শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতই আমাদের কাছে শবেবরাত হিসেবে পরিচিত, যার আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। ফারসি ‘শব’ আর আরবি ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত বা রজনী। ‘বারাআত’ অর্থ হলো নাজাত বা নিষ্কৃতি, মুক্তি, পরিত্রাণ প্রভৃতি। সুতরাং শবেবরাতের অর্থ দাঁড়ায় মুক্তি, নিষ্কৃতি বা পরিত্রাণের রজনী। যেহেতু হাদিস শরিফে বারবার বিবৃত হয়েছে, এই রাতে আল্লাহ রাব্বুল আলআমিন মানুষকে গুনাহ থেকে পরিত্রাণ দেন, তাই এ রাতের নামকরণ করা হয়েছে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘শবেবরাত’। হাদিসের পরিভাষায় এই রাতের নাম হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা মধ্য শাবানের রাত।
ফজিলতময় এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির গুরুত্ব বর্ণনা করে রাসূলে কারিম সা. ইরশাদ করেছেন, ‘যখন শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাত আগমন করবে, তখন তোমরা রাত্রি জাগরণ করো এবং দিনে রোজা পালন করো। কেননা, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক রাতের শেষ তৃতীয়াংশে পৃথিবীর প্রথম আসমানে নেমে আসেন। কিন্তু শাবানের এ রাতে সূর্যাস্তের সাথে সাথেই মহান আল্লাহ তায়ালা প্রথম আসমানে আগমন করে স্বীয় বান্দাদের সম্বোধন করে বলতে থাকেন, ‘কে আছো ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করে দেবো। কে আছো রিজিক অনুসন্ধানকারী? আমি তাকে রিজিক প্রদান করব। কে আছো বিপদগ্রস্ত? আমি তাকে বিপদমুক্ত করে দেবো। এমনিভাবে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহ তায়ালা স্বীয় বান্দাদের আহ্বান করতে থাকেন।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ)।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে সৃষ্টিজগতের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করেন এবং বিদ্বেষ পোষণকারী ও খুনি ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (মুসনাদে আহমদ)
উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সা. ইরশাদ করেন, ‘তুমি কি জানো, এই রাত তথা মধ্য শাবানের রাতে কী হয়? আয়েশা রা. বললেন, কী হয়, ইয়া রাসূলাল্লাহ? তখন রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘এই বছর যারা জন্ম নেবে এবং যারা মৃত্যুবরণ করবে, সব এই রাতে লেখা হয়। এই রাতে বান্দার সারা বছরের আমল উত্তোলন করা হয় এবং সারা বছরের রিজিক বণ্টন করা হয়।’ (বায়হাকি)
এসব বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয়, শরিয়তে শবেবরাত একটি প্রমাণিত সত্য। একে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এর মধ্যে কিছু বর্ণনা সহিহ, কিছু হাসান, আবার কিছু জয়িফ হলেও সামগ্রিকভাবে এসব বর্ণনা গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে মুহাদ্দিসিনে কিরামের বহু উক্তি রয়েছে। যেমন- প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ শায়খ আলবানি রহ. বলেন, ‘শবেবরাত সম্পর্কিত হাদিসগুলোর সার কথা হলো- এ সম্পর্কে বর্ণিত হাদিসগুলো সামগ্রিকভাবে নিঃসন্দেহে সহিহ। হাদিস অত্যধিক দুর্বল না হলে এর চেয়ে কমসংখ্যক সূত্রে বর্ণিত হাদিসও সহিহ হিসেবে গণ্য হয়।’ (সিলসিলাতুস সহিহাহ) এ সম্পর্কে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. লিখেছেন, ‘মধ্য শাবান রাতের ফজিলত বিষয়ে অনেক হাদিস রাসূলুল্লাহ সা. ও সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়িগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে যেগুলো শবেবরাতের ফজিলত প্রমাণ করে। পূর্বসূরিদের অনেকে এ রাতে নামাজে নিমগ্ন থাকতেন। …অসংখ্য বিজ্ঞ আলেম এবং আমাদের বেশির ভাগ সাথী এই মতাদর্শে বিশ্বাসী। ইমাম আহমদ রহ.-এর উক্তি দ্বারাও তাই প্রমাণিত হয়। কারণ এ বিষয়ে রয়েছে অনেক হাদিস এবং নির্ভরযোগ্য পূর্বসূরিদের অনুসৃত আদর্শ।’ (ইকতিদাউস সিরাতিল হুদা)
বর্তমান সময়ে এ রাতে এমন কিছু কর্মকা- প্রচলিত আছে, যা সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী। যেমন- ঘর-বাড়ি, দোকান, মসজিদ আলোকসজ্জা করা, মাজার-কবরস্থানে ফুল দেয়া ও আলোকসজ্জা করা, আতশবাজি, পটকা ফোটানো ইত্যাদি। এ ছাড়াও অনেক অঞ্চলে শবেবরাতকে কেন্দ্র করে হালুয়া-রুটিকে শবেবরাতের প্রধান কর্ম মনে করা হয়। শরিয়তে এসব কাজের কোনো ভিত্তি নেই। মহিলারা নামাজ, জিকির, তিলাওয়াত ইত্যাদি ছেড়ে দিয়ে হালুয়া-রুটি বানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে যান। যেন হালুয়া-রুটি ছাড়া শবেবরাতের ইবাদত কবুলই হবে না। মনে রাখতে হবে, শবেবরাতে নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই, আবার এই রাতের জন্য আমলের আলাদা কোনো নিয়মও কুরআন-হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়। তাই আমাদের সবার উচিত যাবতীয় ঝামেলা থেকে মুক্ত হয়ে মহান আল্লাহ রাব্বুল ’আ-লামিনের নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে এ পবিত্র রাতে বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া, আল্লাহর কাছে তাওবা-ইস্তিগফার করা, জিকির-আজকার ও পবিত্র কুরআন মাজিদ তিলাওয়াত করা। সব মৃত মুসলিম নর-নারী ও আত্মীয়স্বজনের রূহের মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা।
তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, নফল ইবাদতের কারণে যেন ফজরের নামাজ ছুটে না যায়। মহান আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন আমাদের সবাইকে যথাযথভাবে মহিমাময় শবেবরাতের রহমত ও বরকত হাসিল করার তাওফিক দিন। আমিন!
আলেম, প্রাবন্ধিক ও কলেজ শিক্ষক