শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৬:৫০ অপরাহ্ন

রক্তাক্ত এক ইতিহাসের সাক্ষী মহান মে দিবস

খবরপত্র ডেস্ক
  • আপডেট সময় শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০২২

আজ মহান মে দিবস। এ দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবেও পরিচিত পহেলা মে। বরাবরই বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ দিনটিকে উদযাপন করা হয়। তবে মহামারির এই সময় গত বছরের মতো এবারও সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস। বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় ৮০টি দেশে পয়লা মে জাতীয় ছুটির দিন। আরো অনেক দেশে এটি বেসরকারিভাবে পালিত হয়। ‘শ্রমিক-মালিক নির্বিশেষ, মুজিববর্ষে গড়বো দেশ’- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে দেশে পালিত হচ্ছে এবারের মে দিবস। রক্তাক্ত এক ইতিহাসের সাক্ষী মে দিবস। শ্রমিকরা সেদিন রক্তের বিনিময়ে নিজেদের অধিকার আদায়ে মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘদিনের অমানুষিক পরিশ্রম আর কম পারিশ্রমিক পাওয়া শ্রমিকরা মালিকপক্ষের উপর গর্জে উঠেছিলেন। শ্রমিকদের দাবি ছিল, ‘৮ ঘণ্টা কাজ, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম আর ৮ ঘণ্টা নিজের জন্য’। তারা প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা কিংবা তার চেয়েও বেশি সময় কাজ করত কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। এই দীর্ঘ কর্মঘণ্টার প্রভাব পড়ে দৈনন্দিন জীবনে। তাই বিশ্বের নানা প্রান্তের শ্রমিক সংগঠনগুলো ৮ ঘণ্টা কাজকে আদর্শ কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিক আন্দোলনই মহান মে দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস নামে পরিচিত। শ্রমজীবী মানুষকে আরও সাহস জোগায় এই দিনটি। সব ধরনের অন্যায় আর অমানবিকতার বিপক্ষে গর্জে ওঠার পথ দেখায়।
মে দিবসে যা ঘটেছিল: আমেরিকার শিকাগো শহর তখন শিল্পায়নের অন্যতম কেন্দ্র। কাজের খোঁজে শিকাগোতে মার্কিন, জার্মান এবং ইউরোপের শ্রমিকেরা কাজের খোঁজে আসতে শুরু করেন। মাত্র গড়ে দেড় ডলারের বিনিময়ে তারা দিন-রাত কলুর বলদের মতো শ্রম দিয়ে যাচ্ছিলেন। এর উপর আবার সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করতে হবে। অনেকটা যন্ত্রমানবের মতো কাজ করার যন্ত্র হয়ে উঠেছিল শ্রমিকরা। কষ্ট হলেও তারা মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে পারতেন না। কারণ শ্রমিকরা তখনও সংঘবদ্ধ হয়ে ওঠেননি। অনেকেই বিভিন্ন সময়ে ৮ ঘণ্টাকে প্রমাণ কর্মঘণ্টা হিসেবে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে মালিকের হাতে নিপীড়িত ও নির্যাতিত হয়েছেন। এর ফলে অন্য শ্রমিকদের মনেও ভয়ের সঞ্চার করা হয়েছে। এরপর শ্রমিকরা যখন আর সহ্য করতে পারছিরেন না; তখন তারা সংঘবদ্ধ হওয়ার পরিকল্পনা করেন।
আমেরিকার শিকাগো, নিউ ইয়র্ক, উইসকনসিন এবং বিভিন্ন রাজ্যে গড়ে ওঠে সংঘবদ্ধ আন্দোলন। ১৮৮৪ সালের অক্টোবরে আমেরিকার ‘ফেডারেশন অব অর্গানাইজড ট্রেডস এন্ড লেবার ইউনিয়নস’ এর এক বৈঠকে ৮ ঘণ্টা কাজের সময় প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর আমেরিকার বিভিন্ন লেবার ইউনিয়নের সম্মতিক্রমে ১৮৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে সাধারণ ধর্মঘট ডাকা হয়। দাবি ছিল একটাই, দৈনিক ৮ ঘন্টার বেশি কাজ আর নয়। ধর্মঘটের বিপক্ষে মালিকপক্ষ আন্দোলনকে মোকাবেলা করতে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের গ্রেফতার করে। এ ছাড়াও বিভিন্ন শ্রমিকদের উপর নির্যাতন করতে থাকে। মালিকপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া ১৪-১৬ ঘণ্টা কাজের বেড়াজাল ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে প্রাণপণ লড়াই করে শ্রমিকরা। ১৯৮৬ সালের মে মাসের ১-৩ তারিখ পর্যন্ত এই আন্দোলন চলমান ছিল। এরপর শিকাগোর বিক্ষোভরত শ্রমিকদের উপর চড়াও হয় পুলিশরা। শিকাগোর ম্যাককরমিক হারভেস্টিং মেশিন কোম্পানির সামনে পুলিশ গুলি চালায় শ্রমিকদের উপর। শত শত শ্রমিক আহত হয়, নিহত হয় দুই জন। এই হতাহতের কারণে শ্রমিকরাও উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এর পরের দিন হাজার হাজর শ্রমিকরা আন্দোলনের পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে শিকাগোর ‘হেমার্কেট স্কয়ারে’ সমাবেত হন। আগের দিন পুলিশকে লক্ষ্য করে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি বোমা ছুঁড়েছিলেন। এর পরপরই পুলিশ এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে শুরু হয় উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষে সাতজন পুলিশ এবং চারজন শ্রমিক নিহত হয়। দাবি আদায় করতে আসা শত শত নিরস্ত্র শ্রমিক হতাহত হয়। পৃথিবীর শ্রমিক সংগ্রামের ইতিহাসে রক্তাক্ষরে এটি লেখা হয়ে থাকে ‘হেমার্কেট ম্যাসাকার’ নামে। তবে পুলিশের উপর সেদিন কে বা কারা বোমা নিক্ষেপ করেছিলেন তা আজও অমিমাংসিত। এই রক্তাক্ত ঘটনার পর মার্কিন সরকার শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। নৈরাজ্যবাদী হিসেবে ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে গ্রেফতারের বিষয়টি বেশ সাড়া ফেলে। হেমার্কেট ম্যাসাকারে যুক্ত থাকার অভিযুক্ত হওয়া ৮ জনের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যুদ- আর একজনকে ১৫ বছর কারাদ- দেওয়া হয়। তখন আইন বিচার ব্যবস্থা শ্রমিকদের মূল দাবি ‘৮ ঘন্টা কর্মঘণ্টা’ এই দাবিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যায়। এরপর ১৮৮৯ সালের মে মাসের ১ তারিখকে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস’ বলে ঘোষণা দেয় ‘ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর ওয়ার্কার্স এন্ড সোসালিস্টস’। হেমার্কেট ম্যাসাকারকে শ্রমিক আন্দোলনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। যদিও আমেরিকার সরকার এই ঘটনার কোনো স্বীকৃতি দেয়নি এবং শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কাজের দাবিকেও গুরুত্ব দেয়নি। এরপর প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯১৬ সালে আমেরিকা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিকে আইনি স্বীকৃতি দেই। ১৯১৭ সালে দ্বিতীয় নিকোলাসের পতনের ৪ দিন পর আমেরিকা সরকারি ঘোষণার মাধ্যমে ‘দিনে ৮ কর্মঘণ্টা’র স্বীকৃতি দেয়। ১৯১৭ সালের পর থেকেই সোভিয়েত ক্ষমতাবলয়ে থাকা দেশগুলোতে মে মাসের ১ তারিখে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বেশ জাকজমকতার সঙ্গে পালন করা শুরু হয়। সোভিয়েত পতনের পরে রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক দেশেই পালন হয় না এখন আর মে দিবস। তবে এখনো বিশ্বের ৮০টি দেশে এই দিন সরকারি ছুটি হিসেবে চিহ্নিত।




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com