ইয়া রাসূলাল্লাহ! তোমার কথা স্মরণে আমার দু’চোখ প্লাবিত হয়। এই প্লাবন কখনো জীবনে নতুন ফল্গুধারা নিয়ে আসে। কখনো বা আসে বেদনার ক্লান্তিময় বার্তা নিয়ে। তোমাকে দেখতে না পারার শোক-তাপে নীল হয়ে যাই। বুঁদ হয়ে যাই মদিনার পথ-প্রান্তরে, ধুলোবালি আর খেজুর শাখের পাতার বিন্যাসে। আমি দেখিনি এসবের কিছুই তবু অদেখা ছবি আঁকে আমার তনু-মন তোমার বর্ণনা গাঁথা হতে। অদেখা এক তুমি বারবারই আমার হৃদয় হরণ করো। তোমার বর্ণনা আমায় বিচলিত করে, ব্যাকুলতায় ব্যগ্র করে তোলে তোমায় কিভাবে, কোথায় গিয়ে তোমার একটুকু দিদার পাবো! তৃষিত বুকে তোমার দরুদের শব্দমালা আবেহায়াত হয়ে তৃষ্ণা জুড়াতে চায়।
রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না আমি তার কাছে তার পিতা-মাতা, তার সন্তান-সন্ততি ও সমস্ত মানুষ থেকে প্রিয় হবো।’ (বুখারি-১৫) ছোট্ট একটা হাদিস, গভীর ভাবার্থ!
রাসূল সা:-এর জীবনের দিকে যদি তাকাই, কী করে যাননি তিনি আমাদের জন্য? সেই ১৫শ’ বছর আগে একটা মানুষ রাত জেগে আমাদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করেছেন। আমাদের গোমরাহি হওয়া, ফেতনার অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া নিয়ে ভীষণ শঙ্কিত ছিলেন!
তোমায় কেন ভালোবাসব না ইয়া রাসূলাল্লাহ! তুমি আবু শিআবে আবি তালিবে বন্দিত্ব জীবন বরণ করে নিয়েছ, খেয়ে না খেয়ে তখন দিনাতিপাত করেছ। গাছের পাতা পর্যন্ত খেয়েছ। তবু পাহাড়সম দৃঢ়চেতা মন নিয়ে হকের পথে থেকেছ। সবক দিয়ে গেছ কিভাবে হককে আঁকড়ে ধরে রাখতে হয়। মক্কার কাফেরদের দেয়া কত গঞ্জনা সহ্য করেছ। আর তায়েফে?
বিভীষিকাময় ছিল সৃষ্টি জগতের জন্য সেদিনটি! দুষ্টু পাষ-দের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছে সেই নূরানি চেহারা। পাথরের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। পদযুগল জুতোর সাথে রক্তের কারণে সেঁটে গিয়েছিল। এহেন পরিস্থিতিতেও তুমি ধৈর্যের চরম নজির দেখিয়ে গেছ। তায়েফবাসীর এমন ধৃষ্টতায় আরশ পর্যন্ত কেঁপে উঠেছিল। তবুও বদদোয়া করোনি। তুমি তো দয়ার নবী ক্ষমার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে গেছ। দোয়ার হাত উত্তোলিত করে দোয়া করেছ তায়েফবাসীর জন্য।
তুমি সৌন্দর্যের সব স্তর ছাড়িয়ে যাওয়া অনন্য মহামানব। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘নিশ্চয়ই আপনি মহান চরিত্রের অধিকারী’। (সূরা ক্বলম-৪)
তোমার নামে পবিত্র কালামুল্লাহতে গোটা একটা সূরার নামকরণ করা হয়েছে। তোমার সম্মান ইজ্জত বর্ণনার রয়েছে প্রচুর আয়াতে কারিমা ‘বলো, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তাহলে আমার অনুসরণ করো, আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।’ (সূরা আলে-ইমরান-৩১)
‘অবশ্যই তোমাদের জন্য রাসূলুল্লাহর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ তাদের জন্য যারা আল্লাহ ও পরকাল প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে।’ (সূরা আহজাব-২১)
‘অতএব তোমার রবের কসম, তারা মুমিন হবে না যতক্ষণ না তাদের মধ্যে সৃষ্ট বিবাদের ব্যাপারে তোমাকে বিচারক নির্ধারণ করে, তারপর তুমি যে ফায়সালা দেবে সে ব্যাপারে নিজেদের অন্তরে কোনো দ্বিধা অনুভব না করে এবং পূর্ণ সম্মতিতে মেনে নেয়।’ (সূরা নিসা-৬৫) তোমার গোটা মক্কা জীবন ঘুরে দেখা যায়- নির্যাতন, জুলুম, হেনস্তা আর দুঃখের উপাখ্যানে মোড়ানো। মক্কায় রাজত্ব করার সুযোগ পর্যন্ত তুমি পায়ে ঠেলে দিয়েছ, উম্মাহর বৃহৎ কল্যাণ, নবুয়াতের বড় দায়িত্ব পালনে, রবের আজ্ঞাবহ হওয়ার জন্য। এখানেও আমাদের জন্য শিক্ষা রেখে গেছ। তুমি কখনো কাউকে ঘৃণা করতে শিখাওনি। ধর্মের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি জোরজবরদস্তি করতে নিষেধ করেছ। তুমি সব ধর্মের, গোত্র, বর্ণের প্রতি উদারনীতি দেখিয়ে গেছ, গ্রোথিত করে গেছ বিশ্ব মানবতা শান্তি শৃঙ্খলার সুবিশাল স্তম্ভ। উড্ডয়ন করে গেছ বিশ্বশান্তির ঝা-া। যার ধারক বাহকের উত্তরসূরি করে গেছ আমাদের। কতটুকু পেরেছি বা পারছি আমরা সে ঝা-া রক্ষা করতে? কথা তো ছিল, জান মাল দিয়ে, বুক দিয়ে আগলে ধরব তোমার শিক্ষা।
অথচ তোমার উম্মত হয়েও তোমার চরিত্রে আঘাতকারী নষ্ট চিন্তার বিকৃত আত্মাগুলোকে প্রতিহত করতে শিখিনি। তোমার ইজ্জত রক্ষায় এই জীবনকে বিছিয়ে দিতে পারিনি জাগতিক দ-ের সঙ্কীর্ণ আসরে। আমি ব্যর্থতার রুমাল পকেটে পুরে তা দিয়েই অশ্রু মুছি। কত নির্বোধ অপদার্থ আমি পলাতক সৈনিক রাসূলের ইজ্জত রক্ষার খেয়ালি ময়দান থেকে। আত্মা আমায় ধিক কি জানাবে আমি আজ নিজেই লুণ্ঠিত কপট সভ্যতা, মেকি দুনিয়ার ভোগ বিলাসের মোহে।
তোমায় ভালোবাসি, ভালোবাসি বলে কত লম্ফঝম্প করি। মুখে তোমার নামে দরুদ সালাওয়াত পেশ করি ঠিকই। কিন্তু তোমার ওই আকাশ ঊর্ধ্বে ইজ্জত, পবিত্রতম নিরেট চরিত্রের বিরুদ্ধে আঙুল চালানো, চোয়াল বাঁকানোর ধৃষ্টতাকারীকে কিই বা দিয়েছি জবাব! বুক টান করে হাঁটছে চলছে তারা। তাদের মতো আমরাও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছি যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। আজো কাঁদে, গারে হেরা, গারে সাওর, বদর প্রান্তর। চিৎকার করে মাতম করে ওহুদের পাহাড়, যেখানে আমার রাসূল সা:-এর দান্দান মোবারক শহীদ হয়েছে। আজো তারা কাঁদে রাসূলের ইজ্জতে কেউ আঘাত হানলে।
একদিকে আমার ভালোবাসা অন্যদিকে আমার অক্ষমতা, অদূরদর্শিতা, কিভাবে দাঁড়াব তোমার সামনে ইয়া রাসূলাল্লাহ!
জীবনের অন্তিম লগ্নে, তুমি নিজ স্ত্রীগণ, কন্যাদের, দৌহিত্রদের জন্য কান্না করোনি। তখনো তুমি উম্মতি উম্মতি বলে গেছ। তুমি নিজের জন্য কখন কিই বা প্রার্থনা করেছ গোটা জীবন উম্মাহর কল্যাণে উৎসর্গ করে গেছ নবুয়তি দায়িত্বকে প্রাণ দিয়ে আগলে গেছ।
আমার এত অপূর্ণতা সত্ত্বেও ইচ্ছেরা ধৃষ্টতা করে। তোমায় দেখে চর্মচক্ষুকে শীতল করব। হাউজে কাউসার পান করব তোমার হাতে! আমি কল্পনায় বিভোর হই ভেবে, তুমি আমায় দেখে জান্নাতি সেই মুচকি হাসিটি হাসবে। তোমার হাসির নূরানি ঝলকে গোটা সৃষ্টিজগৎ স্নাত হবে নূরানি আভায়! লেখক: ছাত্রী, কামিল হাদিস বিভাগ, ফরিদগঞ্জ মজিদিয়া কামিল মাদরাসা, চাঁদপুর