এক প্রান্তে পেশোয়ার, অন্য প্রান্তে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলকে সংযুক্ত করেছে খাইবার পার্স পৃথিবীর অন্যতম আকর্ষণীয় গিরিপথ। সৈয়দ মুজতবা আলী এ পথের কী উচ্ছ্বসিত বর্ণনা দিয়েছেন! এ পথেই ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে মহাবীর আলেকজান্ডারের বাহিনী। হিন্দুকুশ পর্বতমালা আর খাইবার গিরিপথের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পেশোয়ারের জীবন ও ইতিহাস। পেশোয়ারকে তাই অনেকে বলেন গেটওয়ে অব ইন্ডিয়া। পেশোয়ার ভারতবর্ষের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। সংস্কৃত পুরাণে এ স্থানকে বলা হয়েছে পুরুষপুরা বা পুরুষ মানুষের শহর। জোরাস্ট্রিয়ান ঈশ্বর আহুর মাজদার সৃষ্ট যে সাতটি শ্রেষ্ঠ স্থানের কথা বলা হয় তার একটি পেশোয়ার। ব্যাক্ট্রিয়ান সাম্রাজ্যের মুকুটের শ্রেষ্ঠ মুক্তো হিসেবে পেশোয়ারকে বর্ণনা করা হয়েছে। পেশোয়ার এমনকি সৌন্দর্যে ও গুরুত্বে তক্ষশীলাকেও হারিয়ে দিয়েছে।
এ শহরকে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক বলেন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে পুরনো ও এখনো জীবন্ত শহর। ২০১০ সালে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ওপর ভিত্তি করে পাকিস্তানের আর্কিওলজি বিভাগ এ দাবি করে। তাদের কথায় ৫৩৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দ সময়কালে পেশোয়ার শহরের সমৃদ্ধ অবস্থা নির্দেশ করে এমন ঐতিহাসিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত প্রমাণাদি হাজিরের কাজটি এখনো সম্পন্ন হয়নি। পাকিস্তানের প্রত্নতাত্ত্বিক ড. ইহসান আলী মনে করেন এককালে গান্ধারার রাজধানী পেশোয়ারের উদ্ভব সূত্র কালের গহবরে হারিয়ে গেছে এবং পেশোয়ারের বয়স নিখুঁতভাবে হিসেব করা এখনো সম্ভব হয়নি। অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক এই সবচেয়ে পুরনো, জীবিত শহরের ধারণাটিকে নাকচ করে পেশোয়ারকে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম পুরনো ও জীবন্ত শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। পেশোয়ারের দাবিকৃত সময়ের কাছাকাছি অরো বেশ কয়েকটি নগরকেন্দ্রের অস্তিত্ব উপমহাদেশে পাওয়া যায় যেগুলো এখনো শহর হিসেবে টিকে আছে।
বেদ পুরাণে এ স্থানকে বলা হয়েছে পুষ্কলাবতী। সংস্কৃত পুরাণের পুরুষপুরা ইতিহাসে উদ্ধৃত হয়েছে এবং এ নাম থেকেই পেশোয়ার উদ্ভূত বলে মনে করা হচ্ছে। এটাই ছিল গান্ধার মহাজনপদের রাজধানী। পেশোয়ার অঞ্চলে প্রাপ্ত পা-ুলিপি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ইতিহাসবিদরা ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে খ্রিস্টজন্মের ২০০ বছর আগে এটা ছিল প্রাচীন ভারতীয় এক শিক্ষাকেন্দ্র। পারস্যের আকেমেনিড শাসনামলে (খ্রিস্টপূর্ব ৫৫০ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০) পেশোয়ার পারস্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। খ্রিস্টজন্মের ৩৩০ বছর আগে আলেকজান্ডারের বাহিনী শহরটি অবরোধ করে দখলে নিয়ে নেয়। তারপর শহরের শাসনভার চলে আসে আলেকজান্ডারের উত্তরসূরি প্রথম সেলুকাসের হাতে। মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শহরে তার শাসন প্রতিষ্ঠিত করেন। সে সময় এখানকার অধিবাসীদের প্রায় সবাই ছিল গ্রিক ও বৌদ্ধ। যৌথ সাম্রাজ্যের পতনের পর ইন্দো-গ্রিকরা ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু খ্রিস্টজন্মের ১০ বছর পর ইন্দো-সাইথিয়ান আক্রমণে ইন্দো-গ্রিকরা পেশোয়ার ছেড়ে চলে যায়। তারপর ক্রমান্বয়ে ইন্দো-পার্সিয়ান ও কুশানরা রাজত্ব করে। কুশান সম্রাট কণিষ্ক ১২৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে শাসন করেন এবং রাজধানী পেশোয়ার উপত্যকার পুষ্কলাবতীতে স্থানান্তর করেন। সে সময় বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ব্যাপক আগমন ঘটে। কুশানরা বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে এবং পেশোয়ার তখন বৌদ্ধ ধর্ম শিক্ষা ও চর্চার কেন্দ্র হয়ে ওঠে। রাজা কণিষ্ক সে সময় পেশোয়ারে যে ‘স্তূপ’ নির্মাণ করেছিলেন তা তখনকার পৃথিবীর সর্বোচ্চ ভবন। ৪০০ খ্রিস্টাব্দে চৈনিক পর্যটক ও বৌদ্ধধর্মীয় প-িত ফাহিয়েন (৩৩৭-৪২২) লিখেছেন, পর্যটকদের দেখা সব স্তূপের মধ্যে সৌন্দর্য ও শক্তিতে পেশোয়ারের এ স্তূপের সমকক্ষ কোনোটিই নেই। তিনি লিখে গেছেন, এর উচ্চতা ৪০ চ্যাঙ্গের বেশি হবে (৩৯০ ফুট)। বজ্রপাতে স্তূপটি ধ্বংস হলে বহুবার এর মেরামত করা হয়। ১৯০৯ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক ডি বি স্কুনারের তত্ত্বাবধানে স্তূপের তলদেশে একটি চেম্বার থেকে একটি অলংকার সজ্জিত দুর্লভ ক্যাসকেট উদ্ধার করা হয়। এর গায়ে লিপিবদ্ধ আছে ক্যাসকেটের দাতা সম্রাট কণিষ্ক। আরব রাজত্ব খোরাসান পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ইতিহাসের একটি বড় বাঁক সামনে এসে যায়। খোরাসান হচ্ছে এখনকার আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান ও উত্তর-পূর্ব ইরান। আরবশাহির অংশ হয়ে যাওয়ায় এতদিনকার লালিত ধর্ম ফেলে খোরাসান ও সংলগ্ন অঞ্চলের জনগণের মধ্যে ধর্মান্তরিত হওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। এ হিড়িক যত না ধর্মীয় কারণে তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রয়োজনে, অস্তিত্ব রক্ষার জন্য। বৌদ্ধ, হিন্দু ও অগ্নি উপাসক পাখতুন জোরাস্ট্রিয়ানরা দল বেঁধে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করল। কুশান রাজত্ব অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে কাবুল শাহি কাবুল উপত্যকা ও গান্ধারা (পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) তৃতীয় থেকে নবম শতাব্দী পর্যন্ত শাসন করে। কাবুল শাহি মূলত বৌদ্ধ শাহি ও হিন্দু শাহি। ৮৭০ সালের দিকে এ অঞ্চলের ওপর মুসলমান শাসকদের নজর পড়ে। এর মধ্যে সবুক্তগীনের দৌরাত্ম চলতে থাকে। ১০০১ সালে গজনির তরুণ সুলতান মাহমুদ ক্ষমতা দখল করেন। হিন্দু কর্তৃত্ব অব্যাহত থাকে। বাহলুল লোদির নেতৃত্বে ১৪৫১ সালে লোদি সাম্রাজ্যের সূচনা হয়, তখন রাজধানী দিল্লি। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় পেশোয়ার মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবর স্বয়ং পেশোয়ারে আসেন এবং বাগরাম নামের একটি শহরের গোড়াপত্তন করে ১৫৩১ সালে সেখানকার একটি দুর্গ পুনর্র্নিমাণ করেন। শের শাহ সুরির হাতে সুর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নির্মাণ করলে পেশোয়ার-দিল্লি ও খাইবার পাস হয়ে পেশোয়ার-কাবুল যোগসূত্র স্থাপতি হলে পেশোয়ার রেনেসাঁর সূচনা হয়। স্বল্পকালীন সুর সাম্রাজ্যের শাসনের পর মোগলদের পুনরুত্থান ঘটে এবং সম্রাট আকবর পেশোয়া নামে স্থানটিকে রেকর্ডভুক্ত করেন। পেশোয়া মানে সীমান্তের স্থান। সে সময় দক্ষিণ এশিয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমান শিক্ষাবিদ ও কারিগররা এখানে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানীয় পর্যায়ে এক ধরনের ইসলামিক সালতানাত কায়েম হয়। পাখতুন কবি ও যোদ্ধা কুশাল খটক আফগান অঞ্চল স্বাধীন করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং বিদ্রোহ করেন। তিনি মোগল সাম্রাজ্যের, বিশেষ করে আওরঙ্গজেবের শত্রুতে পরিণত হন। মোগল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়লে পেশোয়ার পাখতুন নেতা আহমেদ শাহ দুররানির বশ্যতা মেনে ১৭৪৭ সালে তার সাম্রাজ্যের সঙ্গে একীভূত হয়। এক দশক পর পশ্চিম ভারতের মারাঠা সাম্রাজ্য ৮ মে ১৭৫৮ পেশোয়ার দখল করে নেয়। তবে পরের বছরই আহমদ শাহ দুররানি পেশোয়ার পুনর্দখল করেন এবং ১৮১৮ পর্যন্ত পেশোয়ার দুররানি শাসনের অধীনে থাকে। আহমদ শাহর পুত্র তৈমুর শাহ দুররানি ক্ষমতাসীন হয়ে ১৭৭৬ সালে পেশোয়ারকে তার শীতকালীন রাজধানীতে পরিণত করেন। ততদিনে পাঞ্জাবে শিখরা শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ১৮১৮ সালে মহারাজা রণজিৎ সিং পেশোয়ার দখল করে নেন। শিখ শাসনে পোশায়ার ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মসজিদ, বড় সৌধ, বাজার সব ভেঙেচুরে ফেলা হয়। আর্থিক দিক থেকে শহরটি অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যায়। ১৮৩৫ সালে আফগান আমির দোস্ত মোহাম্মদ খান শিখদের হাত থেকে পেশোয়ার পুনর্দখল করার উদ্যোগ নিলেও যুদ্ধে পরাজিত হন। মহারাজা রণজিৎ সিংয়ের মৃত্যু এবং দ্বিতীয় ইংরেজ-শিখ যুদ্ধের পর ১৮৪৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেশোয়ারকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত করে। ১৮৫৭-এর সিপাহি বিদ্রোহের সময় পাঞ্জাবের ৪০ হাজার স্থানীয় সৈনিকের অস্ত্রহরণ করা হয় এবং ব্রিটিশদের চোখে পাঞ্জাব সন্দেহভাজন শত্রু অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হয়। অন্যদিকে পেশোয়ার ও সীমান্ত প্রদেশের নেতরা ব্রিটিশের প্রতি অনুগত থেকে যায় এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে নিজেদের দূরে রাখে।
১৮৬৮ সালে ব্রিটিশরা পেশোয়ারে বিশাল ক্যান্টনমেন্ট নির্মাণ করে এবং শহরটিকে সীমান্ত সদর দপ্তরে পরিণত করে। মূলত এ আনুগত্যের কারণে এখানে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ বেড়ে যায় এবং শিখদের হাতে ধ্বংস হওয়া পেশোয়ার পুনর্গঠিত হতে থাকে। পরবর্তী সময়ে স্থানীয় নেতৃত্ব চলে আসে সীমান্ত গান্ধী আবদুল গাফফার খানের হাতে। ১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করলে পেশোয়ার পাকিস্তানের জন্য কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এ গুরুত্ব আরো বেড়ে যায়। আফগানিস্তান ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিনদের রাজনৈতিক কেন্দ্র হয়ে ওঠে পেশোয়ার। আফগান শরণার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে পেশোয়ারের নেতৃত্ব মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। বৃহৎ শক্তিগুলোর ক্ষমতার দ্বন্দ্বে আফগানিস্তান ক্রীড়নকে পরিণত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ছত্রচ্ছায়ায় তালেবান শক্তির উত্থান ঘটেছে, আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এখন তাদেরই হাতে। আফগানিস্তানে যা-ই ঘটুক তার অভিঘাত পেশোয়ারে পড়তে বাধ্য। পেশোয়ার এখন সেই খেসারতই দিয়ে যাচ্ছে।
গুল-ই-দাউদির একটি কবিতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনিও তাই চাইছিলেন যেন আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয়: আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি
আমি পাকিস্তান থেকে বলছি…
গতকাল ১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ আমাদের
পেশোয়ার শহর আক্রান্ত হয়েছে।
সন্ত্রাসবাদ এখন তার শীর্ষে
সন্ত্রাসীরা নিষ্পাপ শিশু ও তাদের শিক্ষকদের
নির্বিচারে নির্মমভাবে খুন করেছে। এই শহীদদের
জানা ছিল না, এভাবেই তাদের জীবন শেষ হবে।
আমাদের সমস্ত জাতির রক্তক্ষরণ হচ্ছে; ছাত্রদের সামনে
শিক্ষকদের গায়ে আগুন দিয়েছে, নিরপরাধ দেহে বুলেট।
এর নাম মানবতা হতে পারে না
এটা ইসলামের শিক্ষা হতে পারে না
সন্ত্রাসী আল্লাহর নামে যা করেছে তা কখনো
আল্লাহর চাওয়া হতে পারে না।
আপনারা সবাই এই তরুণ শহীদদের জন্য
প্রার্থনা করুন মানবতার কোনো সীমান্ত নেই।
১৬ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ত্রাসীদের আক্রমণে পেশোয়ারে অন্তত ১৪৯ জন নিহত হয়। তার মধ্যে ১৩২ জন স্কুলশিশু। পেশোয়ার বহুবার আক্রান্ত হয়েছে, প্রতিহত করেছে ‘ইতিহাসের অন্যতম পুরনো শহর’ হিসেবে, বহিঃশত্রুর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জিতেই টিকে রয়েছে। কিন্তু একালের শত্রুতার ধারণাটি ভিন্ন। ভেতরের শত্রুই পেশোয়ারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। জিহাদের নামে মানবতা বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এমএ মোমেন: সাবেক সরকারি কর্মকর্তা