সোমবার, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:৩১ পূর্বাহ্ন

২০২০ সালের দামে ফিরছে ভোজ্যতেলের বিশ্ববাজার

খবরপত্র ডেস্ক:
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১৫ জুলাই, ২০২২

কভিড পরিস্থিতিতে চাহিদা কমে যাওয়ার পাশাপাশি শ্রমিক সংকটে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের উৎপাদনে ঘাটতি তৈরি হয়েছিল। এর প্রভাব পড়েছিল কভিড-পরবর্তী লকডাউন উঠে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। ফেব্রুয়ারিতে শেষ সপ্তাহে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ, ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রফতানি বন্ধ ঘোষণায় ভোগ্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী উত্তাপে ঘি ঢেলে দেয়। কয়েক মাস ধরে দাম বেড়ে ফের কমতে শুরু করেছে ভোগ্যপণ্যসহ ভোজ্যতেলের বাজার। গত কয়েক মাসে ভোজ্যতেলের ঊর্ধ্বমুখী বাজার কমতে কমতে ফের ২০২০ সালের দামের কাছাকাছি ফিরে আসছে।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের মার্চে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত পাম অয়েলের সর্বোচ্চ দাম ওঠে ১ হাজার ৭৭৭ ডলারে। অপরদিকে সয়াবিনের দাম ইতিহাসের রেকর্ড দাম ওঠে মে মাসে। মার্চে দাম ১ হাজার ৯৫৭ ডলার, এপ্রিলে ১ হাজার ৯৪৮ ডলার এবং মে মাসে দাম উঠে যায় ১ হাজার ৯৬৩ ডলারে। সর্বশেষ ১৩ জুলাই পাম অয়েলের টনপ্রতি দাম কমতে কমতে ৯৪১ ডলার এবং সয়াবিনের দাম নেমে আসে ১ হাজার ৩৫৩ ডলারে। এমতাবস্থায় প্রতিদিনই পাম অয়েল ও সয়াবিনের দাম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমছে।
অপরদিকে ২০১৯ সালে পাম অয়েলের টনপ্রতি গড় দাম ছিল ৬০১ ডলার, ২০২০ সালে ৭৫২ ডলার ও ২০২১ সালে গড় দাম ছিল ১ হাজার ১৩১ ডলার। এছাড়া ২০১৯ সালে সয়াবিনের টনপ্রতি গড় দাম ছিল ৭৬৫ ডলার, ২০২০ সালে ৮৩৮ ডলার এবং ২০২১ সালে সয়াবিনের গড় দাম ছিল ১ হাজার ৩৮৫ ডলার। ২০২১ সালের মাসভিত্তিক গড় দামের চেয়েও সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম কমে যাওয়ায় দেশের বাজারে পণ্যটির দাম আগের অবস্থানে ফিরে যাবে বলে আশা করছে পাইকারি বিক্রেতা ও সাধারণ ভোক্তারা।
এদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমার পরিপ্রেক্ষিতে গত কয়েক মাস ধরে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করেছে আমদানিকারক ও মোড়কজাত কোম্পানিগুলো। এর মধ্যে গত ২৩ মে লিটারপ্রতি সয়াবিন ও পাম অয়েলের দাম ৫ রুপি, ১৭ জুন পাম অয়েল ৮ রুপি ও সয়াবিন ৬ রুপি এবং ৭ জুলাই উভয় ধরনের ভোজ্যতেলের দাম রেকর্ড ২০ রুপি হারে কমানোর ঘোষণা দিয়েছে শীর্ষ ভোজ্যতেল বিপণনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। ভারতে নিয়মিত বিরতিতে দাম কমানো হলেও বাংলাদেশে দাম কমানোর ক্ষেত্রে কিছুটা ধীর গতিতে এগোচ্ছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশে গত মার্চ মাসে লিটারপ্রতি সয়াবিনের দাম ছিল ১৬০ টাকা। পরে ৫ মে দাম এক লাফে ৩৮ টাকা বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়। এরপর ৯ জুন দাম আরেক দফা বাড়িয়ে লিটার করা হয় ২০৫ টাকা। যদিও বিশ্ববাজারে ধারাবাহিক দরপতনে দেশব্যাপী আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সয়াবিনের লিটারপ্রতি দাম মাত্র ৬ টাকা কমিয়ে ১৯৯ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশনের ভোজ্যতেলের দাম নির্ধারণ-সংক্রান্ত একটি কমিটির প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দাম কমানো বা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভোজ্যতেল বিপণনকারী কোম্পানিগুলোর সংগঠনকে মূল্য সমন্বয়ের অনুমোদন দেয়। বিশ্ববাজারে গত এক মাসে ব্যাপক দরপতন সত্ত্বেও নতুন করে দাম না কমানোয় ক্ষোভ জানিয়েছেন পাইকারি ব্যবসায়ী ও ট্রেডিং ব্যবসায়ীরা। তবে আমদানিকারকরা বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম অস্বাভাবিক কমলেও দেশের বাজারে দাম সমন্বয়ের ক্ষেত্রে প্রধান প্রতিবন্ধকতা দেখছেন ডলার, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিকে। বর্তমানে টনপ্রতি অপরিশোধিত পাম অয়েল ৯৪১ ডলারে নেমে এলেও শিপিং চার্জ দ্বিগুণ পর্যন্ত বেড়ে টনপ্রতি ১৫০ থেকে ১৭৫ ডলারে পৌঁছেছে। তাছাড়া এক বছর আগেও ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ছিল ৮২-৮৩ টাকা। বর্তমানে সরকারিভাবে ডলারের মূল্য ৯৩ থেকে ৯৪ টাকা নির্ধারিত থাকলেও কার্ব মার্কেট থেকে ১০ টাকারও বেশি দামে ডলার সংগ্রহ করতে হচ্ছে আমদানিকারকদের। বিশ্ববাজারে দাম অস্বাভাবিক কমলেও দেশে ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয়ে এটাকেই সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে মনে করছেন তারা। এক্ষেত্রে দেশে ভোজ্যতেল বিপণনে সরকারি হস্তক্ষেপ বন্ধ করে দাম নির্ধারণে কোম্পানিগুলোকে স্বাধীনতা দেয়ার পক্ষে আমদানিকারকদের অনেকে। তাদের দাবি, পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে না দিয়ে সরকার তদারকি করলে ব্যবসায়ীদের নিজেদের প্রয়োজনে ও প্রতিযোগিতার কারণে আমদানি মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে এমনিতেই ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ করবে। দাম বেঁধে দেয়ার কারণে চাইলেও নির্ধারিত দাম থেকে কম দামে পণ্য বিক্রি করতে পারছে না আমদানিকারকরা।
জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম প্রতিদিনই কমছে এটা ঠিক। তবে ভোজ্যতেলের এফওবি দাম কমলেও বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া এবং ডলারের উচ্চমূল্যের কারণে দাম যতটা কমেছে, সে অনুপাতে কস্টিং আগের অবস্থানে ফিরে যাচ্ছে না। আমদানিকারকদের চেয়ে সরকারই বেশি ভোজ্যতেলের দাম কমাতে তৎপর। আমদানিকারকরা যত দ্রুত সম্ভব পণ্য আমদানির পর রিফাইন করে বিপণনের মাধ্যমে ব্যাংকের দায় পরিশোধে তৎপর থাকে। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক আনুষঙ্গিক পণ্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে ভোজ্যতেলের দেশীয় বাজার কয়েক বছর আগের অবস্থানে ফিরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ী ও ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়েও খোলা ভোজ্যতেলের দাম আরো কম। অর্থাৎ সরকারি নির্ধারিত দামের চেয়েও কম দামে ভোজ্যতেল বিক্রি করছে কোম্পানিগুলো। বিশ্ববাজারে প্রতিদিনই দাম কমতে থাকায় পণ্যটির কেনাবেচাও আশঙ্কাজনক হারে কমে গিয়েছে। এ কারণে আগের মজুদ থাকায় আমদানিকারকরাও ভোজ্যতেল আমদানিতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন।
পাইকারি বাজার সূত্রে জানা গিয়েছে, ঈদের পর লেনদেন শুরু হওয়া বাজারে খোলা পাম অয়েলের এসও (সরবরাহ আদেশ) মূল্য নেমে এসেছে মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) ৫ হাজার টাকায়। কয়েক মাস আগেও একই ধরনের পাম অয়েলের দাম ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। বুধবার পাম অয়েলের পাইকারি (সরাসরি সরবরাহযোগ্য) লেনদেন মূল্য ছিল ৫ হাজার ৪০০ টাকা। অন্যদিকে পাম অয়েলের দাম অস্বাভাবিক কমলেও খোলা সয়াবিনের দাম গত কয়েক মাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমেনি। অর্থাৎ কয়েক মাস আগেও পাইকারিতে খোলা সয়াবিনের মণপ্রতি দাম উঠেছিল ৮ হাজার টাকায়। অন্যদিকে বুধবার পাইকারিতে সয়াবিন লেনদেন হয়েছিল ৭ হাজার ৫০০ টাকা এবং এসও লেনদেন হয়েছিল ৭ হাজার টাকা।
দ্য চিটাগাং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি মাহবুবুল আলম এ বিষয়ে বলেন, ভোজ্যতেলের বিশ্ববাজার অস্বাভাবিক কমছে। প্রতিদিনই দাম কমে যাওয়ায় পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের লোকসানের মধ্যে পড়ছেন। এক সময় দাম বৃদ্ধিজনিত কারণে প্রশাসনিক তৎপরতা দেখা গেলেও এখন যেভাবে ব্যবসায়ীরা লোকসান দিচ্ছেন সে বিষয়ে কারো নজর নেই। বড় দরপতনে ব্যবসায়ীদের লোকসান এড়াতে করণীয় কী হতে পারে সে বিষয়টিরও কোনো সমাধান নেই। ভোক্তাদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার পাশাপাশি ব্যবসায়ী সমাজকে সুরক্ষা দিতে বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।
আমদানিকারকরা বলছেন, জ্বালানি ও ডলার মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি কয়েক মাস আগে বিদ্যুতের দামও বাড়ানো হয়েছে বাংলাদেশে। তাছাড়া গত কয়েক বছরের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ছাড়াও আনুষঙ্গিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় ভোজ্যতেলের দাম কমলেও দেশের বাজারে আগের দামে ফিরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সরকারিভাবে ভ্যাট কমানো হলেও সেটি ভোজ্যতেলের আমদানি ও বিপণনের ক্ষেত্রে তেমন একটা প্রভাব ফেলেনি। এক্ষেত্রে আমদানিতে শুল্ক কাঠামোর পুনর্বিন্যাস ছাড়া অতি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য হিসেবে ভোজ্যতেলের দাম বড় আকারে কমানো হলে আমদানি কমে গিয়ে সংকট তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।-বণিকবার্তা




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com