যুক্তরাষ্ট্রের ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার দালিপ সিং সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন, কোনো দেশ মার্কিন বিধিনিষেধের বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে তার পরিণামও ভালো হবে না। তিনি গত সপ্তাহেই ভারতে সফর করে গিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন। অনেকটা ভারতকে রাশিয়ার কাছ থেকে দূরে ঠেলার উদ্দেশ্য নিয়েই দুদিনের এ সফরে এসেছিলেন দালিপ সিং। রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র যে ভালো চোখে দেখছে না তা বেশ স্পষ্টভাবেই বলে গিয়েছেন তিনি। একই সঙ্গে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, কোনো দেশ মার্কিন বিধিনিষেধের বিষয়টিকে উপেক্ষা করলে তার পরিণামও ভালো হবে না।
দালিপ সিংয়ের এমন মন্তব্য অনেক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। যদিও বিষয়টিকে মোটেও অস্বাভাবিক হিসেবে দেখছেন না পর্যবেক্ষকরা। তাদের ভাষ্যমতে, এখন পর্যন্ত আরোপিত যাবতীয় বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো জোরালো করে তুলেছে ভারত। বিষয়টি এরই মধ্যে মার্কিন প্রশাসনকে অস্বস্তিতে ফেলেছে। বিধিনিষেধের অন্যতম মূল কারিগর হিসেবে ভারতীয় বংশোদ্ভূত দালিপ সিংয়ের জন্য এ অস্বস্তির মাত্রা কিছুটা হলেও বেশি।
ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলর হিসেবে দালিপ সিংয়ের কাজের ক্ষেত্রটি হলো আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। মার্কিন ভূরাজনীতির অর্থনৈতিক বিষয়গুলো দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের ওপর অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ আরোপ ও তা প্রয়োগের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা এবং তা আরোপ ও প্রয়োগ করার কাজটিও মূলত তার অধীনেই ঘটে। বাইডেন প্রশাসনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কর্তাব্যক্তি হিসেবে এখন পর্যন্ত অনেক কঠিন দায়িত্বই সামলেছেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত তার জন্য সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব হলো রাশিয়ার ওপর আরোপিত মার্কিন বিধিনিষেধের কার্যকর প্রয়োগ নিশ্চিত করা। বিধিনিষেধের ক্ষেত্র নির্ধারণ করতে গিয়ে রুশ অর্থনীতির দুর্বল জায়গাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হয়েছে তাকে। এ কাজ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ করেন, রুশ অর্থনীতি মাইক্রোচিপ ও সফটওয়্যারের মতো পশ্চিমা প্রযুক্তির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। অন্যদিকে রাশিয়ার ব্যাংকগুলোরও বিদেশী মূলধনের ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর পশ্চিমা দেশগুলোর বিধিনিষেধ আরোপ ও প্রয়োগের কাজটিও হয়েছে তার তত্ত্বাবধানে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও কানাডায় দেশগুলোর স্থানীয় ব্যাংক খাতের ওপর রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেনে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত রয়েছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর ভাষ্য অনুযায়ী, আধুনিক বিশ্বে এখন পর্যন্ত রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতো বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহদায়তনের আর কোনো প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক বিধিনিষেধের খাঁড়ার তলে পড়েনি। বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিই দালিপ সিংকে মার্কিন প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের একজন করে তুলেছে বলে অভিমত পর্যবেক্ষকদের।
ভারতীয় শিখ পরিবারে জন্ম হলেও দালিপ সিং বড় হয়েছেন পুরোদস্তুর মার্কিন হিসেবে। ম্যারিল্যান্ডের ওলনিতে জন্মগ্রহণকারী দালিপ সিং বড় হয়েছেন নর্থ ক্যারোলাইনায়। গত জুনে হোয়াইট হাউজের জন্য লেখা এক নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, সত্তরের দশকেই তার পিতামাতা ভারত ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিয়েছিলেন।
ডিউক ইউনিভার্সিটির স্নাতক দালিপ সিং তার এমবিএ সম্পন্ন করেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি)। সেখানেও তার মূল বিষয় ছিল আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। জনপ্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেছেন হার্ভার্ড থেকে। মার্কিন রাজনীতিতে দালিপ সিংয়ের পরিবার অনেক আগে থেকেই জড়িত। মার্কিন কংগ্রেসের প্রথম এশিয়ান-আমেরিকান আইনপ্রণেতা দালিপ সিং সাউন্দ ও তিনি একই পরিবারের সদস্য।
রাজনীতিতে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠার আগে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান এসপিএক্স ইন্টারন্যাশনালের চিফ ইউএস ইকোনমিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন দালিপ সিং। এছাড়া কিছু সময়ের জন্য থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান আটলান্টিক কাউন্সিলের ননরেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। এছাড়া জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অ্যাডভান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজে শিক্ষকতা করেছেন দালিপ সিং।
বাইডেন প্রশাসনের অন্য অনেকের মতোই দালিপ সিংও ওবামা প্রশাসনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন ট্রেজারি বিভাগে ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেট ও ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে যোগ দেন দালিপ সিং। নিউইয়র্ক ফেডের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি সেখানে মার্কেটস গ্রুপের প্রধান হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন তিনি। গ্রুপটির কাজ হলো ব্যাংকের নীতি ও কৌশল নির্ধারণ এবং অন্যান্য পরিচালন ও বিশ্লেষণমুখী কার্যক্রম তত্ত্বাবধান করা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাইডেন প্রশাসনের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলে ডেপুটি ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হিসেবে যোগ দেন দালিপ সিং। এর পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলেও ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে নিযুক্ত রয়েছেন তিনি।