শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ১২:৩৫ অপরাহ্ন

হজের গুরুত্ব ও করণীয়

মুফতি মাওলানা রুহুল আমিন:
  • আপডেট সময় সোমবার, ৪ জুলাই, ২০২২

কাবা শরিফ বা বায়তুল্লাহ শরিফের ঘরই আল্লাহ তায়ালার ঘর। হজরত আদম আল্লাইহিস সালামের সময় থেকে এই পবিত্র ঘর এখন পর্যন্ত বিদ্যমান রয়েছে ও কিয়ামত পর্যন্ত থাকবে। আকাশের ফেরেশতা যেমন বায়তুল মামুর তাওয়াফ করেন, দুনিয়ার ফেরেশতাও তদ্রুপ বায়তুল মামুরসদৃশ দুনিয়ার বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করতেন। আদম আ:-ও এই ঘর তাওয়াফ করতেন। তারপর সব পয়গম্বরই এই ঘর দর্শন ও তাওয়াফ করেছেন। তাই আল্লাহ তায়ালার সর্বাধিক পেয়ারা, সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বশেষ পয়গম্বর হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা সা:-কে এই ঘরের কাছে পাঠিয়েছেন, এই মহান ঘরের জিয়ারত ও তাওয়াফের জন্য সমগ্র বিশ্বের মুসলমানকে হুকুম করেছেন এবং পাপমুক্তির স্থান নির্বাচিত করেছেন। বিবেকের বিচারে ও মহব্বতের আইনে প্রত্যেক মুসলমানের এই কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে হজ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আল্লাহর রহমতে শরিয়তের হুকুম সহজ করে দেয়া হয়েছে। আল্লাহ পাক বলেছেন, ‘আল্লাহর উদ্দেশ্যে আল্লাহর ঘর জিয়ারত করা সেসব মানুষের ওপর ফরজ, যাদের সেখানে পৌঁছানোর মতো সঙ্গতি রয়েছে। এ কারণেই সব ফিকহের কিতাবে হজ ফরজ হওয়ার জন্য শর্ত লাগোনো হয়েছে।
হজের সফরের কদমে কদমে আধ্যাত্মিক ও নৈতিক উন্নতি সাধনের অভ্যাস হয়। আল্লাহর অবারিত রহমতের স্থান কেন্দ্রীয় দরবার বায়তুল্লায় গিয়ে যেন মানুষ নিজেকে সঁপে দিতে পারে। তাই আত্মশুদ্ধির জন্য এই সফর অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। মানুষ যদি একটু খেয়াল করে, তবে এই সফরে অনেক কিছু অর্জন করতে সক্ষম হয়। ‘সবর ঈমানের অর্ধেক’-এই সফরে মানুষের সবরের অভ্যাস খুব ভালোভাবে হয়। সবর অর্থ নফসের মতের বিরুদ্ধে নফসকে বাধ্য করা। খাওয়া-দাওয়া, ওঠা-বসা, কথাবার্তা সব ক্ষেত্রেই নফসকে তার মতের বিরুদ্ধে শক্তিশালী করা। ফলকথা এই যে, বিভিন্ন অসহনীয় কাজকে সহনীয় করে নফসকে পরিমার্জিত ও পরিশুদ্ধ করে নেয়ার এক সুবর্ণ সুযোগ। মুজাহাদাই মুশাহাদা অর্জন করার সোপান যেহেতু বাড়ির চিন্তা, বিষয়-সম্পত্তির চিন্তা ইত্যাদি সাংসারিক সব বিষয়াদি পরিত্যাগ করেই মানুষ হজে যাওয়ার ইচ্ছা করে। বাকি থাকে শুধু এক নফসের বিষয়। তা দমন করার উত্তম সুযোগ এই সফরে পাওয়া যায়। অবশ্য বান্দার কোনো কাজই ইরাদা ও চেষ্টা ছাড়া হাসিল হয় না। কাজেই আত্মশুদ্ধির ইচ্ছা ও চেষ্টা করা দরকার। শরিয়তের যাবতীয় হুকুম-আহকামের মধ্যে আল্লাহর হুকুম পালন করে, আল্লাহর রেজামন্দি ও সন্তুষ্টি হাসিল করে আখিরাতের মুক্তি লাভ করাই হজের প্রধান ও মুখ্য উদ্দেশ্য। হজের মধ্যে হজরত আদম আ: থেকে শুরু করে যত পয়গম্বর, গাউস, কুতুব, আবদাল, সিদ্দিকিন, শুহাদা, সালেহিন ওই পবিত্র স্থানগুলোতে তাশরিফ রেখেছেন তাদের মাজার ও স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে, যা অবলোকন করলে তাদের কামালিয়াত ও মহৎ গুণাবলি স্মরণ হয়। মানুষ ইচ্ছা করলে সেসব কামালিয়াত ও গুণাবলি নিজের মধ্যেও অনেকটা আয়ত্ত করতে পারে। যে মৃত্যুকে স্মরণ করলে মানুষের জাগতিক আশা-আকাক্সক্ষা হ্রাস পায়, তা অর্জন করার প্রধান উপায় হলো হজের এই সফর। মানুষ যখন এই সফরে রওনা হয়, তখন যেন মৃত্যুরই নমুনাস্বরূপ সংসারের মায়া ত্যাগ করে ও পরিপূর্ণ আত্মশুদ্ধি অর্জন করার এক চেষ্টায় মনোনিবেশ করে। হজের গুরুত্ব ও ফজিলত সম্পর্কে কিছু হাদিস রয়েছে সেগুলো হলো- নবী আল্লাইহিস সালাম ইরশাদ করেন, (যার ওপর হজ ফরজ হয়েছে তার হজের নিয়ত করা আবশ্যক) এবং যে হজ করার ইচ্ছা করেছে, তার দ্রুত হজ করা প্রয়োজন। তিনি আরো বলেছেন, যার প্রকাশ্য শরয়ি কোনো ওজর বা অভাব নেই, জালেম বাদশাহ যাকে বন্দী করে রাখেনি কিংবা অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী হয়নি সে যদি হজ না করে মৃত্যুবরণ করে, তবে (তার মৃত্যু মুসলমানের মৃত্যু হবে না) সে ইহুদি হয়ে বা নাসারা হয়ে মৃত্যুবরণ করুক। (দারেমি) আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। কী ভয়ঙ্কর সতর্কবাণী! হজরত রাসূল সা:-এর কাছে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, বান্দার কোন আমলটি সর্বশ্রেষ্ঠ? রাসূল সা: বলেছেন, সর্বশ্রেষ্ঠ আমল ও সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলকে বিশ্বাস করা। অর্থাৎ ‘ঈমান’। প্রশ্নকারী জিজ্ঞাসা করেন, তারপর কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? রাসূল সা: ইরশাদ করেন, আল্লাহর পথে যুদ্ধ। তারপর কোন আমল সর্বশ্রেষ্ঠ? এর উত্তরে রাসূল সা: বলেছেন, হজে মকবুল অর্থাৎ যে হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হয়। (বুখারি ও মুসলিম) নবী সা: বলেন, এক ওমরাহ থেকে অন্য ওমরাহ পর্যন্ত যা (সগিরা) গোনাহ হয়েছে, ওমরাহ তার জন্য কাফফারা এবং হজে মকবুলের পুরস্কার বেহেশত ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। রাসূল সা: বলেছেন, যে ব্যক্তি খাঁটি দিলে আল্লাহর উদ্দেশে হজ করবে ও হজের মধ্যে কোনো রকম গোনাহর কাজ না করবে এবং কোনো ফাহেশা কথা, ঝগড়া, গালাগালি অথবা কোনো নফসানি খাহেশের (নাফরমানির) কাজ না করবে। সে যখন হজ করে ফিরে আসবে, তখন সে সব গোনাহ থেকে এমন পবিত্র হয়ে যাবে, যেমন নবজাত শিশু হয়ে থাকে। হজ আল্লাহর দরবারে কবুল হলে সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়, এ কথাই এ হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়। সগিরা গোনাহ তো মাফ হয়ই, অনেক আলেমের মতে, হজে মাবরুরের দ্বারা কবিরা গোনাহও মাফ হয়ে যায়। কারণ, হজের মধ্যে বহু তাওবা-ইস্তেগফার করা হয়। কান্নাকাটি ও কাকুতি-মিনতি করে মাফ চাওয়া হয়। যার কারণে গোনাহে কবিরাও মাফ হয়ে যায়। কিন্তু হক্কুল ইবাদ, অর্থাৎ- পরের দেনা মাফ হয় না। আল্লাহ পাকের কত বড় রহমত যে, বান্দা ফরজ আদায় করলে সে তার কর্তব্য পালন করে। কিন্তু আল্লাহ পাক তাকে আরো কত পুরস্কার দান করেন।
হজ থেকে ফিরে আসার পর প্রত্যেক হাজী সাহেবকে অত্যন্ত সতর্কতা ও পরহেজগারির সাথে জীবনযাপন করবেন। হজের নাম দিয়ে হাজী সাহেব পদবি লাগিয়ে কোনো ধরনের সুবিধা ভোগ করবেন না। অপ্রয়োজনে হজের গল্প, মোয়াল্লেমদের দোষত্রুটি বা ব্যবস্থাপনার সমালোচনা করা যাবে না। হজে যা টাকা পয়সা খরচ হয়েছে তার জন্য আফসোস থেকে বিরত থাকতে হবে। এসব কাজে হজের সওয়াব নষ্ট হয়ে যায়। অনেকে আবার হজ করে এসে, হালাল কাজকর্মও করতে চায় না, এটিও ভুল। হালাল জীবিকা নির্বাহে কোনো দোষ নেই। কিন্তু খবরদার! হালাল করতে গিয়ে হারামের মধ্যে, লোভের ও পাপের মধ্যে অভ্যস্ত হওয়া যাবে না। আল্লাহ! আমাদের সব অপরাধ ক্ষমা করুন এবং হজে মাবরুর নসিব করুন। -পিআইডি ফিচার লেখক : খতিব, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com