স্বাধীনতার মাস মার্চের ১২তম দিন আজ শনিবার। ১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের (ইপিইউজে) কার্যনির্বাহী পরিষদের এক সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সাংবাদিক সমাজকেও এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হবার আহ্বান জানানো হয়। চলচ্চিত্র এবং চিত্রশিল্পীরাও প্রত্যক্ষ সমর্থন করে স্বাধীনতা আন্দোলনে শরীক হন। শিল্পী মর্তুজা বশীর ও কাইয়ুম চৌধুরীর নেতৃত্বে এদিন বাংলা চারু ও কারু শিল্পী সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে এ পরিষদ বিশেষ ভূমিকা রাখে।
এদিনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো, পূর্ব পাকিস্তানের সিভিল সার্ভিস এসোসিয়েশনের সদস্যদের বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করা। তারা আন্দোলনে অর্থের যোগান দিতে তাদের একদিনের বেতন দেয়ার ঘোষণা দেন। এদিন অন্তত দেড় শতাধিক মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। নেতার আহ্বানে সাড়া দিয়ে সরকারি আধা-সরকারি কর্মচারীগণ ঐক্যবদ্ধভাবে অফিস-আদালত বর্জন করে।
এদিন প্রতিবাদ প্রতিরোধ বিদ্রোহ বিক্ষোভে দুর্বার হয়ে উঠছিল বীর বাঙালি জাতি। একাত্তরের মার্চ মাসের দিনগুলো ছিল থমথমে, উৎকণ্ঠা আশঙ্কায় পরিপূর্ণ। চাপা উদ্বেগ, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছিল সাড়ে সাত কোটি বাঙালি। কি ঘটবে, কী ঘটতে যাচ্ছে তা নিয়ে চিন্তিত- উৎকণ্ঠিত ছিলেন সকলেই। অন্যদিকে ক্রমেই স্তিমিত হতে থাকে পাকিস্তানী বাহিনীর কর্মকান্ড। লাগাতার অসহযোগ আন্দোলনের ফলেই পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তানী সামরিক জান্তা দমে যেতে থাকে।
এদিন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক ঘোষণায় পাকিস্তানের জাতীয় সঙ্গীত ‘পাকসার জমিন’ বাতিল করে ‘আমার সোনার বাংলা / আমি তোমায় ভালবাসি’ এই রবীন্দ্র সঙ্গীতকে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সকালেই একটি ভ্রাম্যমাণ স্কোয়াড নিয়ে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী ও সুরকার আপেল মাহমুদ সারা ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় এই সঙ্গীত পরিবেশন করেন। তখন তার সাথে ছিলেন বিশিষ্ট গীতিকার ফজলে খোদা ও বেতারের ক’জন সঙ্গীত শিল্পী।
এছাড়া এদিন এদেশের পুকুর-ডোবা, বিল-ঝিলে জন্মানো চিরপরিচিত শাপলাকে আমাদের জাতীয় ফুল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পটুয়া কামরুল হাসানের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে আয়োজিত শিল্পীদের এক সভায় এ ঘোষণা দেয়া হয়। ঘোষণা শেষে মুক্তিকামী মানুষকে সেদিন আরও বেশি উৎসাহী করে তুলতে তারা প্রতিবাদী পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন বিলি করেন।
এদিকে গত কয়েকদিনের মতো এদিনও বগুড়ার জেল ভেঙ্গে ২৭ জন কয়েদী পালিয়ে যায়। পুলিশের গুলীবর্ষণে ১ জন নিহত ও ১৬ জন আহত হয়। জনসাধারণ খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দিয়ে অহিংস-অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে নবতর অধ্যায়ের সূচনা করে। যথারীতি আজও সারা ঢাকা শহর স্বাধিকার আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে কালো পতাকার শহরে পরিণত ছিল। বিকেল তিনটায় চব্বিশটি সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার ইউনিয়নের সমন্বয়ে কাউন্সিল বায়তুল মোকাররম মসজিদের সামনে গণজমায়েত করে। বিকেল ৪টায় মুজিববাদী ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের পৃথক পৃথক পথসভা ও খন্ড মিছিল, ৫টায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সদরঘাট নৌ টার্মিনালে পথসভা ও মগবাজারে ফরোয়ার্ড স্টুডেন্টস ব্লকের গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়। রাতে কাকরাইলস্থ আর্মড সার্ভিসেস বোর্ড অফিসে দুটো এসিড বোতল নিক্ষেপ করা হলে আগুন ধরে যায়। এমন পরিস্থিতিতে বেশ কিছু জার্মান ও বৃটিশ নাগরিক ঢাকা ত্যাগ করলেও ঢাকায় বিদেশী কূটনীতিক মিশনের লোকেরা ‘বাংলা’ ছাড়ার চিন্তা করছিলেন না। এদিনও মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, খান-এ-সবুর, অধ্যাপক গোলাম আযম, নুরুল আমিন প্রমুখ প্রধান রাজনীতিকরা পৃথক পৃথক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবিলম্বে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার আওতাধীন এবং তার মাধ্যমে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষার আহ্বান জানান। অধ্যাপক গোলাম আযম তার বিবৃতিতে বলেন, সামরিক সরকারের এ কথা বুঝা উচিত বুলেট ও বেয়নেট দ্বারা দেশের সংহতি ও অখন্ডতা রক্ষা করা যায় না। ময়মনসিংহে এক জনসভায় মজলুম নেতা মওলানা ভাসানী এদিনও বঙ্গবন্ধুর কর্মসূচির প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে বলেন, ‘পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখে লাথি মেরে শেখ মুজিবুর রহমান যদি বাঙালিদের স্বাধিকার আন্দোলনে সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হন তবে ইতিহাসে তিনি কালজয়ী বীররূপে, নেতারূপে অমর হয়ে থাকবেন।’ ২০১৪ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিসেনানী লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী তার ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “১২ মার্চ সিএসপি ও ইপিসিএস অফিসার সমিতি বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানালো এবং তাদের এক দিনের বেতন আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে জমা করবার কথা ঘোষণা করলেন।”
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ প্রকাশিত ‘স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারক’ গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়,“১২ মার্চ লন্ডনের ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়।”
মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম পিএসসি তার ‘বিদ্রোহী মার্চ ১৯৭১’ শীর্ষক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘১২ মার্চে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান এক জনসভায় বললেন, আমাদের অদূরদর্শিতার জন্য বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান ৫ বছরও টিকে থাকতে পারবে না।’
অন্য কয়েকটি বইয়ে উল্লেখ রয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে ইশতেকলাল পার্টির প্রধান এয়ার মার্শাল (অব) আসগর খান টানা তৃতীয় দিনের মতো সেদিন লাহোরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, দেশকে খন্ডবিখন্ড হয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষাকল্পে এই পরিস্থিতিতে অনতিবিলম্বে প্রথম ফ্লাইটেই প্রেসিডেন্টের উচিত ঢাকায় গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মুজিব প্রদত্ত সকল শর্ত মেনে নেয়া। জাতীয় লীগ সভাপতি আতাউর রহমান খান আজ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এক বৈঠকে মিলিত হন।