বাবার মুখটা মনে নেই মো. রাজিব হোসেনের। অনেকদিন ক্যানসারে ভুগে তার বাবা যখন মারা যান, তখন রাজিবের বয়স মাত্র আড়াই বছর। সাভারের আশুলিয়ার রাজিব এখন মায়ের স্বপ্ন পূরণে খেলছেন ফুটবল।
মা বলেছেন, ভালো করে খেলবি, জাতীয় দলে জায়গা পেতে হবে। রাজিবের ধ্যানজ্ঞান এখন ফুটবল। দুই বছর আগে মোহামেডানের সঙ্গে চুক্তি করেছেন। সাদা-কালোদের রক্ষণের অন্যতম প্রহরী এখন ২০ বছরের রাজিব।
সকালে অনুশীলন শেষে সতীর্থরা যখন বিশ্রামে, তখন রাজিবকে দেখা গেলো এক বিদেশি নিয়ে প্রখর রোদে বল নিয়ে ঘাম ঝরাচ্ছেন মোহামেডানের মাঠে। মোহামেডানের এক কর্মকর্তা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, ‘ওই ছেলেটা এখন আমাদের রক্ষণের সেরা
খেলোয়াড়।’ মোহামেডানের অস্ট্রেলিয়ান কোচ শন লিন ও ম্যানেজার সাবেক ফুটবলার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব পছন্দ করে বিকেএসপি থেকে ক্লাবে এনেছেন রাজিবকে। কোচ ম্যানেজারকে হতাশ করেননি এই যুবক- প্রতিটি ম্যাচেই দারুণ সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছেন দলকে।
রাজিবরা চার ভাই ও দুই বোন। বড় ভাই স্থানীয় একজন জনপ্রতিনিধির গাড়িচালক। বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাইই কষ্ট করে সংসারের হাল ধরেন। তাতেও চলছিল না। মামার বাড়ি পাশেই। মামাদের সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে কোনো মতে চলতো রাজিবদের সংসার।
দুঃসময়ের ওই কাহিনি বলতে গিয়ে একটা হতাশাও ঝরলো রাজিবের কণ্ঠে। তার বাবার যখন ক্যানসারের চিকিৎসা চলছিল তখন জমিজমা কিছু বিক্রি করতে হয়েছিল। বাকি জমিজমা যা ছিল তার ন্যায্য ভাগ দেননি চাচারা।
‘আমার তিন চাচা। বাবা মারা যাওয়ার পর তারা আমাদের ঠকিয়ে সম্পত্তি নিয়ে গেছেন। মামারা পাশে না দাঁড়ালে আমাদের চলতেই কষ্ট হতো। এখন বড় ভাই রোজগার করেন, আমি ফুটবল খেলে কিছু পাই- এভাবেই চলছে’ বলছিলেন রাজিব।
রাজিব বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০১৬ সালে ট্রায়ালের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন। দুই বছর ধরে খেলছেন দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব মোহামেডানে।
রাজিবের ফুটবলার হওয়ার গল্পটা জানা যাক। মোহামেডানেই বা কীভাবে এলেন। ‘আমাদের এলাকার বড় ভাই মুরাদ। তিনি মোহামেডানের হয়ে খেলেছেন। তবে ইনজুরির কারণে বেশিদিন খেলতে পারেননি। তিনি এলাকায় খেলাধুলা নিয়ে কাজ করতেন। বিশেষ করে ফুটবল নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিলেন তিনি। তার উৎসাহেই আমি ২০১৬ সালে বিকেএসপিতে ভর্তির জন্য ট্রায়াল দেই এবং টিকে যাই। বিকেএসপির খরচ আমার বড় ভাই দিয়েছেন’ – ফুটবলার হওয়ার গল্প বলছিলেন রাজিব।
কথায় আছে মানিকে মানিক চেনে। যেমন রাজিবকে চিনেছিলেন মোহামেডানের সাবেক স্ট্রাইকার ও বর্তমানে ফুটবল দলের ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব ও দলটির অস্ট্রেলিয়ান কোচ শন লিন।
গত মৌসুমে মোহামেডান একটি প্রস্তুতি ম্যাচ খেলেছিল বিকেএসপির বিপক্ষে। ওই ম্যাচে মোহামেডানের ফরোয়ার্ডদের বেশ ভুগিয়েছিলেন ১৮ বছরের রাজিব। ওই ম্যাচে তার পারফরম্যান্স দেখেই মোহামেডান কোচ ও ম্যানেজার তাকে নিজেদের দলে নিয়ে আসেন।
রাজিব বলছিলেন তার স্বপ্ন পূরণের কথা, ‘আমি ছোট সময় থেকেই মোহামেডানের ভক্ত। দেশের ঐতিহ্যবাহী এই ক্লাবে খেলা ছিল আমার বড় স্বপ্ন। স্বপ্নটা ধরা দিয়েছে প্রিয় ক্লাবের বিপক্ষে খেলেই। ম্যাচের পর নকীব স্যার আমাকে বলেন মোহামেডানের হয়ে খেলবো কি না। টাকা-পয়সা বেশি দেওয়া যাবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যাই। টাকা আমার কাছে বড় বিষয় ছিল না। আমি মোহামেডানে খেলার সুযোগ পাচ্ছি সেটাই ছিল বড়।’
মোহামেডানের সঙ্গে আপনি কয় বছরের চুক্তি করেছেন? ‘মোহামেডানের সঙ্গে আমার চুক্তি তিন মৌসুমের। এক মৌসুম শেষ হয়েছে। এই মৌসুম খেলছি এবং আগামী মৌসুম খেলে চুক্তি শেষ হবে’- জবাব রাজিবের।
তবে তিনি মোহামেডান ছেড়ে যেতে চান না, ‘আমার স্বপ্নের ক্লাব মোহামেডান। এই ক্লাবে শুরু করেছি, এই ক্লাব থেকেই ক্যারিয়ার শেষ করতে চাই। যদি মোহামেডান আমাকে সে সুযোগ দেয়।’
সেন্ট্রাল ব্যাক রাজিব এখন পর্যন্ত হওয়া ৯ ম্যাচের মধ্যে ৮টিতেই খেলেছেন প্রথম একাদশে। তার সম্পর্কে সাবেক তারকা ফুটবলার ও মোহামেডানের ম্যানেজার ইমতিয়াজ আহমেদ নকীব বলেন, ‘রাজিবের বড়গুণ হলো তার চেষ্টা। সে প্রথমে রাইটব্যাক খেলতো। এখন স্টপারে খেলাচ্ছেন কোচ। বলের কাছে যাওয়া, চেজিং করা এবং ফাইট করার প্রবণতা বেশি ওর। প্রয়োজনে ওপরে ওঠে আক্রমণে সহায়তা করতে পারে, আবার দ্রুত নিচে নেমে পজিশনেও চলে আসতে পারে। আমি মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে জাতীয় দলের খেলা দেখলাম। আমার মনে হয়, রাজিবকে জাতীয় দলে ডাকা উচিত ছিল।’
ফুটবল খেলে যে টাকা পেয়েছেন রাজিব তা দিয়ে বড় ভাইয়ের কিছু দেনা ছিল তা শোধ করেছেন। বাড়িতে টিনের ঘর। এখন একটা ভালো ঘর দেওয়ার পরিকল্পনা আছে তার। দেশে রাজিবের প্রিয় খেলোয়াড় তপু বর্মণ ও ইয়াসিন খান এবং বিদেশে সার্জিও রামোস।
পরিবারের অন্য কেউ খেলাধুলা করেননি। মা এখন তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখছেন। যখনই মায়ের সঙ্গে কথা হয় রাজিবকে উপদেশ দেন এই বলে, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছ, পরিশ্রম করেছ। এখন একজন ভালো মানুষ হবে এবং ভালো ফুটবলার হবে। তোমাকে জাতীয় দলে খেলতে হবে।’
রাজিব অবশ্য জাতীয় দলে খেলে ফেলেছেন। সেটা অনূর্ধ্ব-১৬ জাতীয় দলে। এখন সিনিয়র জাতীয় দলে খেলার অপেক্ষায় ২০ বছরের এই যুবক।