প্রতিটি মানুষের জন্ম ও মৃত্যু হলো অনিবার্য বাস্তবতা। কেউ মৃত্যুতে বিশ্বাস রাখুক বা না রাখুক তাকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। আর জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী যে দুনিয়ার জীবন-সেটিই হলো মানুষের কর্মক্ষেত্র তথা পরীক্ষার স্থান। এখানে কোনো ব্যক্তি যে কাজ বা আমল করবে তার পরিণাম ভোগ করবে পরবর্তী জীবনে। মৃত্যুরেখা পার হওয়ার পর আর কোনো আমলনামা নেই। মৃত ব্যক্তি দুনিয়ায় যদি সৎ সন্তান, সৎ কাজ এবং সৎও কল্যাণের কোনো প্রক্রিয়া রেখে যান তার ফল তিনি মৃত্যুর পরও পাবেন। তবে তার সে কাজ মৃত্যুর আগের হতে হবে, পরের নয়। দুনিয়ার জীবনে যারা আল্লাহকে ভয় করে চলেছে, মুত্তাকির জীবনযাপন করেছে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছে তাদের আমলনামা আর যারা এর বিপরীত পথ গ্রহণ করেছে তাদের আমলনামা কী একই স্থানে থাকবে বা দুয়ের মর্যাদা কী একই হবে? এ ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেন, ‘কখনো নয়, নিশ্চয় নেককার লোকদের আমলনামার স্থান থাকবে ইল্লিয়্যিনে। তুমি কি জানো ‘ইল্লিয়্যিন’ কী ? তা হচ্ছে খোদাই করা (তালিকার ) রেকর্ড’। (সূরা আল-মুতাফ্ফিফীন, আয়াত : ১৮-২০) আব্দুল্লাহ ইবন্ আব্বাস রা: বলেন, ‘ইল্লিয়্যিন’ অর্থ জান্নাত, অথবা সপ্তম আকাশে আরশের নিচে অবস্থিত একটি স্থান। (তাফসিরে বগবি, ৪৬০/৪, তাফসিরে ইবন কাসির ৪৮৭/৪) আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘আকাশে রয়েছে তোমাদের রিজিক ও প্রতিশ্রুত সব কিছু’। (সূরা আয-যারিয়াত, আয়াত : ২২) ইমাম ইবনে কাসিরের তাফসিরে বলেন, ‘এখানে তোমাদের রিজিক’ অর্থ বৃষ্টি আর ‘তোমাদের যা প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে’ তার অর্থ জান্নাত। (তাফসিরে ইবনে কাসির ২৩৬/৪)
কারো কারো মতে ইল্লিয়্যিন শব্দটি উলুয়ুন-এর বহুবচন। এর উদ্দেশ্য উচ্চতা। আবার কেউ কেউ বলেন, এটা জায়গার নাম-বহুবচন নয়। (কুরতুবি; ইবন কাসির) বারা ইবনে আযেব রা:-এর হাদিসে এসেছে যে, ফেরশেতাগণ রুহ নিয়ে উঠতেই থাকবেন ‘শেষ পর্যন্ত যখন সপ্তম আসমানে উঠবেন তখন মহান আল্লাহ বলবেন, আমার বান্দার কিতাব ইল্লিয়্যিনে লিখে নাও।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৪/২৮৭) এ থেকে প্রমাণ পাওয়া যায়, ইল্লিয়্যিন সপ্তম আকাশে আরশের কাছে এক স্থানের নাম। এতে মুমিনদের রুহ ও আমলনামা রাখা হয়। (ইবন কাসির) তাফসিরে জাকারিয়ায় বলা হয়েছে, ইল্লিয়্যিন শব্দটি হলো ‘সিজ্জিন’ শব্দের বিপরীত। এটা আসমানে অথবা জান্নাতে কিংবা সিদরাতুল মুন্তাহায় কিংবা আরশের নিকটবর্তী এক স্থান। যেখানে নেক লোকদের আত্মা এবং তাদের আমলনামা সংরক্ষিত আছে। যার নিকটে আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত ফিরিশতা উপস্থিত হন।
ইল্লিয়্যিন হলো মূলত একটি কোরানিক শব্দ যা জান্নাতের উপরে ‘সবচেয়ে উচ্চ’ স্থানগুলোকে নির্দেশ করে। এর অর্থ হলো বেহেশত বা উদ্যান। আল্লাহর আরশের নিকটতম স্থানে এটি রয়েছে। এটাকে পুনরুত্থানের পূর্বে মুমিনদের আবাস হিসেবেও বোঝানো যায়। অন্য দিকে সিজ্জিন হলো প্রচ- যন্ত্রণা বা জাহান্নামের নিচে বা জাহান্নামের সীমাবদ্ধ পরিস্থিতি সম্বলিত একটি কারাগার। এক ব্যাখ্যা অনুসারে, অভিশপ্ত বা দুষ্টদের রেকর্ডের জন্য এটি একটি নিবন্ধন। এ ব্যাপারে পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় পাপাচারীদের আমলনামা সিজ্জিনে আছে’। (সূরা আল-মুতাফফিফিন, আয়াত : ৭) সিজ্জিনকে পুনরুত্থান পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের আত্মার স্থান হিসেবেও বিবেচনা করা হয়। পৃথিবীর পৃষ্ঠের শিকড়ের নিচে একটি দোজখ রয়েছে এমন ধারণা কুরআনে পাওয়া যায় (৬৫:১২) সূরা তালাক ‘এর এই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহই সৃষ্টি করেছেন সপ্ত আকাশ এবং পৃথিবীও অনুরূপ, ওগুলোর মধ্যে নেমে আসে তাঁর নির্দেশ, যাতে তোমরা বুঝতে পার যে, অবশ্যই আল্লাহ সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান এবং জ্ঞানী, আল্লাহ সবকিছুকে পরিবেষ্টন করে রয়েছেন।’ এখানে জাহান্নামকে একটি ভূগর্ভস্থ গর্ত হিসাবে বর্ণনা করা হয়, যাকে সাতটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। ব্যাখ্যাকাররা জাহান্নামকে পৃথিবীর স্তরের সাথে মিলিয়েছেন যার নিচে সিজ্জিন বা যন্ত্রণাদায়ক স্থান রয়েছে। একটি বিশেষণ হিসেবে এই শব্দের অর্থ হলো ‘প্রকট’ বা ‘তীব্র’ এবং এটি কারাবাসের সাথে সম্পর্কিত। জেল বা কারাগার সিজ্জিনের আরবি শব্দ। কারাগারে ইউসুফের বর্ণনার সাথে সূরা ইউসুফে বেশ কয়েকবার এটি এসেছে।
সূরা আল আম্বিয়ার একটি আয়াতে (২১:১০৪) সিজ্জিল আবির্ভূত হয় এবং ‘ স্ক্রোল’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই আয়াতে বলা হয়েছে, ‘সেদিন আমি আকাশকে গুটিয়ে ফেলব, যেভাবে গুটানো হয় লিখিত দফতর; যেভাবে আমি সৃষ্টির সূচনা করেছিলাম, সেভাবে পুনরায় সৃষ্টি করব। প্রতিশ্রুতি পালন আমার কর্তব্য; আমি এটা পালন করবই।’
কিছু ব্যাখ্যাকারী যারা সিজ্জিন শব্দটিকে অভিশপ্তের জন্য একটি নিবন্ধক বা পাপীদের নাম তালিকাভুক্ত একটি বই হিসেবে ব্যাখ্যা করেন তারা দুটি শব্দের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেন। তাবারি তার তাফসিরে সিজ্জিনের অর্থ সম্পর্কে মূলত দুটি ভিন্ন মতামত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, এটি পাপীদের মন্দ কাজ সম্বলিত একটি বই : ‘তাদের কাজ সর্বনিম্ন পৃথিবীর একটি বইতে রয়েছে।’ অভিশপ্তদের জন্য এটি একটি কারাগার : ‘এটি সপ্তম সর্বনিম্ন পৃথিবী, যেখানে শয়তান (ইবলিস) শৃঙ্খলিত এবং এতে কাফেরদের আত্মা রয়েছে।’
সুফি নেতারা নরকের সাতটি দরজাকে একটি নির্দিষ্ট পাপের সাথে যুক্ত করেছেন। ১২০৩ এবং ১২৪০ সালের মধ্যে ইবনে আরাবির রচিত আল-ফুতুহাত আল-মাক্কিয়ায় জাহান্নামের প্রতিটি স্তরকে একটি নির্দিষ্ট শরীরের অংশের সাথে সম্পর্কযুক্ত করে কল্পনা করা হয়, সিজ্জিন হলো এর গভীরতম স্থান। এখানে বলা হয়- জাহান্নাম হলো পা, আল-জাহিম-যৌনাঙ্গ, আল-সা’ইর-পেট, সাকার-হাত, লাজা-জিহ্বা, আল-হুতামা-কান, সিজ্জিন হলো চোখ। দুনিয়া হলো মানুষের জন্য একটি পরীক্ষা ক্ষেত্র। দুনিয়ার জীবন শেষে সেই পরীক্ষা ক্ষেত্রে মানুষ আর প্রবেশ করতে পারবে না। মানুষের চূড়ান্ত বিচার হবে কিয়ামত বা শেষ বিচারের দিন। মৃত্যু ও শেষ বিচারের মধ্যবর্তী সময় সৎ কর্মকারীদের স্থান হিসেবে আমরা ইল্লিয়্যিন এবং দুষ্কর্মকারীদের স্থান হিসেবে আমরা সিজ্জিনকে চিন্তা করতে পারি। আল্লাহ আমাদের দুনিয়ায় সিজ্জিন থেকে পরিত্রাণ এবং ইল্লিয়্যিন এ স্থান পাওয়ার মতো আমল করার তৌফিক দান করুন।