বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে কটূক্তিমূলক মন্তব্য করার অভিযোগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় সাত বছরের কারাদ- দেয়া হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীকে। গত সোমবার ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ দণ্ড দিয়েছেন বলে জানান প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম। কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ওই শিক্ষার্থী শামসুল আলম বাবু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ছাত্র। ২০১৫ সালে ওই ঘটনার পর তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়। ওই মামলার বিচারে সোমবার রায় ঘোষণা করে ট্রাইব্যুনাল। তবে রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিবাদী পক্ষের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
প্রসিকিউটর নজরুল ইসলাম শামীম বলেন, একটি ফেসবুক আইডিতে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী নিয়ে লেখা একটি পোস্টে তিনি খুবই আপত্তিজনক বাজে কমেন্ট করেন। সেটা ভাইরাল হওয়ার পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে রিয়্যাক্ট হয়। ওই ছেলেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আটকে রাখেন। পরে ভিসির অনুরোধ এক ছাত্র মামলা করে। ওই মামলায় গত সোমবার তার সাজা হয়েছে। রায় ঘোষণার সময় জামিনে থাকা শামসুল আলম আদালতে উপস্থিত ছিলেন। দণ্ড ঘোষণার পর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রায়ে বলা হয়, আসামির বয়স ২৩ বছর। তার স্বল্প বয়স বিবেচনায় তাকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে ন্যূনতম সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হলো। মামলার বিবরণ থেকে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ৪ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে শিক্ষার্থী আল আমিন সেতুর লেখা একটি কলামের অংশ ফেসবুকে শেয়ার করেন মোরশেদুর আকন্দ নামের আরেকজন শিক্ষার্থী। ওই পোস্টে ’কবির মামু’ নামের একটি আইডি থেকে মন্তব্য করেন শামসুল আলম বাবু। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই শিক্ষার্থীকে আটক করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে। ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট তার বিরুদ্ধে তথ্য-প্রযুক্তি আইনের মামলা হয়। ২০১৬ সালের ২১ জুলাই অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে তার বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে বাংলাদেশে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের কিছু ধারা বিলুপ্ত করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করা হয়। ওই আইনে ৫৭ ধারা বিলুপ্ত করা হয়, তবে এ ধারার অপরাধগুলোকে বিস্তারিতভাবে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় কয়েকজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও সাংবাদিকদের কারাগারে নেয়ার একাধিক ঘটনা তীব্র সমালোচনা তৈরি করেছিল। সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের তরফ থেকে এটি নিবর্তনমূলক আখ্যা দিয়ে আইসিটি আইন বাতিলের দাবি করা হয়েছিল। এ আইনে সাংবাদিক প্রবীর শিকদার, খুলনার সাংবাদিক আব্দুল লতিফ মোড়ল, লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুলসহ অনেকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় ২০১৭ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত ২০ জন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা হয়। ওই বছর প্রথম ছয় মাসে মামলা হয়েছিল ৩৯১টি। শুরু থেকেই সম্পাদক, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা এ আইনকে কালো আইন আখ্যায়িত করে এটি বাতিলের দাবি জানিয়ে এসেছেন।
গণমাধ্যম কর্মীদের হয়রানিতে আইনটি ব্যবহার হচ্ছে জানিয়ে একাধিকবার ওই আইন বাতিলের দাবি জানায় বাংলাদেশের সম্পাদক পরিষদ। সংবাদপত্র মালিকদের সমিতি নোয়াব ও টিভি মালিকদের সমিতি অ্যাডকো এক যৌথ বৈঠকে একমত হয়েছিল, ৫৭ ধারার অপ্রপ্রয়োগ হচ্ছে ও সাংবাদিকদের মত প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচ একাধিক বিবৃতিতে বলে, আইসিটি আইনের কিছু ধারা মত প্রকাশের প্রতি হুমকিস্বরূপ।
ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট গঠনের সময় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ঘোষণা করেন, নতুন আইনে ৫৭ ধারা থাকবে না। যেদিন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট অনুমোদন করে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভা, সেদিন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, আমি কথা দিয়েছিলাম ৫৭ ধারা থাকবে না। আজ মন্ত্রিসভা ৫৭ ধারা নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সে বিতর্কের অবসান ঘটালো। কিন্তু নতুন আইনেও ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে আক্রমণাত্মক, মিথ্যা, ভীতি প্রদর্শক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ, মানহানিকর তথ্য প্রকাশ, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানো, ঘৃণা প্রকাশ, অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহ, প্রকাশ বা ব্যবহার করলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। সূত্র : বিবিসি