূর্ণ থাকার বিষয়েই মতামত দিয়েছে। বিধিনিষেধের ব্যাপ্তি যদি বাড়ানো হয়, সেগুলোর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে আগেই মন্তব্য করতে পারছি না। মানসিক অস্থিরতার কিছু বিষয় আছে। আমরা সতর্ক আছি।
মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশে রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকরা কাজ করেন। তারা নিজ নিজ দেশে টাকা পাঠান। এক্ষেত্রে যেহেতু ব্যাংকগুলোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে কিছু সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে বিকল্পও আছে। বাংলাদেশে সেই বিকল্পগুলো অনেক শক্তিশালী। ফলে বাংলাদেশে বসবাসরত রাশিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিকরা কোনো না কোনোভাবে টাকা পাঠাতে বা আনতে পারবেন। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন উপকরণ রাশিয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশও বানাচ্ছে। কোনো ডিভাইস তৈরি বা আমদানির ক্ষেত্রে কোন ধরনের সমস্যা হতে পারে, সেটাও দায়িত্ব হিসেবে রুশ কর্মকর্তারাই দেখবেন। তবে সমস্যায় পড়তে পারেন বাংলাদেশের শ্রমিকরা। রুশ ঠিকাদাররা অর্থ নিয়ে আসার পরই শ্রমিকরা টাকা পান। এ বিষয়ে রুশ ঠিকাদারদের বিকল্প পন্থা সম্পর্কে ভাবতে হতে পারে। আর বিকল্প পথ যেহেতু আছে, ফলে শ্রমিকদের প্রাপ্য বুঝিয়ে দিতেও বড় কোনো সমস্যা হবে না। সামগ্রিকভাবে বলা যায়, স্বাভাবিক কাজগুলোর ক্ষেত্রে প্রথমে কিছু সতর্ক হওয়ার মতো বিষয় ঘটবে। তবে বিকল্প পথ থাকায় প্রকল্প এগিয়ে নিতে কোনো সমস্যা হবে না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর চলমান যুদ্ধের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম তামিম বলেন, প্রকল্পটি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চলছে। আমরা যদি কোনো ধরনের বিধিনিষেধের আওতায় পড়ে যাই এবং আমাদের তা মানতে হয়, সেক্ষেত্রে এক ধরনের বিড়ম্বনা দেখা দিতে পারে। রুশরা নিজ থেকে প্রকল্প বন্ধ করবে না। বিধিনিষেধ দেয়া হলে আমাদের বলতে হবে বন্ধ করতে। কিন্তু রূপপুর প্রকল্পের বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশ তা বন্ধ করার কথা বলবে বলে মনে করছি না। কারণ আমাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী তা সম্ভব না। তিনি মনে করছেন, এখন রাশিয়া যদি দীর্ঘ যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে, সে কারণে তাদের দিক থেকে প্রকল্প ধীর হলেও হতে পারে। সে সম্ভাবনা একেবারে নাকচ করে দেয়া যায় না। বিষয়টি নির্ভর করবে কতদিন যুদ্ধ চলবে এবং সার্বিক অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তার ওপর। শঙ্কা আছে দেশটির আর্থিক পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী তাদের প্রকল্পগুলোয় প্রভাব পড়তে পারে।
রূপপুর প্রকল্পসংশ্লিষ্ট বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব পরোক্ষভাবে হলেও বাংলাদেশের ওপর পড়বে। কারণ প্রকল্পটি নির্মাণে যেসব উপকরণ সরবরাহ হচ্ছে, যেমন—সিমেন্ট, রডের মতো নির্মাণ উপকরণগুলো সবই বাংলাদেশের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা সরবরাহ করছেন। নিষেধাজ্ঞার কারণে এসব উপকরণ সরবরাহকারীদের অর্থ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের কো-চেয়ারম্যান মো. শহিদুল্লাহ বলেন, প্রকল্পের নির্মাণ উপকরণে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সিমেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তাদের অর্থ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা দেখা দেবে কিনা তা এখনই বলা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ এখনো যুদ্ধে সমর্থন না দিয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে আছে। রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক এবং প্রকল্পের বিষয়টি থাকার পরও আমরা যদি সমর্থন করি, তাহলে ক্ষতি হবে আমাদের। যুদ্ধ মাত্র শুরু হয়েছে। দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাব আছে কিনা তা পরে বলা সম্ভব হবে।
রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের নির্মাণকাজের অন্যতম সিমেন্ট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান প্রিমিয়ার সিমেন্ট। যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, আমি উদ্বিগ্ন নই। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, আমি তা মেনে নেব।
এদিকে সরকারের মন্ত্রী পর্যায় থেকেও রূপপুর প্রকল্পে রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটের কোনো প্রভাব পড়বে না, এমনটাই বলা হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রূপপুর মেগা প্রকল্পে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন করলে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম এমপি রূপপুর প্রকল্প বাধাগ্রস্ত হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। একই বক্তব্য পরিকল্পনামন্ত্রীরও। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যবসা হলো রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রকল্পটি করোনাকালে বন্ধ হয়নি। এখনো বন্ধ হবে না।
নির্মাণকাজ শেষেও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত থাকবে রাশিয়া। বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ইউরেনিয়ামও আসবে সেখান থেকেই। এছাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজটিতেও যুক্ত থাকবে রাশিয়া। সব মিলিয়ে নির্মাণ-পরবর্তী সময়েও রাশিয়ার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেনের বড় একটি ক্ষেত্র হতে যাচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরেই চালু হওয়ার কথা বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। গোটা বিষয়টি নিয়েই বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি করেছে চলমান ইউক্রেন যুদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যুদ্ধে রাশিয়ার আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মীয়মাণ দেশের প্রথম পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার বড় একটা জায়গা তৈরি হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির অগ্রগতিতে তাৎক্ষণিকভাবে নেতিবাচক কোনো প্রভাবের আশঙ্কা নেই। তার পরও চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি বিবেচনায় পরিস্থিতি নিয়ে সতর্ক পর্যবেক্ষণ চালাচ্ছে সরকার।