নারী নির্যাতনও এক ধরনের সামাজিক ব্যাধি। এই ব্যাধির বিস্তার সমাজ ও পরিবারের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। পরিসংখ্যান বলছে, শহরের চেয়ে গ্রামের নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার। নির্যাতিতদের মধ্যে মধ্যবয়সী নারীই বেশি। আর বেশি মানসিক নির্যাতন করেন স্বামী। জীবনে অন্তত একবার মানিসক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এমন নারী ২৮ শতাংশের বেশি। নির্যাতনের ট্রমা থেকে নারীরা আক্রান্ত হচ্ছেন মানসিক রোগে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ ‘জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ ২০১৮’ জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। ১৯ হাজার ৯৮৭ জন নারীর সাক্ষাৎকার নিয়ে বিবিএস এমন রিপোর্ট প্রকাশ করে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেকারত্ব, পরিবার ও কর্মস্থলে অবহেলা, প্রেমে প্রতারণা, পারিবারিক অশান্তি, যৌথ পরিবার ভেঙে সম্পর্কের বন্ধন আলগা হওয়া, মাদকের আগ্রাসন, জীবনযাপনে প্রযুক্তির অতিনির্ভরতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার মানসিক রোগের অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, জীবনে অন্তত একবার মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। সবচেয়ে বেশি গ্রামে, ২৯ দশমিক ৭ শতাংশ। শহরে এ হার ২৫ দশমিক ৪ শতাংশ। সিটি করপোরেশন এলাকায় ২০ দশমিক ৭ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অন্যদিকে সিটি করপোরেশনের বাইরে বা অন্যান্য শহরে মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ২৭ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। ওই জরিপে দেখা গেছে, বয়সের অনুপাতে ৪৫ থেকে ৪৯ বয়সী নারীরা বেশি মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর হার ৩০ দশমিক ৫ শতাংশ। এছাড়া ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী নারীরা কম মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, এর হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০ থেকে ২৪ বছর বয়সের নারীদের ক্ষেত্রে এ হার ২৮ দশমিক ১, ২৫ থেকে ২৯ বছরের ক্ষেত্রে ২৭ দশমিক ১, ৩০ থেকে ৩৪ বছরের ক্ষেত্রে ২৯ দশমিক ৯, ৩৫ থেকে ৩৯ বছরের ক্ষেত্রে ২৮ দশমিক ১, ৫০ থেকে ৫৪ বছর বয়সের ক্ষেত্রে ৩১ দশমিক ১, ৫৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সে ২৬ দশমিক ৫ এবং ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। স্বামীর মাধ্যমেই মূলত মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বেশি নারী।
প্রেমসহ নানা কারণে বাংলাদেশে ভয়াবহ হারে বাড়ছে মানসিক রোগী। আক্রান্তদের মধ্যে নারীর সংখ্যাই বেশি। বিষণ্নতা ও অবসাদে ভোগা এসব রোগীর অনেকে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথও বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন নানা অপরাধে। করোনাকালে এ প্রবণতা আরও বেড়েছে। মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ফেলো ডা. নাঈম আকতার আব্বাসী বলেন, প্রতিনিয়তই মানসিক নির্যাতনের হার বেড়ে চলেছে। শিক্ষা ও সমাজের পারিপার্শ্বিক অবস্থাই এর জন্য দায়ী। শহরে শিক্ষিতের হার বেশি। পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব কম। শহরের নারীরা নিজের অধিকার আদায়ে অনেকটা সোচ্চার। গ্রামে এখনো পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা। শিক্ষার হারও কম। নারীরা সচেতন নয়। এসব কারণেই মূলত শহরের চেয়ে গ্রামে সহিংসতা বেশি। তিনি আরও বলেন, গ্রামে নারীর উপর পুরুষরা বেশি কর্তৃত্ব দেখাতে চান। শ্বশুর-শাশুড়িও নারীকে মানসিক চাপ দেন। গ্রামের নারীরা প্রতিবাদ করেন কম। তবে শহরে এটা কম হয়।
এ অবস্থা থেকে মুক্তির বিষয়ে ডা. নাঈম আকতার আব্বাসী বলেন, এটি কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ পরিবার থেকে নিতে হবে। নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। মেয়ে সন্তান জন্ম নিলে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখানো হয়। অথচ ছেলে সন্তানকে সংসারে অন্য চোখে দেখে, এই মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে দিতে হবে গুরুত্ব। নারীর প্রতি অবহেলা করা যাবে না। কর্মক্ষেত্রেও নারীর প্রতি অবহেলা করা হয়। ‘নারী পারবে না’ বলে তাদের কম চ্যালেঞ্জিং কাজ দেওয়া হয়। এটা বন্ধ করতে হবে। কর্মক্ষেত্রে নারী-পুরুষকে দেখতে হবে একইভাবে। সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন করতে হবে।
এসব বিষয়ে বিবিএস-পরিচালক (ডেমোগ্রাফি অ্যান্ড হেলথ উইং) মো. মাসুদ আলম এ বিষয়ে বলেন, আমরা পাবলিক ডেটা সংগ্রহ করে জেন্ডার স্ট্যাটিসটিকস অব বাংলাদেশ প্রকাশ করেছি। বিভিন্ন জরিপের ডেটা সংগ্রহ করে কম্পাইল করা হয়েছে। মানসিক থেকে শুরু এখানে নারী নির্যাতনের সব তথ্যই উঠে এসেছে। নারী নির্যাতনের নতুন তথ্য সংগ্রহ করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে এই কাজ দেশব্যাপী শুরু হবে। বাসায় বাসায় গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা হবে। তখন নারীদের বিষয়ে সব তথ্য আরও গভীরভাবে উঠে আসবে।- জাগো নিউজ