জাতীয় ইতিহাসের অন্যতম তাৎপর্যপূর্ণ মার্চ মাসের নবম দিন আজ বুধবার । ১৯৭১ সালের এই দিনে সারা দেশে বিক্ষোভের আগুন টগবগ করছিলো। বিভিন্ন আন্দোলন চলতে থাকে, প্রাণহানিও থেমে থাকেনি। এদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিলো জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির অস্বীকৃতি। এদিন টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের কথা ছিলো।
সংবাদপত্রে বলা হয়, ঢাকা হাইকোর্টের হরতালের দরুণ কোনো বিচারপতি পূর্ব পাকিস্তানের নবনিযুক্ত সামরিক গবর্নরকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে সম্মত হচ্ছেন না। এদিন ঢাকার ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী তার ভাষণে বলেন, “সাত কোটি বাঙালির মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। পূর্ব বাংলাকে পৃথক রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমেই দেশের দু’অঞ্চলের তিক্ততার অবসান হতে পারে। সংহতি এখন অতীতের স্মৃতি এবং কোনো শক্তিই অধিকারকে নস্যাৎ করতে পারবে না। শেখ মুজিব বঙ্গবন্ধু বা যে বন্ধুই হোক না কেন আপোষ করতে গেলে পিঠের চামড়া খুলে ফেলবো।”
ওই ভাষণে মওলানা ভাসানী আরো বলেন, “ইয়াহিয়াকে তাই বলি, অনেক হইয়াছে আর নয়। তিক্ততা বাড়াইয়া আর লাভ নেই। ‘লাকুম দ্বীনুকুম অলিয়াদ্বীন’ (তোমার ধর্ম তোমার আমার ধর্ম আমার) এর নিয়মে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা স্বীকার করে নাও। শেখ মুজিবের নির্দেশমত আগামী ২৫ তারিখের মধ্যে কোন কিছু করা না হলে আমি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে মিলিত হইয়া ১৯৫২ সালের ন্যায় তুমুল আন্দোলন গড়ে তুলবো।” ভাসানী এদিন ১৪ দফা ঘোষণা করেন।
এদিকে, এদিন জামায়াতে ইসলামীর নেতা অধ্যাপক গোলাম আযম এক বিবৃতিতে বলেন, “অধিবেশনের পুনঃআহ্বান স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের অজুহাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করার কোনো যুক্তি নেই। আমি অতি সত্বর গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করার জন্য আমার পূর্ব দাবির পুনরুল্লেখ করছি।”
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত আসাদ চৌধুরীর ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়, “৯ মার্চ মওলানা ভাসানী জনসমাবেশে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রতি ৭ কোটি বাঙালিকে স্বাধীনতা দানের আহ্বান জানান।”
অন্যদিকে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ১০ দফার পর ৯ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ১০ দফার সংশোধনীসহ ১৬ দফা দিকনির্দেশনা দেন। এর উপজীব্য হয়ে ওঠে পশ্চিম পাকিস্তানীদের কুৎসিত পৈশাচিকতা এবং চিরসংগ্রামী বাঙালির আপসহীনতা। তৎকালীন পত্র-পত্রিকার খবর নিয়ে রচিত বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক ঘটনাপঞ্জি ১৯৭১-২০১১’ গ্রন্থ অনুযায়ী, “১৯৭১ সালের ৯ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলন সম্পর্কিত সংশোধিত নির্দেশ জারি করেন। ১. ব্যাংক : ক. পূর্ববর্তী সপ্তাহের মতো মজুরি ও বেতনের টাকা প্রদান, খ. ব্যক্তিগত লক্ষ্যে কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য টাকা প্রদান, গ. কল-কারখানা চালু রাখার লক্ষ্যে কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য টাকা প্রদান, ২. স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনোভাবে টাকা পাঠানো বন্ধ, ৩. উপরিউক্ত বিষয়গুলোর জন্য স্টেট ব্যাংক খোলা থাকবে, ৪. ইপি ওয়াপদা : বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় শাখাগুলো খোলা থাকবে, ৫. ইপি এডিসি : সার ও পাওয়ার পাম্পের ডিজেল সরবরাহের কাজ করবে, ৬. ধান ও পাটবীজ সরবরাহ হবে এবং ইট পোড়াবার কয়লা দিতে হবে, ৭. খাদ্য পরিবহন অব্যাহত থাকবে, ৮. উপরোল্লেখিত বিষয় সম্পর্কিত চালান পাসের জন্য ট্রেজারি ও এজি অফিস কাজ করবে, ৯. ঘূর্ণিঝড়বিধ্বস্ত এলাকায় রিলিফ বণ্টন অব্যাহত থাকবে, ১০. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠিপত্র, তার এবং মানিঅর্ডার পাঠানো অব্যাহত থাকবে। পোস্ট অফিস, সেভিংস ব্যাংক খোলা থাকবে। বিদেশে প্রেস টেলিগ্রাম ছাড়া আর কিছু পাঠানো যাবে না, ১১. বাংলাদেশের সর্বত্র ‘ইপিআরটিও’ চালু থাকবে, ১২. গ্যাস ও পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে; ১৩. স্বাস্থ্য ও স্যানিটারি সার্ভিসগুলো চালু থাকবে; ১৪. শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য পুলিশ স্বেচ্ছাসেবকের সহযোগিতা গ্রহণ করবে, ১৫. উপরে বর্ণিত আধাসরকারি অফিসগুলো ছাড়া বাকি সব অফিসে হরতাল অব্যাহত থাকবে, ১৬. গত সপ্তাহের জারিকৃত অন্যান্য নির্দেশ বহাল থাকবে।”