আত্মসম্মানবোধ মানুষের ব্যক্তিত্বের অন্যতম প্রধান দিক। ইসলাম মানুষকে আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন হতে বলে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, মুমিন আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আর আল্লাহ তাদের চেয়ে বেশি আত্মমর্যাদা বোধসম্পন্ন। (মুসলিম, হাদিস : ২৭৬১) আল্লাহর এই আত্মমর্যাদা থেকেই তিনি কেউ তাঁর অবাধ্য হলে তার ওপর নারাজ হন। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলার আত্মমর্যাদাবোধ আছে এবং আল্লাহর আত্মমর্যাদাবোধ এই যে যেন কোনো মুমিন বান্দা হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে না পড়ে। (বুখারি, হাদিস : ৫২২৩)
গুনাহ করতে করতে গুনাহগারের অন্তর থেকে ইসলামী চেতনায় লালিত আত্মসম্মানবোধ একেবারেই বিনষ্ট হয়ে যায়। যার ঈমান যতই মজবুত, তার এই আত্মমর্যাদাবোধ তত মজবুত। এর বিপরীতে যার ঈমান যত দুর্বল তার আত্মমর্যাদাবোধ তত দুর্বল। এ কারণেই তা পূর্ণাঙ্গরূপে পাওয়া যায় রাসুলদের মধ্যে। এরপর ঈমানের তারতম্য অনুযায়ী অন্যদের মধ্যেও। সাদ বিন উবাদা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি কাউকে আমার স্ত্রীর সঙ্গে ব্যভিচার করতে দেখলে তৎক্ষণাৎ তার গর্দান উড়িয়ে দেব। এ উক্তি রাসুল (সা.)-এর কানে পৌঁছতেই তিনি বলেন, তোমরা কি আশ্চর্য হয়েছ সাদের আত্মসম্মানবোধ দেখে? আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আমার আত্মসম্মানবোধ তার চেয়েও বেশি এবং আল্লাহ তাআলার আরো বেশি। যার দরুন তিনি হারাম করে দিয়েছেন প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব ধরনের অশ্লীলতা। (বুখারি, হাদিস : ৬৮৪৬; মুসলিম, হাদিস : ১৪৯৯)
আত্মমর্যাদা অহংকার নয়। অহংকার হলো সত্য প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে হেয় করা। আত্মমর্যাদা ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, কোনো একসময় রাসুল (সা.) তাঁর একজন স্ত্রীর কাছে ছিলেন। ওই সময় উম্মুহাতুল মুমিনিনের অন্য একজন একটি পাত্রে কিছু খাদ্য পাঠালেন। যে স্ত্রীর ঘরে নবী (সা.) অবস্থান করছিলেন ওই স্ত্রী খাদিমের হাতে আঘাত করলেন। ফলে খাদ্যের পাত্রটি পড়ে ভেঙে যায়। নবী (সা.) পাত্রের ভাঙা টুকরাগুলো কুড়িয়ে একত্রিত করলেন, তারপর খাদ্যগুলো কুড়িয়ে তাতে রাখলেন এবং বললেন, তোমাদের আম্মাজির আত্মমর্যাদাবোধে আঘাত লেগেছে। তারপর তিনি খাদিমকে অপেক্ষা করতে বলেন এবং যে স্ত্রীর কাছে ছিলেন তাঁর কাছ থেকে একটি পাত্র নিয়ে যার পাত্র ভেঙেছে, তার কাছে পাঠালেন এবং যিনি ভেঙেছেন ভাঙা পাত্র তার ঘরেই রাখলেন। (বুখারি, হাদিস : ৫২২৫)
ওমর (রা.)-এর আত্মমর্যাদার ব্যাপারে সজাগ ছিলেন মহানবী (সা.)। জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রা.) থেকে বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, আমি জান্নাতে প্রবেশ করে একটি প্রাসাদ দেখতে পেলাম এবং জিজ্ঞেস করলাম, এটি কার প্রাসাদ? তাঁরা (ফেরেশতারা) বললেন, এ প্রাসাদ ওমার ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর। আমি তার মধ্যে প্রবেশ করতে চাইলাম; কিন্তু (হে ওমর) তোমার আত্মমর্যাদাবোধ আমাকে সেখানে প্রবেশে বাধা দিল। এ কথা শুনে ওমর (রা.) বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কোরবান হোক! আপনার কাছেও আমি (ওমর) আত্মমর্যাদাবোধ প্রকাশ করব? (বুখারি, হাদিস : ৫২২৬) আত্মমর্যাদাবোধের কারণে ব্যভিচার নিষিদ্ধ। রাসুল (সা.) বলেন, হে আমার উম্মত! আল্লাহর কসম খেয়ে বলছি, আল্লাহ তাআলার চেয়ে আর কারো আত্মসম্মানবোধ বেশি হতে পারে না। যার দরুন তিনি চান না যে তাঁর কোনো বান্দা বা বান্দি ব্যভিচার করুক। (বুখারি, হাদিস : ১০৪৪; মুসলিম, হাদিস : ৯০১)
তবে শরিয়তের দৃষ্টিতে যুক্তিসংগত কোনো ওজর বা কৈফিয়ত গ্রহণ করা ওই আত্মসম্মানবোধবিরোধী নয়। বরং তা প্রশংসনীয়ও বটে। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ তাআলার চেয়ে বেশি আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন আর কেউ নেই। এ কারণে তিনি প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সব অশ্লীলতা হারাম করে দিয়েছেন এবং আল্লাহ তাআলার চেয়ে কারো যুক্তিসংগত কৈফিয়ত গ্রহণ করা বেশি পছন্দ করেনÍএমন আর কেউ নেই। এ জন্যই তিনি কিতাব নাজিল করেন এবং রাসুল প্রেরণ করেন। অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলার চেয়েও অন্যের প্রশংসা বেশি পছন্দ করেনÍএমন আর কেউ নেই। এ কারণেই তিনি নিজের প্রশংসা নিজেই করেন। (বুখারি, হাদিস : ৪৬৩৪; মুসলিম, হাদিস : ২৭৬০)
তবে আত্মসম্মানবোধ হতে হবে যুক্তিসংগত। জাবির বিন আতিক (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) ইরশাদ করেন, কিছু আত্মসম্মানবোধ আল্লাহ তাআলা পছন্দ করেন আর কিছু অপছন্দ। পছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো, যা হবে যুক্তিসংগত। আর অপছন্দনীয় আত্মসম্মানবোধ হলো, যা হবে অযৌক্তিক। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৬৫৯)
কারো মধ্যে আত্মসম্মানবোধ দুর্বল হয়ে গেলে সে আর গুনাহকে গুনাহ বলে মনে করে না। নিজের ব্যাপারেও না, অন্যের ব্যাপারেও না। কেউ কেউ গুনাহ করতে করতে ধীরে ধীরে এমন পর্যায়ে উপনীত হয় যে সে গুনাহকে সুন্দররূপে অন্যের কাছে উপস্থাপন করে। অন্যকে সে গুনাহ করতে বলে এবং করার জন্য উৎসাহ জোগায়। বরং তা সংঘটনের জন্য তাকে সহযোগিতাও করে থাকে। এ কারণেই ‘দাইয়ুস’ জান্নাতে যাবে না। ‘দাইয়ুস’ ওই ব্যক্তি, যে নিজ পরিবারের শ্লীলতাহানি হলেও তা সহজেই সহ্য করে যায়। এমন ব্যক্তির আত্মমর্যাদাবোধ বলতে কিছু নেই। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করুন।