জাপানের সাবেক সফল প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের এক সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে এই লেখাটি গত পহেলা এপ্রিল ২০২২ জাপান ফরওয়ার্ড নামক অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। গতকাল তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন। তার স্মরণে এই সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ অনুবাদ করে এখানে দৈনিক ইত্তেফাকের সৌজন্যে দৈনিক খবরপত্রের পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো মায়ুমি ওগাওয়া
ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ জাপান থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দূরবর্তী সমস্যা নয়। ইউক্রেন এবং তাইওয়ানের চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা করুন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। ‘প্রতিরক্ষাহীন জাপানের পাশে কোনো দেশই যুদ্ধ করবে না। তাই আক্রমণকারীকে আক্রমণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত করতে আমাদের সামরিক ঘাঁটিতে শত্রুকে আক্রমণ করার জন্য আঘাত করার ক্ষমতা থাকতে হবে এবং শাস্তি ও প্রতিশোধের জন্য মার্কিন প্রতিরোধ ক্ষমতা ভাগ করে নিতে হবে।’Íএরূপ কথা বলেন জাপানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে গত ২৫ মার্চ দ্য সানকে একটি সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি বলেন যে, জাপান এই সামরিক সংঘাতের জন্য অপরিচিত নয়। জাপানের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ইউক্রেনের সঙ্গে মিল রয়েছে। এই পরিস্থিতি থেকে জাপানের শেখার পাঠ হিসেবে যৌথ নিরাপত্তার প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। তার মতে, ‘ইউক্রেন যদি উত্তর আটলান্টিক চুক্তি সংস্থার (ন্যাটো) সদস্য হতো, তাহলে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করত না। কারণ কোনো দেশই ইউক্রেনের সরাসরি মিত্র নয়, কেউ তার পাশে লড়াই করবে না।’
ইউক্রেন রাশিয়ার আগ্রাসনকে পুরোপুরি প্রতিহত করেছে। রাশিয়ার পদক্ষেপের সরাসরি ফল হলোÍজার্মানিসহ ইউরোপীয় দেশগুলো প্রতিরক্ষা ব্যয়ে তাদের প্রতিশ্রুতি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। এই উন্নয়নের দিকে ইঙ্গিত করেই আবে সেই সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমরা আমাদের নিজস্ব প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের জাতিকে রক্ষা করি। সাম্প্রতিক নিম্নকক্ষ নির্বাচনে এলডিপির প্রতিরক্ষা ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) কমপক্ষে ২ শতাংশ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি প্রদান অনিবার্য। কোনো দেশ এমন একটি জাতির সঙ্গে লড়াই করে না যেটি নিজেকে রক্ষা করে না।’ তিনি জাপানকে শত্রুর সামরিক লক্ষ্যবস্তুগুলোতে আক্রমণ করার জন্য নিজস্ব প্রথম স্ট্রাইক সক্ষমতা অর্জনের আহ্বান জানান। উত্তর কোরিয়ার ২৪ মার্চ একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র উৎেক্ষপণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে, আবে পিয়ংইয়ংকে জাপানে পারমাণবিক অস্ত্রের লক্ষ্য থেকে বিরত করার জন্য প্রয়োজনীয় পারমাণবিক প্রতিরোধের বিষয়ে একটি বিতর্কের প্রস্তাব করেছিলেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার পদক্ষেপ জাপানের সঙ্গে আলোচনা স্থগিত করার জন্য দায়ী। সে সময় শিনজো আবে বলেন, ‘আমার প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন ২০১৯ সালের অক্টোবরে ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল, যখন আমরা দুই জনেই সম্রাট নারুহিতোর আরোহণ ঘোষণা করার জন্য জাপানের সোকুইরি-সেইডেন-নো-গি নামক রাজকীয় সিংহাসন অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলাম। জেলেনস্কিকে প্রথমে কিছুটা নার্ভাস দেখাচ্ছিল, কিন্তু একবার আমরা কথা বলতে শুরু করলে, আমরা শিগ্গিরই একে অন্যের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলপ্রয়োগে বিশ্বাস করেন এবং তা ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। যুদ্ধোত্তর যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং প্রাক্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধের সময় যেমনটি হয়েছিল, পুতিন ন্যাটোকে ইউক্রেনে তার প্রভাবের ক্ষেত্র প্রসারিত করার অনুমতি দিতে পারেননি। আমি ভেবেছিলাম পুতিন একজন আদর্শবাদী নন বরং একজন বাস্তববাদী। আমি আশ্চর্য হয়েছি যে, তিনি দোনেস্ক এবং লুগানস্ক (ডিপিআর এবং এলপিআর) এর ‘জনগণের প্রজাতন্ত্র’ হিসেবে স্বঘোষিত দুটি পূর্ব অঞ্চলের বাইরেও রাশিয়ান সৈন্য পাঠিয়েছেন। প্রো-রাশিয়ান গ্রুপগুলো কার্যকরভাবে ডিপিআর এবং এলপিআর নিয়ন্ত্রণ করে।’
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গত ২১ মার্চ, রাশিয়া জাপানের সঙ্গে শান্তিচুক্তির জন্য আলোচনা স্থগিত করার ঘোষণা দেয়। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন জাপানের পক্ষে আলোচনা চালিয়ে যাওয়াকে কঠিন করে তুলে। আলোচনার ভাঙনে রাশিয়ার দোষ ছিল, জাপানের নয়।
রাশিয়া আমাদের প্রতিবেশী দেশ এবং একটি সামরিক পরাশক্তি। আমাদের সরকার উত্তরাঞ্চলীয় অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য এবং একটি শান্তিচুক্তি সম্পন্ন করার জন্য তার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে, যা দ্বীপের প্রাক্তন বাসিন্দাদের ও তাদের পরিবারের দীর্ঘদিনের লালিত ইচ্ছা। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ জাপান থেকে বিচ্ছিন্ন কোনো দূরবর্তী সমস্যা নয়। ইউক্রেন এবং তাইওয়ানের চারপাশের পরিস্হিতি সম্পর্কে চিন্তা করুন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। ইউক্রেন এবং তাইওয়ান একই রকম যে, উভয় দেশের আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মিত্র দেশ নেই। আর যারা তাদের বিরোধিতা করছে, যথাক্রমে রাশিয়া ও চীন, উভয়েই জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্হায়ী সদস্য। অন্যদিকে, মূল ভূখ- চীন তাইওয়ানকে নিজের অংশ হিসেবে বিবেচনা করে এবং ভবিষ্যতে উভয় দেশকে একীভূত করার তার উচ্চাকাক্সক্ষা গোপন করে না। এছাড়াও, তাইওয়ানে মূল ভূখ-ের অনেক চীনা বাসিন্দা রয়েছে।
চীনের নেতা শি জিনপিং হয়তো বিষয়টিকে ভিন্নভাবে দেখছেন। ইউক্রেন জাতিসংঘের সদস্য, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় দ্বারা একটি জাতি হিসেবে স্বীকৃত। তবে চীন জোর দিয়ে বলেছে যে, তার তাইওয়ান সমস্যা একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যা। তাছাড়া, মাত্র কয়েক ডজন দেশ তাইওয়ানকে সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। শি অবশ্যই ইউক্রেনের পরিস্থিতির ওপর গভীর নজর রাখছেন।
ইউক্রেন আক্রমণ থেকে জাপান শিক্ষা নিতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না যদি এর স্হায়ী সদস্য দেশগুলোর মধ্যে একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। শিনজো আবে বলেন, ‘ইউক্রেন ১৯৯৪ সালের বুদাপেস্ট মেমোরেন্ডামের অধীনে প্রাক্তন সোভিয়েত যুগ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত পারমাণবিক অস্ত্র রাশিয়াকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। বিনিময়ে ইউক্রেনের মাতৃভূমির নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া। ইউক্রেন যদি তার কিছু কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র রাখত, তবে দেশটি আজ যা ঘটছে তা হয়তো অনুভব করত না।’ শিনজো আবে মিথ্যা বলেননি। অতএব, উত্তর কোরিয়াকে জাপানের বিরুদ্ধে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা থেকে বিরত রাখতে আমাদের বাস্তবসম্মত প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। প্রতিরোধ দুটি রূপে আসে। একটি হলো অস্বীকারের মাধ্যমে প্রতিরোধ, অন্যটি হলো প্রতিশোধ নেওয়া ও শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দ্বারা প্রতিরোধ, যা আক্রমণকারীকে আক্রমণ করতে দ্বিধাগ্রস্ত করে তোলে। অনুবাদ: ফাইজুল ইসলাম