কথায় আছে, দশে মিলে করি কাজ হারজিত নাহি লাজ। একটা কাজ সকলে মিলে সম্পন্ন করলে সে কাজটিতে সফলতা বা বিফলতা যেটাই আসুক তাতে কোনো লাজ-লজ্জা থাকে না। মানবতার ধর্ম ইসলাম পরামর্শভিত্তিক কাজ করার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। ইসলামী শরিয়াতে, কোনো কাজ সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে সম্পন্ন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সহযোগীদের সাথে যোগাযোগ ও মতবিনিময় বা যে মতামত পেশ করা হয় তাই পরামর্শ। পরিবার-সমাজ এবং রাষ্ট্রের কার্যাবলি পরিচালনা পরামর্শভিত্তিক হওয়া বাঞ্ছনীয়। পরামর্শের ভিত্তিতে প্রতিটি কাজ পরিচালনা এবং সমস্যার সমাধান হলে আল্লাহ তায়ালা তাতে সাহায্য করেন। আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক ক্ষেত্রে পরামর্শের ভিত্তিতে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। কি ব্যক্তিগত, কি পারিবারিক, কি রাষ্ট্রীয় জীবনে, সর্বস্তরে পরিবার-পরিজন জ্ঞানী-গুণী ও বিশ্বাসী লোকের পরামর্শ নেয়া প্রয়োজন। আল্লাহ বলেন, ‘এবং কাজে-কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করুন। অতঃপর যখন কোনো কাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ফেলেন, তখন আল্লাহ তায়ালার ওপর ভরসা করুন। আর আল্লাহ তায়ালা ভরসাকারীদের ভালোবাসেন।’ (সূরা আলে ইমরান-১৫৯)
রাসূলুল্লাহ সা: প্রত্যেকটি কাজ পরামর্শের ভিত্তিতে করতেন। ব্যক্তি-পরিবারিক কাজের জন্য পরিবারের সদস্যের সাথে পরামর্শ করতেন। জিহাদের ময়দানে যুদ্ধে অভিজ্ঞ সাহাবাদের থেকে পরামর্শ, রাষ্ট্র পরিচালনায় শাসনকার্যে পারদর্শী সাহাবাদের থেকে পরামর্শ গ্রহণ করতেন। তিনি সাহাবাদের নিয়ে মাজলিস-উস শূরা বা পরামর্শ সভা করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: এ বিষয়ে অত্যন্ত সজাগ ছিলেন। তিনি প্রতি রাতে হজরত আবু বকর রা: ও উমর রা:-এর সাথে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ করতেন। হজরত উমর ইবনে খাত্তাব রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: রাতে মুসলিম উম্মাহর সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আবু বকর রা:-এর সাথে পরামর্শ করতেন। আমিও তাদের সাথে থাকতাম। (জামে আত তিরমিজি) বেশি বেশি পরামর্শ করা রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ ছিল। হজরত আয়েশা রা: হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা: অপেক্ষা লোকজনের সাথে অধিক পরামর্শকারী কোনো ব্যক্তিকে দেখিনি। (আখলাকুন্নবী-৭২৭)। বদর যুদ্ধে রাসূল সা: সাহাবিদের নিয়ে যখন বদর কূপের কাছে শিবির স্থাপন করতে যান তখন হুবাব ইবনে মুনযির রাসূলুল্লাহ সা:-কে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ স্থান কি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত, না আপনার অভিমত ও রণকৌশল হিসেবে বেছে নিয়েছেন? তিনি বললেন- এটা আমার অভিমত। হুবাব রা: বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ স্থানটি যুদ্ধের জন্য খুব সুবিধাজনক নয়। আপনি সৈন্যবাহিনী নিয়ে শত্রুদের কাছাকাছি পানির কূপের নিকট চলুন। সেখানে আমরা অবস্থান করি। এরপর আশপাশের সব কূপ নষ্ট করে দেই। আমাদের অবস্থানের কাছে একটি জলাধার তৈরি করে তাতে পানি ভর্তি করে রাখি। যুদ্ধের সময় আমরা পানি পান করব কিন্তু কুরাইশরা পান করতে পারবে না। রাসূল সা: বললেন, তুমি একটা ভালো পরামর্শ দিয়েছ।
আল্লাহ তায়ালা ফেরশতার মাধ্যমে রাসূল সা: কে জানিয়ে দিলেন, হুবাব ইবনে মুনযির রা: যে পরামর্শ দিয়েছেন তা সঠিক। এ পরামর্শের আলোকে তিনি বদর প্রান্তে সৈন্য সমাবেশ করেন। অনুরূপভাবে খন্দকের যুদ্ধে হজরত সালমান ফারসি রা:-এর পরামর্শে পরিখা খনন করেন। সাহাবিরা রাসূলুল্লাহ সা:-এর আদর্শ অনুসারে পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। তাদের আমলের স্বীকৃতিস্বরূপ ইরশাদ হচ্ছে, তাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়। (সূরা শূরা-৩৮) যেখানে কাজ-কর্ম পরামর্শের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় সেখানে শান্তির সুবাতাস বইতে থাকে। রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেছেন, যখন তোমাদের নেতারা হবেন ভালো মানুষ, ধনীরা হবেন দানশীল এবং তোমাদের কার্যক্রম চলবে পরামর্শের ভিত্তিতে তখন মাটির উপরিভাগ নিচের ভাগ থেকে উত্তম হবে (জামে আত তিরমিজি)। খোলাফায়ে রাশেদার শাসনামলে খলিফাগণ সব কাজ পরামর্শের আলোকে সম্পন্ন করতেন। তাদের পরামর্শভিত্তিক কার্যপরিচালনা শুধু রাষ্ট্র পরিচালনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। বরং ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, প্রতিষ্ঠান সর্বক্ষেত্রে এর বিস্তৃতি ছিল। আজ আমাদের সমাজের চিত্র ভিন্ন। অনেক ক্ষেত্রে পরিবার বা সমাজের কর্তা ব্যক্তিই অন্যদের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়। ফলে পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও শ্রদ্ধাবোধের কমতি পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় পিতা-সন্তানের মধ্যেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। যা শান্তিপূর্ণভাবে বসবাসের অন্তরায়। তাই সব কার্য পরিচালনায় বিশেষ করে পারিবারিক কাজে সদস্যের সাথে পরামর্শ করলে, পরিবার ও সমাজ হবে আরো শান্তি ও ভালোবাসাপূর্ণ। যে পরামর্শ করে কাজ করে সে নিরাপদ থাকে। সুতরাং যে ব্যক্তি পরামর্শ নিয়ে কাজ করে তাকে কখনো লজ্জিত হতে হয় না। আর যে বা যারা ভেবে-চিন্তে ইস্তেখারা করে কাজ করে তাকে ঠকতে হয় না। লেখক : শিক্ষার্থী, আল কুরআন অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়।