শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:০৫ পূর্বাহ্ন

নবাব সিরাজউদৌলা চলচ্চিত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেরণা

নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা
  • আপডেট সময় বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০২২

খান আতাউর রহমান ( ডিসেম্বর ১১, ১৯২৮ ডিসেম্বর ১, ২০০৪ ) যিনি খান আতা নামে বহুল পরিচিত। তিনি একজন বাংলাদেশী চলচ্চিত্র অভিনেতা, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, গায়ক, চলচ্চিত্র নির্মাতা, চিত্রনাট্যকার, কাহিনীকার, এবং প্রযোজক। তার অভিনীত প্রথম চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরা।চলচ্চিত্রকার এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার তার অভিনীত প্রথম বাংলা চলচ্চিত্র। নবাব সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৭) এবং জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০) চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সুজন সখী (১৯৭৫) চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পরে এখনো অনেক রাত (১৯৯৭) চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হন।
* নবাব সিরাজউদৌলা চলচ্চিত্র বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক :পলাশীতেই হয়েছিল সেই যুদ্ধ সেখানে দেশদ্রোহী সেনাপতিদের অসহযোগিতা এবং ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারণে পলাশীর যুদ্ধের পরই বৃটিশদের কাছ ভারত উপমহাদেশের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়। সেই যুদ্ধের বিয়োগান্তক নায়ক নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলার নাম আজও প্রতিটি বাঙালির অন্তরকে আবেগপ্রবণ করে তুলে। বাংলাদেশের বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা মরহুম আতাউর রহমান ১৯৬৬ সনে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা নামে একটি পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। কেন তিনি এই ছবি করলেন, কি কি কারণে তিনি অনুপ্রাণিত হলেন, কি তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, এইসব বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি সপ্তাহিক পলাশীর পাঠকদের উদ্দেশ্যে জীবতকালে যে লেখাটি লিখে ছিলেন তার কিছু অংশ নি¤েœ পত্রস্থ হলো। লেখাটি নানা দিক থেকেই তৎপর্যপূর্ণ।
চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানের বক্তব্য এরকম: নবাব সিরাজ-উদ্-দৌলাকে একজন মানুষ হিসেবে কে কতখানি শ্রদ্ধা করে তা না জানলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে তাঁকে প্রতিটি বাঙালি বাংলাদেশের শেষ স্বাধীন দেশপ্রেমিক নবাব বলে ভালবাসে। ১৯৬৫-র শেষ দিককার ঘটনা। তখন আমরা গুলিস্তান সিনেমা হলের কাছে ‘গুলশিতান’ রেষ্টুরেন্টে নিয়মিত আড্ডা দিতাম বেশ ক’জন বন্ধু। কথা বলতাম দর্শন, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সমাজ ও ইতিহাস নিয়ে। একদিন সে আড্ডাতে আমার এক হিন্দুস্থান পন্থী বন্ধু সিরাজ-উদ্-দৌলা সম্পর্কে অশালীন ভাষায় অভিমত প্রকাশ করেছিলো। “ঐ মদ্যপ, নারী আসক্ত, উচ্ছৃঙ্কল লোকটাকে দেশপ্রেমিক নবাব বলে?” অতিকষ্টে নিজের ক্রোধ সংবরণ করে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে নবাব সিরাজ- উদ্-দৌলাকে নিয়ে একটি পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করবো, প্রকৃত সত্য ইতিহাস জাতির সামনে তুলে ধরবো ইনশাল্লাহ। বয়স আমার যখন নয়, ক্লাশ ফোরে পড়ি, বড় আপার বাক্স গ্রামোফোনে এইচ, এম, ভি প্রযোজিত রেকর্ডে সিরাজ-উদ্-দৌলা নাটক শুনেছিলাম। প্রথম দিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম এবং তারপর যতবারই সেই নির্মলেন্দু লহিড়ীর কন্ঠে সিরাজের আবেগ-আপ্লুত কথা শুনেছি, লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছেছি। এরপর, ১৯৫১ সনে যখন আমি করাচীতে রেডিও পাকিস্তানে বাংলা সংবাদ পাঠক হিসাবে চাকুরীরত তখন সেখানকার পূর্ব পাকিস্তান সমিতির প্রয়োজনার “কন্ট্রাক’ হলে সিরাজ-উদ্-দৌলা নাটক মঞ্চায়ন করি। পশ্চিম পাকিস্তানে সেই ছিল প্রথম বাংলা নাটক মঞ্চায়ন। জাতীয় অঙ্কন শিল্পী এস, এম, সুলতান বেশভূষা ও দৃশ্যসজ্জার পরিকল্পনা করেছিলেন এবং তিনি নিজেও মীর জাফর আলী খাঁ চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। আমি সেজেছিলাম সিরাজ-উদ্-দৌলা। স্বভাবতই শচীন্দ্রনাথ সেনের মঞ্চ নাটক ‘সিরাজ-উদ্-দৌলা’ ছিল আমার কণ্ঠস্থ। সেদিন ‘গুলশিতানে’ সেই হিন্দুস্তান পন্থী বন্ধুর নোংরা অশালীন উক্তির প্রেক্ষিতে আমার স্থির সিদ্ধান্ত যে, সিরাজকে নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরী করবো। সিরাজ-উদ্-দৌলাকে নিয়ে সেই চলচ্চিত্র অবশ্যই ইতিহাস-নির্ভর হবে, যা আমার পক্ষ থেকে বাংলার কুচক্রী মহলের প্রতি উপযুক্ত জবাব হবে।
* নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্র কেন্দ্রিক উল্লেখযোগ্য গল্প কথা-” নবাব সিরাজউদ্দৌলা ” সিনেমাটি ১৯৬৭ সালে মুক্তিপায়। দেশ স্বাধীনের পূর্বে মুক্তি প্রাপ্ত সিনেমাটি তখনকার সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এই সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন খান আতাউর রহমান। শ্রেষ্ঠাংশে সেই সময়কার জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা আনোয়ার হোসেন- খান আতার মত অন্যান্য পর্দা কাপানো স্টাররা অভিনয় করেছিলেন। সৃষ্টিকর্তার হুকুম অনুসারে সে সময়ে আমার জন্ম না হওয়াতে আমি সিনেমাটি হলে গিয়ে না দেখতে পারলেও পরে এ আমলে বহুবার সিনেমাটি দেখেছি। চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমানের বক্তব্য এরকমঃ বহু লেখকদের সিরাজউদ্দৌলার উপর লেখা বই ঘাটলাম দিনের পর দিন। অবাক হলাম এই দেখে যে কোন ঐতিহাসিকের বর্ণনার সঙ্গে অন্য ঐতিহাসিকের বর্ণনার মিল দূর দূরান্তেও নেই। ইতিহাস পড়তে এসে পড়লাম মহাবিপাকে। সিকান্দার আবু জাফর আমার অগ্রজতুল্য। তার কাছে উপদেশের জন্যে গেলাম। তিনি আমাকে বলেছিলেন, আতা তুই ছবিটা বানাতে চাস নিশ্চই এই কারণে যে তুই সিরাজউদ্দৌলাকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম বীর দেশপ্রেমিক মহানায়ক হিসেবে দেখাতে চাস, তাই না। আমি (অর্থাৎ খান আতা) মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে ছিলাম। জাফর ভাই বলেছিলেন, তাহলে তুই সিরাজউদ্দৌলাকে নিজের মনের মাধুরী দিয়ে গড়ে তোল। আরে ইতিহাস বলে কিছু নাইরে। রুজেভের যুদ্ধের পর রিচার্ড দি থার্ড হলেন খ্রিষ্টানদের হিরো এবং মুসলিম জগতের প্রকৃত নায়ক হলেন মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা:) এবং তাঁর প্রিয় পরিবার পরিজন। মোঘল আমলে মুসলমানদের কাছে আফজাল খান ছিলেন সরল বিশ্ববাসী-মানুষ, আর হিন্দুদের কাছে-ব্রঘ্রনখর পরিহিত মারাঠা দস্যু শিবাজীকে আলিঙ্গন করবার ছলে আফজাল খানের পাঁজরের হাড় ভেঙে ফেলেছিল, সেই হলো জাতীয় হিন্দুদের নায়ক। বঙ্গে বর্গী নাটকে ভাস্কর পন্ডিতকে দেখানো হয়েছে ১জন আদর্শ যোদ্ধা নেতা হিসাবে। অথচ শচীন সেনের ‘সিরাজউদ্দৌলা-তেই বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিতকে বলা হয়েছে ১জন লুটেরা দস্যু। সুতরাং তুই সিরাজউদ্দৌলাকে কিভাবে তোর ছবিতে আঁকতে চাস, সেটা তোর ব্যাপার।
প্রয়াত খান আতা নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতা নিয়ে তাঁর জীবন কালে বলেন- “ নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমা নির্মাণ কালে একটা অদৃশ্য অবিছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম, যেমন আর কোন ছবি করতে গিয়ে হয়নি। দিন নেই রাত নেই, ঘুম নেই, বিশ্রাম নেই। খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, সবাই যেন নবাবের প্রেমে পড়ে তাঁর জীবনালেখ্য চিত্রায়িত করবার নেশায় মশগুল।
এমনি তন্ময় হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবির শুটিং হলো। ডাবিং হলো। এবার সম্পাদনার পালা। তেমনি দিন নেই, রাত নেই, তখন আজকের মত বড় পর্দাওয়ালা ঝঃরহ ইধশব ঊফরঃরহম মেশিন ছিলনা। ৩ ইঞ্চি উঁচু ৪ ইঞ্চি পাশ, এত ছোট ছবি দেখে কাজ করেছি। প্রয়াত বশীর সম্পাদনা করছেন। আমি ১০ মিনিটে বাসায় ফেলে আসা স্ক্রিপ্টের খাতা আনবার জন্য গাড়ি নিয়ে বিদায় নিয়েছি, ফিরেছিও ১০ মিনিটেই। এসে দেখি এফ ডি সি-র দিকে সিভিল সাপ্লাই- এর গুদামে চাল গম বয়ে নেবার জন্য যে রেললাইনটা আছে সেখানে বস্তা আটকে স্থবির রেলের ইঞ্জিন, সে আর নড়েই না। ধৈর্যচ্যুতি হলো, আমি আর শব্দগ্রাহক মহসিন সাহেব ইঞ্জিনে উঠে ড্রাইভারকে বললাম কতক্ষণ দেরি হবে। উত্তর এলো- কুচ নাহি জানতা এহা সে নিকাল যাও। মাথায় রক্ত উঠে গেলো। মারলাম জোরে এক চড়, চড় খেয়ে চালকটা ইঞ্জিন থেকে ছিটকে বাইরে পড়ে গেল। সহ- পরিচালক লোকটা ছিল বাঙ্গালী সে ভয় পেয়ে ১০ গজ মতো পেছনে সরিয়ে নিলো ইঞ্জিনটা। আমরা গাড়ি নিয়ে এফ ডি সি গেলাম। রাতে কাজ শেষ করে ভোরবেলায় বাসায় গেছি। বেলা ১০ টা সময় থানার দারোগা এসে খবর দিলো রেলওয়ে পুলিশ আপনাকে গ্রেফতার করতে আসছে, আধ ঘণ্টার মধ্যে আপনি বাড়ি থেকে চলে যান। আমি বললাম যে ওরা গ্রেফতার করলে করবে, আমি পালাবার লোক নই। সত্যিই কিছুক্ষণ পর রেলওয়ে পুলিশের একজন উর্দুওয়ালা দারোগা আমাকে এরেস্ট করলো। আমি ভাবলাম কৈ বাত নেহি জামিন হো জায়ে গা। ওমা সেদিন তো শনিবার। কোর্টে গিয়ে দেখি আদালত শেষ। অগত্যা জেল হাজতে স্থানান্তর। আমি ভাবি এ হচ্ছে ভবিতব্ব। আমাকে ওরা একটা সাধারণ সেলে একটা কম্বল সঙ্গে দিয়ে লোহার দরজায় তালা মেরে দিয়ে চলে গেলো। ভাবলাম ভালই হলো নবাব সিরাজউদ্দৌলা এমনভাবে মনে ও মাথায় ভর করে বসেছেন, তার মাঝে এ যেন একটা বাধ্যতামূলক ঘুম। নির্বিবাদে সেই কম্বল পেতে দে ঘুম। ঘুম ভাঙ্গলো চেঁচামেচিতে। উঠে দেখি শেখ মুজিবর রহমান ডাকছে- “ঐ আতাউর তুই এইখানে”। আমি নির্বাক। যিনি জীবনে বছরের পর বছর জেলে বন্দী থেকেছেন আন্দোলন সংগ্রাম করে, তিনি আমাকে চিনতেন ছেলেবেলায় রাজনৈতিক হৈ চৈ করতাম বলে, মোগলটুলির আওয়ামী মুসলিম লীগের অফিসে যেতাম বলে, মধুদার ক্যান্টিনে মুনির চৌধুরি, মুজিব ভাইয়ের আড্ডায় যেতাম বলে। সেই মুজিব ভাই খবর পেয়ে আমাকে দেখতে এসেছেন। কি তার গর্জন ছিল? হুকুম দিলেন সিপাইকে- দরজা খোলো। সেন্ট্রাল জেলের শাস্ত্রীরা মুজিব ভাইকে দেখলে ভয় করতো। তাই দরোজা খোলো হল। শেখ মুজিব তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে বিচারাধীন জেলবন্দী জীবন কাটাচ্ছিলেন। আমাকে নিয়ে গেলেন মুজিব ভাই তার শ্রেণীপ্রাপ্ত জেলখানার কক্ষে। টেবিলে একটা কলা আর বিস্কুট রাখা ছিল। আমাকে বললেন- খা।
কি করছিলি যে জেলে আসছস? মুজিব ভাইয়ের প্রশ্ন। আমি কি করে সেই নেতাকে বলি যে একটা বদমাশ এঞ্জিন ড্রাইভারকে পিটাবার অপরাধে জেল হাজতে এসেছি। চুপ করে ছিলাম জোর করে কলাটা খাওয়ালেন আমাকে। এমন সময় জেলার সাহেবের পাঠানো একজন জেল অফিসার এসে জানালো যে, ম্যাজিস্ট্রেটের বাসা থেকে বিশেষ বেবস্থা বলে আমার জামিনের বেবস্থা করেছে আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। আমার তখন কি যে অবস্থা। একদিকে ছাত্রজীবনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ওদিকে আমার নির্মাণরত ছবি নবাব সিরাজউদ্দৌলা। অবাক হলাম শুনে যে ভাই বল্লেন- তুই নাকি নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবি বানাইতেছস, আমার মতো কথা কওয়াইতেছস নবাবের মুখ দিয়া। আমি বলেছিলাম- আপনি মুক্তি পেয়ে বাহিরে আসেন, আপনিই দেখবেন ছবিটা। “যা ভালো থাকিস”, বলে মুজিব ভাই আমাকে শুভ কামনা দিলেন। নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেন্সর হচ্ছে। একটি সংলাপ ছিল নবাবের মুখে “আমীর চাঁদ, পাঞ্জাব থেকে এসে শাঠ্য আর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থেকেৃ.” সেন্সর করতিপক্ষ বললেন সংলাপটা কেটে দিতে। কেন? এ যে ঐতিহাসিক সত্য। তবুও এটা সহ আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংলাপ বাদ দিতে হবে! দিলাম বাদ। ইতিহাসকে বিকৃত করবার দুঃসাহস যারা করেছিলো ইতিহাসই তাদের শিক্ষা দিয়েছে।
যাক, নবাব সিরাজউদ্দৌলা মুক্তি পেলো ১৯৬৬-তে। এ ছবিটি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তদানীন্তন বাংলার মানুষদের যে ভাবে সচেতন করেছিল, তার মূল্যায়ন হোক কি না হোক তাতে কোন আক্ষেপ নেই। আমার একটাই দুঃখ আছে। সেটা হচ্ছে যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হবার পর শেখ মুজিব এমন ভাবেই জড়িয়ে গেলেন রাজনীতিতে যে আমার “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ছবি দেখবার সময় কোথায়?
একাধিক বার বন্দী জীবন যাপন শেষে তিনি যখন স্বাধীন বাংলাদেশে এলেন, তখন দলীয় ও পারিবারিক কর্মকা- নিয়ে তিনি এতই বেস্ত ছিলেন যে কয়েকবার অনুরোধ করেও, “এই দেখি দেখবো শিগগীরই, এই অস্থির হইছস কান- দেখনের সময় কি ফুরাইয়া গেছে নাকি” বার বার ভিন্ন ভিন্ন সময় এই জবাব পেয়ে ফিরে এসেছি! তাই মুজিব ভাই আমার সেই “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ছবিটা দেখে যেতে পারেননি। আমি রাজনীতি করি না। আওয়ামী লীগ করি না। তার কথা মনে হলে দুটি কথাই বিশেষ করে মনে হয়। প্রথমটি বেঈমান স্বার্থপর দলের চক্রান্তে “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” কি ভাবে পরাজিত হলেন, কি অসহায় অবস্থায় বন্দী হলেন, কি নির্মম ভাবে নিহত অতঃপর শাহাদাৎ বরণ করলেন তার চিত্রায়ন তিনি দেখে যেতে পারেননি। ২য় টি তিনি নিজেই মহাম্মাদি বেগের মতো তার চির-চেনা মুখ গুলোর বুলেটের আঘাতে নিহত হন।
আরও মনে হয় যে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মানব প্রেমিক ছিলেন বলেই তিনি কে বিশ্বাসভাজন আর কে বিশ্বাসঘাতক এসব না ভেবেই সবাইকে সমান ভাবে ভালোবাসতেন আর তারই কারণে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছিলো। ১৭৫৭-তে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পবিত্র রক্ত লক্ষ কোটি দেশপ্রেমিকের জন্ম দিয়েছিল ১৮৫৭-র সিপাহী বিপ্লব ও পরবর্তী আন্দোলন সংগ্রাম গুলোতে। তখনি শুরু হল সচেতন হবার পালা। মুজিব ভাই বহু আন্দোলন সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন ঠিকই, যদিও তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়গুলোতে বন্দী ছিলেন। তাই “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ছবিটা প্রতীক করে দেশপ্রেমীরা যার যা আছে তাই নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলে এবং “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ছবিটির অনুপ্রেরণায় যে মুক্তিযুদ্ধ ও যোদ্ধাদের মূলমন্ত্র ছিল সে কথা অস্বীকার করা মানে সত্যকে অস্বীকার করা। “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” ছবিটার ডাকে সাড়া দিয়ে সেদিন লাল সবুজের বাংলায় স্বাধীনতা প্রাপ্তি হল।
মুজিব ভাই যদিও রাজনীতিকেই জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, তিনি কিন্তু বিশ্বাস করতেন না যে রাজনৈতিক নেতাকে মানবিক দুর্বলতাজনিত প্রেমের উরধে উঠে এক লৌহমানব হতে হয়। আমার নবাব সিরাজউদ্দৌলা ছবিতে দেশপ্রেমী নবাব যখন ভরা দরবারে জগৎ শেঠের প্রতি সঙ্গত কারনেই শক্ত আচরণের বহিঃপ্রকাশ ঘটালেন, তখন সেনাপতি মির মারদান সহ অন্যান্যরা খুব খুশি, কিন্তু বিচক্ষণ কাশ্মীরি রাজা মোহনলাল বলেছিলেন- “রাজাকে রাজনীতি জানতে হয়”। সেই হতভাগ্য “নবাব সিরাজউদ্দৌলা” যেমন রাজনীতির এই নিগুঢ় রহস্যটা জানতেন না, তেমনি জানতেন না শেখ মুজিবুর রহমান।
বাংলাদেশে একমাত্র সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে সর্বাধিক চলচ্চিত্র। যার মধ্যে শ্রদ্ধেয় খান আতার নির্মিত ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটি আজও বাংলার মানুষের অন্তরে অন্তরে রয়ে গেছে। ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য, সংলাপ, সংগীত ও পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন খান আতাউর রহমান। এই ছবিটি ৩৫ মি.মি. এর। এই ছবিটিতে অভিনয় করেছেন আনোয়ার হোসেন, খান আতা, আনোয়ারা, তুহিনসহ আরও অনেকে। তৎকালীন সময়ে বাংলা এবং উর্দু ভাষায় মুক্তি পাওয়া উক্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।উক্ত চলচ্চিত্রটি পরবর্তী সময়ে আবার নির্মাণ করা হয় সম্পূর্ণ রঙিনভাবে। এতে সিরাজউদ্দৌলা চরিত্রে প্রবীর মিত্র, বেগম লুৎফুন্নিসা চরিত্রে জিনাতসহ আরও অন্যান্য চরিত্রে খ্যাতিমান অভিনেতারা অভিনয় করেন।ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতেৃ ” কৃষক চেতনার বাংলাদেশে সফল নায়কের চেয়ে ট্রাজিক বীরেরা হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা পান। বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বীর চায়, নিপীড়িত জাতি নায়ক চায়, বাংলার জনগণ চায় ট্রাজিক দেশ প্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার পুনর্জাগরণ, বাংলার মানুষ চায় প্রকৃত ভালবাসা। সিরাজ চরিত্র এই চারের অভাব অন্তত ৪ বার মিটিয়েছে। ইতিহাসে ৪ বার বেঁচে ছিলেন এবং বেঁচে আছেন তিনি। ১ বারৃ নিজের সৎ ও দেশপ্রেমিক জীবনে (জন্ম-১৯.৯.১৭২৭ ইং তৎকালিন দু’বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে)। ২য় বারৃ ১৯১১ সালের জানুয়ারিতে কলকাতার নাট্য মঞ্চে মঞ্চস্থ নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’-য় (১৯১১ সালের ৮ জানুয়ারি তৎকালিন বৃটিশ ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় সহযোগী মিত্র সরকার বাংলার বীর দেশপ্রেমি নবাব সিরাজউদ্দৌলার আকাশ চুম্বি জনপ্রিয়তা আতঙ্কে, দেশপ্রেমি দর্শকদের উপচেপড়া ভিড় দেখে গিরিশ চন্দ্র ঘোষ রচিত ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নাটকের অভিনয় ও প্রচার বন্ধ করে দেয়)। তৃতীয় বারৃঢাকা ও পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প গ্রন্থে মির্জা তারেকুল কাদের লিখেছেন; নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রটি বিপুল অঙ্কের মুনাফা অর্জন করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা বোধ উজ্জীবিত এবং তপ্ত রাজনৈতিক আবহাওয়ার পটভূমিতে নৈপুন্যতার সঙ্গে নির্মিত হওয়ায় ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটি দর্শকেরা সাদরে গ্রহণ করে নেন। ১৯৬৭ সালের জানুয়ারিতে বাংলা ও উর্দ্দু ভাষায় মুক্তি পাওয়া উক্ত চলচ্চিত্রটি বক্স অফিসে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। বাংলার মানুষের মনে চিরকাল তরুণ বীর দেশপ্রেমিক সিরাজউদ্দৌলার প্রতি যে ভালবাসা কাজ করে, অভিনেতা আনোয়ার হোসেন তার অসাধারণ আন্তরিক অভিনয় দিয়ে খান আতাউর রহমান পরিচালিত উক্ত চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দর্শকের মনে সেই সুপ্ত নহর জাগাতে পেরেছিলেন।
৪র্থ বারৃনবাব সিরাজউদ্দৌলার পুর্নজাগরণ ও পুর্ণ জন্ম ঘটে তাঁরই রক্তধারার ৯ম প্রজন্ম সৈয়দ গোলাম আব্বাস আরেব ওরফে নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলার সততা-দেশপ্রেম ভালবাসার আদর্শিক চেতনার মাধ্যমে। তাইতো সমাজের সর্বস্তরের দেশপ্রেমি সকলের কাছে নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা হলেনৃনতুন প্রজন্মের সিরাজউদ্দৌলা। আজ লাল সবুজের দেশ্রপ্রেমি সকল হৃদয় নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনকেই নতুন ভাবে পেয়েছেন নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলার মাঝে। বাংলার দেশপ্রেমি মানুষ যখন কণ্ঠে দেশপ্রেম ও ভালোবাসা নিয়ে বলেনৃ নবাবজাদা আলি আব্বাসউদ্দৌলা আমাদের নতুন প্রজন্মের সিরাজউদ্দৌলা, সকলের মন তখন ভালোবাসা ও শ্রদ্ধায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। দুটি ভিন্ন সময়, দু’টি ভিন্ন মানুষ, কিন্তু যেখানে তারা ১ হয়ে যান তা হলোৃসততা, দেশপ্রেম ও বাংলার দ্রেশপ্রেমি সকলকে আপন ভেবে আপন করায়। তাই দু’জনের জীবনকে আর আলাদা করা যায়নি, আর যাবেওনা। নবাব সিরাজউদ্দৌলাই আব্বাসউদ্দৌলা, নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলাই সিরাজউদ্দৌলা। নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলা নিজস্ব ঐতিহ্যবাহি ইমেজে হৃদয়ের গভীরতায় লালন করেন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনকে। তাইতো নবাবজাদা-আব্বাসউদ্দৌলা লাল সবুজের ডিজিটাল বাংলায় ঐতিহ্যের সেই ফুলের সৌরভ ছড়াচ্ছেন সকল হৃদয়ে। আর আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের কোটি-কোটি হৃদয় থেকে আবার ডাক পড়লৃ হে বীর, হে-দেশপ্রেমিক, তুমি তো আমাদেরই মাঝে। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত শোনা যায় শ্লোগানৃ‘জয়তু সিরাজউদ্দৌলা, ‘জয়তু আব্বাসউদ্দৌলা’। আজ আবার বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদী আবেগ বীর দেশপ্রেমিক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ প্রতিক পেয়েছে নতুন প্রজন্মের সিরাজউদ্দৌলাৃ“নবাবজাদা আব্বাসউদ্দৌলার” মাঝে।
তরুণ প্রজন্মের কবি আবদুল নবি তাঁর লিখায় উল্লেখ করেছেন, সিরাজের প্রাণ প্রিয় বাংলার বাঙ্গালিরা বুঝছিলো বাংলার দুশমনেরা শাসনের নামে শোষণ চালাচ্ছে! তাই এক হলো বাঙ্গালি। ৫২’ ভাষা আন্দোলন, ৬২ ছাত্র আন্দোলন ৬৬ এর ৬ দফা; ৬৯ গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচনে জয় লাভ করে বাঙ্গালি প্রমাণ করেছিলো তারা স্বাধীনতা চায়। খান আতার দেশপ্রেমি সিরজকে নিয়ে তৈরিকৃত পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র “নবাব সিরাজউদ্দৌলা”-র মাধ্যমে নবাব চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের বজ্রকণ্ঠ সাড়ায় সাড়া দিলো সবাই, উজ্জিবিত হলো লাল সবুজের বাংলা- জেগে উঠলো জনতা, অভিনেতা আনোয়ার হোসেনের মাঝে পেলো নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে, আর বলে উঠলো সবাই- এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রের মহাধ্বনীতে শুরু হলো যুদ্ধ, ৯মাস রক্তক্ষয়ী লড়াই, এক সাগর রক্তে ভেসে আসলো- “জয় বাংলা, জয় সিরাজউদ্দৌলা” প্রতিধ্বনি, আর এই প্রতিধ্বনিতে ফিরে পেলাম স্বাধীনতা, আর স্বাধীন বাংলাদেশ।
নবাব আলিবর্দী খানের বীরত্ব গাঁথা ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার দেশপ্রেম গাঁথা নিয়ে বাংলাদেশে নির্মিত- মোস্তাফিজুর রহমান পরিচালিত ( প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশামের ছোট ভাই ), জহুর – আল মনসুর অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্র- “ বর্গী এলো দেশে “ ও খান আতাউর রহমান পরিচালিত, আনোয়ার হোসেন – খান আতা অভিনীত বাংলা চলচ্চিত্র- “ নবাব সিরাজউদ্দৌলা “ – চলচ্চিত্র দুটি বক্স অফিস ও প্রতিটি দেশপ্রেমী মুসলিম হৃদয়ে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল। স্বাধীন বাংলাদেশে ৮০-র দশকে ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রটি পুনরায় নির্মিত হয়, এবার চলচ্চিত্রটিতে সিরাজ চরিত্রে অভিনয় করেন অভিনেতা প্রবীর মিত্র, এই হয়ে গেল কাল, বাংলার দেশপ্রেমি মুসলিম দর্শকেরা হিন্দু বেক্তিকে নবাব চরিত্রে মোটেও মেনে নেন নি, যার দরুন চলচ্চিত্রটি বাংলার দেশপ্রেমি হৃদয়ে বিন্দু মাত্রও স্থান করতে পারেনি। অপরদিকে ন্যাশনাল এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্ত বাংলা ভাষায় নির্মিত পিয়ুস বাসু পরিচালিত ,১৯৬৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “সুভাষ চন্দ্র“ ( আশীষ ঘোষ, সমর কুমার, অমর দত্ত,রবিন ব্যানারজী অভিনীত। প্রযেজক- অজিত কুমার ব্যানারজী। সংগীত- অপারেশ লাহেরি ) -চলচ্চিত্রটি ব্যাতিতো, ভারতে তাদের দ্বারা নির্মিত অধিকাংশ চলচ্চিত্র ও নাটকে নবাব আলিবর্দী খান, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, বেগম লুৎফুন্নিসা সহ প্রকৃত দেশপ্রেমি ও সৎ মুসলিম বেক্তিকে অতি নৈপুণ্যতায় খল চরিত্রে তুলে ধরা হয়। যা তাদের ধর্মীয় কল্পকাহিনীর অংশ ছাড়া আর কিছু নয়।
সম্প্রতি শোনা যাচ্ছে তারা ‘সিরাজউদ্দৌলা’ নামক একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে ( পরিচালক- রাজ চক্রবর্তী ), উক্ত চলচ্চিত্রটি ২০২২ থেকে ২০২৬ সালের কোনো এক সময় সিনেমা ঘর গুলোতে প্রদর্শন করবে,শঙ্কা থেকে যায়,ভারত বলে কথা,কখন কি যে বিকৃতি ঘটিয়ে বসে তার নেই ঠিক। বাংলার ঐতিহ্যবাহী নবাব নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর প্রিয় পরিবারকে নিয়ে ভারত যুগে যুগে প্রতি যুগে নিত্য নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যাচ্ছে !!! এরি অংশ হিসাবে তারা তাদের ঘধমধঃরাব মস্তিস্কের নব্য প্রতিফলন ঘটিয়েছে ১০ ডিসেম্বর ২০১৮ থেকে ১৭ মে ২০১৯- এ প্রচারিত ঝঃধৎ জলসার নতুন ধারাবাহিক নাটক- আমি সিরাজের বেগমে, ভারত বংলার ঐতিহ্যবাহী আকাশ চুম্বী জনপ্রিয় মুসলিম ইশনা আশারি অনুসারী রাষ্ট্র পরিচালনায় ‘সেকুলার’ নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও তাঁর প্রিয় পরিবারকে নাটকটিতে দেব-মহাদেব-দেবির কল্প কাহিনীতে ভরা হিন্দু ইজম ও ওহাবি ইজমের রকমারি সব মশল্লা মাখিয়ে ও কাল্পনার ভুবন সাজিয়ে পরিবেশন করেছিল দর্শক মাঝে! নাটকটি জগা খিচুরি ও তাল গোল পাকিয়ে বসে ছিল, অবশেষে কোনো রকম জোড়া তালি লাগিয়ে দেশপ্রেমিদের নিন্দার ঝড়ের মধ্য দিয়ে নাটকটি অসম্পূর্ণ রুপে পরিসমাপ্তি ঘটালো ১৭ মে ২০১৯-এ।
১৯ শতকে ‘বিশ্বজিৎ’ অভিনীত ‘আমি সিরাজের বেগম বলছি’ নামের বিকৃত সাদা কালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করে ভারত নামক দেশটি দেশপ্রেমিদের দ্বারা কঠোর সমালোচিত হয়। ভারতের কাল্পনিক আবিস্কার – বেগম লুৎফুন্নিসা হিন্দু দাসী ছিলেন !!! ভারতের কাল্পনিক আবিস্কার – নবাব সিরাজউদ্দৌলা নেশাগ্রস্থ অত্যাচারী শাসক ছিলেন !!! ভারতের নব্য কাল্পনিক আবিস্কার ২০১৩ সালে- নবাব সিরাজউদ্দৌলার কথিত পুত্র সন্তান যুগল কিশোর !!! দেশটির বক্তব্যগুলো মোটেই তথ্যভিত্তিক ও ইতিহাস সম্মত নয়। পলাশী ট্রাজেডির পর নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখালেখি হয়েছে। এমনকি মহলবিশেষ নবাবের চরিত্র হননের জন্য নানাবিধ কল্পকাহিনীও রচনা করেছে। কিন্তু তারা কেউই নবাবের পুত্র সন্তান বিষয়ে কোন কথা বলেননি। কোন ঐতিহাসিকের লেখায়ও নবাবের পুত্র সন্তান স্থান পায়নি। মূলত এই কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে ২০১৩ সালে, কল্পনার স্বর্গ রাজ্য ভারত নামক দেশে। তার আগে নবাবের পুত্র সন্তান সম্পর্কে কেউ জানতে পারেন নি। আমরা সকলেই জানি নবাবের একমাত্র সন্তান- কন্যা উম্মে জোহরা। কিন্তু আড়াইশ বছরের অধিক সময় পর কিভাবে তার পুত্র সন্তান ও আলেয়া নামক স্ত্রী আবিস্কৃত হলো তা মোটেই বোধগম্য নয়!!! আসলে সঠিক ইতিহাস না জানা কেউ কেউ বিরুদ্ধবাদী ও মীর জাফরের উত্তরসূরীদের নবাব বিরোধী অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হচ্ছেন। মূলত আলেয়া / রাজকুয়ার / মাধবী / হিরা / ফৈজি বাঈ নামে কেউই নবাব আলিবর্দী সিরাজ আমলে / তাঁদের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। এগুলো নাটক ও সিনেমার কিছু কাল্পনিক চরিত্র। যা নাটক ও সিনেমার কাহিনীকে অধিক হৃদয়গ্রাহী করার জন্য নাট্যকারই কল্পিত চরিত্র সৃস্টি করেছেন। ইতিহাসবিদ ড.মোহাম্মদ মোহর আলী, রাজনীতিবিদ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, রাজনীতিবিদ শের – এ – বাংলা এ.কে. ফজলুল হক,নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যকার মরহুম খান আতাউর রহমানও স্বীকার করেছেন যে, আলেয়া / রাজকুয়ার / মাধবী / হিরা / ফৈজি বাঈ চরিত্র গুলোর কোন বাস্তবতা নেই, এগুলো চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাঁরা এও বলেন বাস্তবে নবাব সিরাজউদ্দৌলার একটি মাত্র সন্তান ছিল- তাঁর নাম ‘উম্মে জোহরা’। নাট্যকার সিকান্দার আবু জাফর, নাট্যকার আসকার ইবনে শাইখ,প্রখ্যাত শিল্পী নেজামত উল্লাহ, মিডিয়া বেক্তিত্ত ফজলে লোহানী, কবি রেদওয়ানুল হক, ড. মুহাম্মদ ফজলুল হক ( শিল্পপতি,শিক্ষাবিদ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা গবেষক, রাজনীতিবিদ বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ), ড. রমিত আজাদ (শিক্ষাবিদ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা গবেষক ), ড. এমাজ উদ্দিন (শিক্ষাবিদ ও নবাব সিরাজউদ্দৌলা গবেষক), সিনিয়র সাংবাদিক মাহমুদ আল ফয়সাল, ইতিহাসবিদ ড. কে. এম. মোহসীন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোঃ এরশাদের প্রেস সচিব জনাব খন্দকার দেলোয়ার জালালি, ইতিহাসবিদ ড. শেখ আকরাম আলী, বুদ্ধিজীবী আ. শ. ম. বাবর আলী, বুদ্ধিজীবী আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়াও তাঁদের কথার সাথে একাত্ম হয়েছেন। বাংলার দেশপ্রেমী মুসলিম জনতা ও প্রকৃত নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরিবারের সকলেই চলচ্চিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান, ইতিহাসবিদ ড.মোহাম্মদ মোহর আলী, রাজনীতিবিদ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ও রাজনীতিবিদ শের – এ – বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের কথার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছেন। *বন্ধুরা এবার আলোচনা করবো খান সাহেবের প্রাথমিক জীবন নিয়ে-
খান আতা মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম জিয়ারত হোসেন খান, মায়ের নাম যোহরা খাতুন। তার মা তাকে আদর করে ডাকতেন “তারা”। তার মায়ের পরিবার ছিলেন মাজারের খাদিম তথা তত্ত্বাবধায়ক। ধর্মীয় উরসে তার মামা নানারকম আধ্যাত্মিক সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। ১৯৩৭ সালে ঢাকা জিলা সঙ্গীত প্রতিযোগীতায় খান আতা প্রথম স্থান দখল করেন। তিনি তখন তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র।
* খান সাহেবের শিক্ষাজীবন-
খান আতা ১৯৪৩ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করেন। ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেন ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৫ এ । এরপর ১৯৪৬ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। এসময় তিনি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের উদ্দেশ্যে বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে তিনি পরিবারের এক সদস্যের চোখে পড়ে গেলে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই মেডিকেল ছেড়ে চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এবারো তার বোহেমিয়ান স্বভাবের কারণে তিনি সেখানে থাকলেন না। এ বছরেই তিনি লন্ডনে ফটোগ্রাফি বিষয়ক একটি বৃত্তি লাভ করেন। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে তিনি সেখানে যাননি। ১৯৪৯ সালে আবার তিনি বাড়ি ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করেন। এবারো উদ্দেশ্য ছিল একই। এবার তিনি প্রথমে মুম্বাই যান। মুম্বাই গিয়ে তিনি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছেন, চলচ্চিত্র জগতের আনাচে কানাচে গিয়েছেন। এসময় তিনি জ্যোতি স্টুডিওতে ক্যামেরাম্যান জাল ইরানির শিক্ষানবিশ হিসেব কিছুদিন কাজ করেন।
*ব্যক্তিগত জীবন-
চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব খান আতাউর রহমান তিনবার বিয়ে করেন। তার প্রথম স্ত্রী শার্লি। লন্ডন থাকাকালীন ১৯৫৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। পরে বাংলাদেশের আসার পর ১৯৬০ সালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। শার্লি তার সন্তানকে নিয়ে লন্ডন চলে যান। পরে ১৯৬০ সালে তিনি কণ্ঠশিল্পী মাহবুবা রহমানকে বিয়ে করেন। তার তৃতীয় স্ত্রী নীলুফার ইয়াসমীন। ১৯৬৮ সালে তিনি তাকে বিয়ে করেন। খান আতা ও মাহবুবা রহমানের ঘরে জন্ম নেন কণ্ঠশিল্পী রুমানা ইসলাম। অপরদিকে খান আতা ও নিলুফারের ঘরে জন্ম নেন বর্তমান প্রজন্মের গায়ক ও অভিনেতা খান আসিফ আগুন।
* খান সাহেবের কর্মজীবন-
১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে চলে আসেন করাচি। করাচী এসে তিনি যোগ দেন রেডিও পাকিস্তান এ সংবাদপত্র পাঠক হিসেবে। এখানেই আরেকজন প্রতিভাবান বাঙালি ফতেহ লোহানীর সাথে তার সখ্যতা গড়ে উঠে। তখনো চলচ্চিত্রের ব্যাপারে তার উৎসাহ কমেনি। যার কারণে তিনি প্রায়ই লাহোর যেতেন। এসময় তিনি সারঙ্গী বাদক জওহারি খানের কাছ থেকে তালিম নেয়া শুরু করেন। ফতেহ্ লোহানী কিছুদিন পরে লন্ডন চলে গেলে ১৯৫২ সালে খান আতা একটি পোল্যান্ডীয় জাহাজে করে লন্ডন পাড়ি জমান। সেখানে অনেক বাঙালি অনুষ্ঠানে গায়ক এবং অভিনেতা হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেন। এখানে এস এম সুলতানের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। এস এম সুলতানের চিত্রকর্মের উপকরণ যোগানে সাহায্য করেন তিনি। খান আতা এবং তার সাথীরা এস এম সুলতান-এর চিত্রকর্মের প্রদর্শনী এবং বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের সিটি লিটারেরি ইন্সটিটিউটে তিনি থিয়েটার ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হন। পরের বছরেই তিনি ইউনেস্কো বৃত্তি নিয়ে নেদারল্যান্ডে চলে যান। ১৯৫৫ সালে আবার লন্ডনে ফিরে এসে থিয়েটার রয়াল, ইউনিটি থিয়েটার, আরভিং থিয়েটারে সকল স্থানীয় গ্রুপের সাথে কাজ করতে থাকেন। এসময় তিনি কিছুদিন বিবিসি’র সাথেও কাজ করেছেন। ১৯৫৭ তে ফিরে আসেন ঢাকায়। এসেই তিনি পাকিস্তান অবজারভারে চাকরি নেন। এরপর তিনি রেডিওতে গীতিকার, সঙ্গীত পরিচালক, আবৃত্তিকার এবং অভিনেতা হিসেবে যোগ দেন।
*খান সাহেবের অভিনয়জীবন-
খান আতা ১৯৫৯ সালে পাকিস্তানি পরিচালক আখতার জং কারদার পরিচালিত উর্দু ভাষার চলচ্চিত্র জাগো হুয়া সাভেরাতে মূল ভূমিকাতে অভিনয়ের মাধ্যমে তার চলচ্চিত্র জীবন শুরু করেন। এতে তার বিপরীতে ছিলেন ভারতীয় অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্র। এ ছায়াছবির সহকারী পরিচালক ছিলেন জহির রায়হান। চলচ্চিত্র জগতে তিনি আনিস নামটি ব্যবহার করতেন। একই বছরে মুক্তি পায় তার অভিনীত প্রথম বাংলা ভাষার চলচ্চিত্র “এ দেশ তোমার আমার“। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন এহতেশাম। ১৯৬০ সালে জহির রায়হানের সাথে গড়ে তোলেন লিটল সিনে সার্কেল। এতে পরের বছরগুলোতে তার জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়। অভিনেতা হিসেবে তিনি কাজ করেছেন কখনো আসেনি, যে নদী মরুপথে, সোনার কাজল, জীবন থেকে নেয়া, সুজন সখী এর মতো সফল চলচ্চিত্রে।
*সঙ্গীত জীবন-
খান আতা সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে প্রথম কাজ করেন এহতেশাম পরিচালিত এ দেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রে। পরে ১৯৬২ সালে সূর্যস্নান ছায়াছবিতে তিনি উপহার দেন পথে পথে দিলাম ছড়াইয়া রে এর মতো গান। যাতে কন্ঠ দেন কলিম শরাফী। ১৯৬৩ সালে জহির রায়হানের কাঁচের দেয়াল ছায়াছবিতে তিনি নিয়ে আসেন শ্যামল বরণ মেয়েটি শীর্ষক একটি জনপ্রিয় গান। সূর্যস্নান ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ গীতিকার হিসেবে এবং কাচের দেয়াল ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব-এ তিনি পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন বাহানা, সাগর, আখেরি স্টেশান, মালা প্রভৃতি উর্দু ছবিতে। ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত জীবন থেকে নেয়াতে তিনি এ খাঁচা ভাংবো আমি কেমন করে শীর্ষক গানের কথা লিখেন এবং নিজেই কন্ঠ দেন। ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে দেশাত্মবোধক গান লিখেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খাদ্য এবং চিকিৎসাসামগ্রী সরবরাহ করে সাহায্য করেন। ’৭০ এবং ’৮০’র দশকে উপহার দেন সাবিনা ইয়াসমীনের কন্ঠে এ কি সোনার আলোয়, শহনাজ রহমতুল্লাহের কন্ঠে এক নদী রক্ত পেরিয়ে এর মতো গান। খান আতাউর রহমান প্রায় ৫০০ গানের গীতিকার। এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ২২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ গীতিকারের পুরস্কার অর্জন করেন।
* চলচ্চিত্র পরিচালনায় খান সাহেব-
তাঁর প্রথম পরিচালিত চলচ্চিত্র অনেক দিনের চেনা। ছায়াছবিটি ১৯৬৩ সালে মুক্তি পায়। ১৯৬৭ সালে তিনি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার জীবনী নিয়ে নির্মাণ করেন নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা। চলচ্চিত্রটি ১৯৬৯ সালে মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ প্রদর্শিত হয় এবং শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে গোল্ডেন প্রাইজের জন্য মনোনীত হয়। এরপর তিনি নির্মাণ করেন সাত ভাই চম্পা, অরুণ বরুণ কিরণমালা, জোয়ার ভাটা। মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন আবার তোরা মানুষ হ; যার বিষয়বস্তু ছিল যুদ্ধ পরবর্তী বাস্তবতা। ১৯৭৫ সালে প্রমোদ কর ছদ্মনামে গ্রামীণ পটভূমিতে নির্মাণ করেন রোমান্টিক চলচ্চিত্র সুজন সখী। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি ১ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে পুরস্কৃত হয়। ৮০’র দশকের নির্মাণ করেন হিসাব নিকাশ এবং পরশপাথর নামের দুইটি ছায়াছবি। মুক্তিযুদ্ধের উপর ১৯৯৪ সালে তিনি এখনো অনেক রাত চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে ছবির কাজ শেষ হয়। কিন্তু সেন্সর বোর্ড ছবির ৭টি স্থানে দৃশ্য কেটে ফেলার নির্দেশ দেয়ায় ক্ষুব্ধ হন তিনি। তিনি বাংলার কবি জসীম উদ্দীন, গঙ্গা আমার গঙ্গা, গানের পাখি আব্বাস উদ্দিন সহ বেশকিছু তথ্যচিত্রও তৈরি করেছেন।
খান আতাউর রহমান (১৯২৮-১৯৯৭) গায়ক, গীতিকার, সুরকার, চলচ্চিত্র অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক। জন্ম ১৯২৮ সালের ১১ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানার রামকান্তপুর গ্রামে। স্থানীয় দুটি স্কুলে পড়াশুনা করার পর তিনি ঢাকায় এসে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। এ স্কুল থেকেই ১৯৪৩ সালে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ঢাকা কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে তিনি আই.এসসি পাস করেন। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে। চিকিৎসা শাস্ত্র পাঠে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে তিনি ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বি.এসসি-তে ভর্তি হন। বি.এসসি পরীক্ষা না দিয়েই তিনি ১৯৫০ সালে চাকরি নেন করাচির রেডিও পাকিস্তানে। এ সময় খ্যাতনামা উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ জহুরী খানের সংস্পর্শে এসে খান আতা সঙ্গীতে তালিম গ্রহণ করেন। ১৯৫২ সালে চাকরি ত্যাগ করে তিনি লন্ডন গমন করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি ভর্তি হন সিটি লিটারারি ইনস্টিটিউটের নাট্যকলা বিভাগে। একই বছর তিনি পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি নির্বাচিত হন। খান আতাউর রহমান ইউনেস্কোর বৃত্তি নিয়ে ১৯৫৪ সালে এক শিক্ষা সফরে হল্যান্ড গমন করেন। পুনরায় লন্ডন প্রত্যাবর্তন করে তিনি একটি কলেজে অঙ্ক ও ইংরেজির শিক্ষক নিযুক্ত হন। শিক্ষকতার পাশাপশি খান আতা বিভিন্ন থিয়েটার কোম্পানিতে প্রায় দু বছর কাজ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। সে বছরই এ.জে কারদারের জাগো হুয়া সাভেরা ছবির সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের বিখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রের বিপরীতে তিনি প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন।
খান আতাউর রহমান ছিলেন সুগায়ক ও গীতিকার। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত প্রায় পাঁচ শতাধিক আধুনিক, দেশাত্মবোধক, শিশু সঙ্গীত ও বিষয়ভিত্তিক গান আজও সমান জনপ্রিয় ও আবেদনগ্রাহী। বাংলাদেশের সঙ্গীতজগতে তাঁর ভূমিকা নানামুখী। তিনি গানের বাণীতে এনেছেন আধুনিকতা ও সুরের বিচিত্র নিরীক্ষা, বিশেষত দেশাত্মবোধক সঙ্গীতে তাঁর সুরসৃষ্টির ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। খান আতাউর রহমান একটি বিশেষ গায়কী ঢং প্রবর্তন করেন যা তাঁর ব্যক্তিত্বেরই প্রকাশক। খান আতাউর রহমান নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্রের নাম অনেক দিনের চেনা (১৯৬৩)। এরপর তিনি রাজা সন্ন্যাসী, নবাব সিরাজউদ্দৌলা, জোয়ার ভাঁটা, আবার তোরা মানুষ হ, সুজন সখী, দিন যায় কথা থাকে, আরশী নগর, পরশ পাথর, এখনও অনেক রাত প্রভৃতি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র তৈরি করেন। এ ছাড়া ডানপিটে ছেলে, দুটি পাতা একটি কুঁড়ি, গঙ্গা আমার গঙ্গা, বাংলা কবি জসীমউদ্দীন, চা বাগানের রোজনামচা ও গানের পাখি আববাসউদ্দীন ইত্যাদি স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। নিজের ছবি ছাড়া অন্য বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালক, কেন্দ্রীয় চরিত্র ও অভিনেতা হিসেবে কুশলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। চলচ্চিত্র ক্ষেত্রে অবদানের জন্য খান আতাউর রহমান নয়টি পুরস্কার লাভ করেন। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, নিগার পুরস্কার, মস্কো ও তাসখন্দ আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার ও জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ১৯৯৭ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
* খান আতার দেশপ্রেমী কর্মকা-ে ঈর্ষান্বিত হিন্দুস্তান পন্থীরা- ” নবাব সিরাজউদ্দৌলা ” ও আবার তোরা মানুষ হ সিনেমার কাহিনী ও পরিচালক খান আতার ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি কয়েক বছর পূর্বে সুদূর আমেরিকায় এক অনুষ্ঠানে হিন্দুস্থান পন্থী বাংলাদেশি চিত্র পরিচালক, নাট্যজন ঐধংধহ রসধস ও নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালক খান আতাউর রহমানকে ‘রাজাকার’ বলে অভিহিত করেন! মন্তব্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। সেখানে দেখা যায়, নাসির উদ্দিন ইউসুফ বলেছেন, খান আতা অনেক বড় শিল্পী। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু খান আতা রাজাকার। হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি না হলে খান আতা বাঁচতো না। আমি গৌরব করে বলি, আমি না হলে খান আতা একাত্তরে মারা যায়, ১৬ ডিসেম্বরের পরে। ” নবাব সিরাজউদ্দৌলা ” ও আবার তোরা মানুষ হ এগুলো তার নেগেটিভ ছবি। মুক্তিযোদ্ধাদের বলছে আবার তোরা মানুষ হ। আরে তুই মানুষ হ। তুই তো রাজাকার ছিলি। সেই সাথে বাংলার বীর দেশপ্রেমী সন্তান নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়েও কটূক্তি করেন হিন্দুস্থান পন্থী বাংলাদেশি চিত্র পরিচালক, নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু!!!!
হিন্দুস্থানপন্থী বাংলাদেশি চিত্রপরিচালক নাট্যজন নাসির উদ্দিন ইউসুফের এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে টেকনাফ থেকে তেতুলিয়ায় উঠেছিল তীব্র প্রতিবাদের ঝড়। ঢাকাই চলচ্চিত্র পাড়ায় তখন দেখা দিয়েছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কিছু দুঃখের কথা বলবো’ শিরোনামে একটি সভার আয়োজন করেছিলেন বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার। চিত্রনায়ক ফারুক, সোহেল রানা, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা আমজাদ হোসেন, আজিজুর রহমান, মুশফিকুর গুলজার, সিবি জামানসহ খান আতার পরিবারের পক্ষে রুমানা ইসলাম ও আগুন বক্তব্য রেখেছিলেন সেদিন । সভায় খান আতা সম্পর্কে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু যে বক্তব্য রেখেছেন তা প্রত্যাহার করে নেয়ার আহবান জানান বক্তরা, সেই সাথে খান আতার মত বাংলার গুণী সন্তানকে নিয়ে ঐধংধহ রসধস ও নাসির উদ্দিন ইউসুফের কুরুচিপূর্ণ বক্তব্বের জন্য সতর্ক বার্তা দেন, অনেকে কঠোর ভাষায় নিন্দা জ্ঞাপনও করেন। সার্বিক দৃষ্টিকোন থেকে বিষয়টি তখন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিল। বন্ধুরা খান আতাউর রহমানের পরিচালিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমায় একটি দেশাত্মবোধক গান হয়।গানটির কথা, সুর বেশ হৃদয়স্পর্শী-
“ও আমার জন্মভূমি মা গো মা
তোমারে সবার চেয়ে বড় জানি
তোমারে সবার চেয়ে আপন মানি।। তোমার ওই বাউল বাতাস, মেঘলা আকাশ-
কী যে মায়া ছড়ায় অবিরত।
তোমার ওই ধানের ক্ষেতে, শ্যামল মাঠে-
কী যে স্নেহ মায়ের বুকের মতো।।
তোমার ওই স্নেহ ভরা, মায়া ঝরা মাটিরে
আমি জন্মদায়িনীর মতো মানি।। তোমার ওই বুক ভরা নদীর বুকে, নগর, গ্রামে, পথে-ঘাটে-
আমার এই চারণ হিয়া ধন্য হলো তোমারই গান গেয়ে। তোমার ওই আগুন মাখা সন্ধ্যাবেলা-
কী যে ব্যথা জ্বালায় আমার মনে।
তোমার ওই পাখি ডাকা সকাল বেলা
কী যে আশা জাগায় আমার ধ্যানে।
তোমার ওই আগুন-ক্ষরা, আশায় ভরা প্রাণেরে
আমি যে মনের মতো সত্য মানি।।”
সম্ভবত খান সাহেবের নবাব সিরাজউদ্দৌলা সিনেমার গানটি সেভাবে পাদপ্রদীপের তলায় নেই। তবে প্রয়োজনীয় ঘসামাজা সাপেক্ষে কথা ও সুর মিলিয়ে গানটি মারাত্মক আবেগময় দ্যোতনা সৃষ্টিতে সক্ষম বলে আমার অনুমান। অনেকটা যেমন জার্মান জাতীয় সঙ্গীতের অর্কেস্ট্রা শোনার সময় সকলের অনুভূত হয়। আলোচ্য গানটির অর্কেস্ট্রেশনও ভালো হবেৃ।
বন্ধুরা এই ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলা চলচ্চিত্রের সফল নির্মাতা খান আতার জীবন গল্পের চেপে থাকা কিছু ইতিহাস। সকলে ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন দেশকে ভালবাসুন, সত্যকে ভালবাসুন, প্রকৃত ইতিহাসকে ভালবাসুন, এই আশায় সকলের প্রতি ভালোবাসা ও শুভ কামনা রইলো। ই-মেইল : Shab_01912 815940@Yahoo.com লেখক :- নবাব সিরাজউদ্দৌলার ৯ম রক্তধারা প্রজন্ম। কালের সংবাদের সৌজন্যে




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com