সরকারের মোট রাজস্বের ৮৫ শতাংশেরও বেশি আহরণের দায়িত্ব থাকছে এনবিআরের কাঁধে। আগামী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এনবিআরের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে এক কর্মকর্তা বলেন, যে লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হচ্ছে, সেটি অর্জন করা কঠিন হবে। তবে এনবিআর তা অর্জনে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাবে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বিভাগ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার ৩১ কোটি টাকা। এর বিপরীতে এনবিআর আহরণ করেছে ২ লাখ ২৭ হাজার ৭৫৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। সে হিসেবে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩২ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাকি দুই মাসে রাজস্ব আহরণের পূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। এমনকি অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ ৩৫ হাজার কোটি টাকাও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অবশ্য ঘাটতি বাড়লেও গত ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৫ দশমিক ২১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আহরণ হয়েছিল ১ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে আমদানি ও রফতানি খাতে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা। এ সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৭৩ হাজার ৬০ কোটি ২৬ লাখ টাকা। ঘাটতি ৭ হাজার ৮৬৭ কোটি টাকা। একই সময়ে ভ্যাট আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ১ হাজার ১২০ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৮৪ হাজার ৯১৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। ১০ মাসে ভ্যাট আহরণে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকারও বেশি। আয়কর ও ভ্রমণ খাতে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৭৭ হাজার ৮৬৪ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৬৯ হাজার ৭৭৯ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ আয়করে ঘাটতি ৮ হাজার কোটি টাকা।
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেন, কয়েক বছর আগেও চলতি অর্থবছরের রাজস্ব অর্জনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হতো। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ’ কমিটি এটি নির্ধারণ করে দিচ্ছে। ফলে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবতার প্রতিফলন থাকে না। তাই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন থেকে অনেকটা পিছিয়ে থাকে এনবিআর। এ পিছিয়ে থাকার কারণে সরকারকে কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে হয়, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তিনি আরো বলেন, আমাদের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাতে কেবল ৮-৯ শতাংশ। এটা সর্বনি¤œ ১৫ শতাংশে উন্নীত করা সম্ভব। কিন্তু এজন্য এনবিআরের পাশাপশি সরকারকেও কাজ করতে হবে। এক কথায় কর দিতে আগ্রহী সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যারা কর দেয়, সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। কর দেয়া বা না দেয়া উভয় ক্ষেত্রেই সেবার মান একই হলে জনগণ কর দিতে আগ্রহী হবে না। তখন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যেসব করদাতা নিয়মিত কর দেয়, তাদের কাছ থেকেই বেশি কর আদায়ে আগ্রহী হবে এনবিআর। এতে করে সৎ ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার শঙ্কা থাকে। তাই কিছু সংস্কারমূলক কার্যক্রম হাতে নিয়ে করদাতার আওতা বাড়িয়ে রাজস্ব বৃদ্ধি করতে হবে।
যুদ্ধ ও মহামারীর অভিঘাতে চরম অনিশ্চয়তায় বৈশ্বিক অর্থনীতি। এ অনিশ্চয়তার বাইরে নেই বাংলাদেশও। এর মধ্যেই আবার চলতি অর্থবছরের বিদায় মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে। চলছে পরবর্তী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি। নানা চ্যালেঞ্জকে সঙ্গে নিয়ে নতুন অর্থবছর শুরু করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। চলতি অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়াতে পারে। এর মধ্যেই আবারো রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে আরো ৪০ হাজার কোটি টাকা। বৈশ্বিক অর্থনীতির বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাড়তি এ রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য পূরণ করা এনবিআরের জন্য অনেক কঠিন হয়ে পড়বে। এ লক্ষ্য এনবিআরকে নিশ্চিতভাবেই চাপে ফেলতে যাচ্ছে। এনবিআরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) প্রথম ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) সংস্থাটির রাজস্ব আহরণে ঘাটতি ছিল লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থবছর শেষে তা ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আগামী অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য সংস্থাটির রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বা ১২ শতাংশ বেশি।
এ লক্ষ্য পূরণ করা এনবিআরের জন্য এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। রাজস্ব আহরণের ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এ অবস্থায় রাজস্বের যে লক্ষ্য দেয়া হচ্ছে, তা অর্জন করা আরো কঠিন হয়ে পড়ছে। আগামী বাজেট নিয়ে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ও বলছে, রাজস্বের পরিমাণ বাড়িয়ে বাজেট ঘাটতি কমানোটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। দীর্ঘদিন পর্যন্ত এনবিআর নিজেই রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। কয়েক বছর ধরে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ’ কমিটি এনবিআরের জন্য এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিচ্ছে। এ কারণেই সংস্থাটি লক্ষ্যমাত্রা পূরণের ধারেকাছেও যেতে পারছে না বলে মনে করা হচ্ছে। নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা সীমাবদ্ধ থাকছে কাগজে-কলমেই। বাধ্য হয়ে সরকারকেও কঠিন শর্তের ঋণ নিয়ে বাজেট ঘাটতি মেটাতে হয়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা কাগজে থাকলেও এর বাস্তবায়ন নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনি¤েœ। এখান থেকে উত্তরণের কোনো দিকনির্দেশনাও পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী অর্থবছরেও তা পূরণ করা সম্ভব হবে না। এর বিপরীতে আবার আগামী বাজটে ভর্তুকির মাত্রা বাড়ছে। যে পরিমাণ ঘাটতি রাখা হচ্ছে সেটা হয়তো পরবর্তী সময়ে আরো বেড়ে যাবে। এ থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন সংস্কারের মাধ্যমে সরকারকে রাজস্ব বাড়ানোয় মনোযোগী হতে হবে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী অর্থবছরে এনবিআর ও এনবিআর-বহির্ভূত উৎস থেকে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হচ্ছে চলতি অর্থবছরের তুলনায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে সরকারের আগামী অর্থবছরে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরা হয়েছে, যা জিডিপির ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে মোট রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য রয়েছে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা। এটি মোট জিডিপির ১১ দশমিক ৩ শতাংশ।
আগামী বাজেটে এনবিআর-বহির্ভূত রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর সঙ্গে করবহির্ভূত রাজস্ব (এনটিআর) আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ৪৫ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ দুই খাতে আহরণের লক্ষ্যমাত্রা যথাক্রমে ১৬ হাজার কোটি ও ৪৩ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে নতুন বাজেটে এনবিআরের বাইরের উৎস থেকে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে যথাক্রমে ১৩ ও ৫ শতাংশ। এছাড়া আগামী অর্থবছরে ৩ হাজার ২৭১ কোটি টাকা বিদেশী অনুদান পাওয়া যাবে বলে বাজেটে উল্লেখ থাকছে, যাকে সরকারের আয় হিসেবে ধরা হচ্ছে।