সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বায়ুদূষণ বাড়ছে বাংলাদেশে। বিশেষ করে ঢাকা শহরে এই দূষণের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। নীরব ঘাতক বায়ুদূষণ কেড়ে নিচ্ছে লাখো প্রাণ, অসুস্থ হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। শুধু তাই নয়, বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ুদূষণ একাধিক রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ফলে কমছে দেশের মানুষের গড় আয়ু। তবে বায়ুদূষণের সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপর। অ্যাজমাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা।
পরিবেশবিদরা বলছেন, ঢাকাসহ সারাদেশকে দূষণের হাত থেকে বাঁচানোর দায়িত্ব সবার। শীতকাল অপেক্ষাকৃত শুষ্ক ঋতু হওয়ায় এই সময় ধুলাবালির পরিমাণও বেড়ে যায়। এর সঙ্গে ইটভাটা ও সিমেন্ট কারখানার ধুলার মিশ্রণ ঘটলে বায়ুদূষণ বাড়ে। শীতে আর্দ্রতা কম থাকায় বাতাসে অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার উপস্থিতিও বেড়ে যায়। এছাড়া বায়ুদূষণের ফলে চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রকৃতি। বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে। এছাড়া বয়স্ক যারা আছেন, গর্ভবতী মায়েরাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। শিশুরা পৃথকভাবে যে ভালো থাকতে পারবে সেটি তো নয়। বায়ুদূষণ হলে সবাই প্রভাবিত হবে। তবে মাস্ক পরলে কিছুটা রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু কতোক্ষণ তাদের মাস্ক পরিয়ে রাখা সম্ভব
রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে রাইসা। করোনার কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। খোলার পর উৎসাহ নিয়ে নিয়মিত ক্লাসে অংশ নিচ্ছিল সে। তবে সম্প্রতি অ্যাজমার সমস্যায় ভুগছে রাইসা। চিকিৎসকরা বলছেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে, রাইসাও সেই দূষণে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যায় ভুগছে। রাইসার মা সাবিনা চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ ছিল। এখন আবার মেয়েটা শ্বাসকষ্টে ভুগছে। এছাড়া নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, অতিরিক্ত ধুলাবালির কারণেই তার এ সমস্যা হয়েছে। তাই কিছুদিন বাসায় বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিয়েছেন। এমন হলে বাচ্চার পড়াশোনা কীভাবে চলবে সেটি নিয়ে আমি চিন্তিত। বায়ুদূষণ অসহনীয় হয়ে পড়েছে। আমরা বড়রাই তো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি, ছোটরা আরও বেশি হচ্ছে। সিদ্ধেশ্বরী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহাব উদ্দিন মোল্লা জাগো নিউজকে বলেন, শিশুদের ওপর বায়ুদূষণের মারাত্মক প্রভাব পড়ছে। তারা তো নিজেদের প্রটেক্ট (সুরক্ষা) করতে পারে না। নিজেদের সুরক্ষার বিষয়টি তারা সেভাবে বোঝেও না। ছোট বাচ্চারা সহজেই বায়ুদূষণে আক্রান্ত হয়। তারা অনেক সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা সেভাবে মেইনটেইন করতে পারে না। অনেক সময় তারা না বুঝেও অনেক কিছু করে ফেলে।
ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ু ও শব্দদূষণ। বায়ুদূষণের জন্য শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, শিশুদের উচ্চতা মাটির কাছাকাছি। ফলে রাস্তায় চলাচলের সময় গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হয়, সেটি শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে। শিশুদের ইমিউনিটি সিস্টেম তুলনামূলকভাবে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম থাকায় তারা আক্রান্ত হয় বেশি
তিনি বলেন, বাংলাদেশের পরিবেশে কলেজে যাওয়ার পর শিশুদের সেন্স সেভাবে গ্রো (মানসিক বিকাশ) করে। কিন্তু প ম শ্রেণি পর্যন্ত তারা পরিবেশের কিছুই বোঝে না। তাদের কাছে সবকিছুই প্রায় নতুন। ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত কিছুটা বোঝে। কিন্তু তারপরও তারা সবকিছু করতে চায় না, করে না। ইদানীং দেখছি আমার সন্তান স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে চাচ্ছে না, মাস্ক, টিস্যু ব্যবহার করতে চাচ্ছে না। এখানে তো আর জোরাজুরি করে করা যাবে না। এসব কারণেই কিন্তু তারা নানাভাবে আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, স্কুলে শিক্ষার্থীরা অল্প সময়ের জন্য আমাদের কাছে থাকে। আমরাই বা তাদের এমনকি পরিবেশ দিতে পারছি? কয়টি স্কুলে দুটি গাছ আছে? কয়টি স্কুল প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে? স্কুলে যেমন একটি বাগান থাকার কথা, সেটি কি আমরা তাদের দিতে পারছি? পারছি না। একটা পুকুর থাকলে নির্মল বাতাস পেতো, আমাদের সেরকম পুকুর করার সুযোগ নেই। যদি একটি চৌবাচ্চাও থাকতো তাহলেও পরিবেশকে ভালো করতে পারা যেতো। বাসায় বসেও তারা একই সমস্যায় পড়ছে। প্রত্যেক বাসায় ছাদবাগান, খোলা জায়গা দরকার, তা তো করতে পারছি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে বায়ুদূষণে শিশুদের প্রভাব নিয়ে শঙ্কিত, আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত। সম্প্রতি বৈশ্বিক বায়ুদূষণ নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (ইপিআইসি)।
ইপিআইসির গবেষকরা বলছেন, দূষণের কারণে গড়ে সাত বছর করে আয়ু হারাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ইপিআইসি প্রবর্তিত এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্স বা একিউএলআই নির্ণয়ে গবেষকরা বাতাসে পিএম২.৫ (ক্ষতিকর ভাসমান কণা যা ফুসফুসের ক্ষতি করে) এর মাত্রা হিসাব করতে স্যাটেলাইট তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন। এরই ভিত্তিতে দেওয়া প্রতিবেদনে বাংলাদেশকেই বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, বায়ুদূষণের এই সূচকের হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার পাঁচ দেশের চারটিই দক্ষিণ এশিয়ায়। বায়ু মানের দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী হচ্ছে ভারতের নয়াদিল্লি। ভারতের পরই রয়েছে বাংলাদেশ। গবেষকদের মতে, যদি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী দূষণের মাত্রা কমানো যেতো তাহলে পুরো বাংলাদেশের মানুষ আরও ৫ দশমিক ৪ বছর বেশি বাঁচতেন। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণ না করার কারণে ঢাকায় বসবাসকারীদের গড় আয়ু ৭ দশমিক ৭ বছর কমেছে। বায়ুদূষণ না থাকলে গড়ে ঢাকাবাসী আরও প্রায় ৮ বছর বেশি বাঁচতেন।
এ বিষয়ে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান জাগো নিউজকে বলেন, বায়ুদূষণের যে প্রভাব এটি নিঃসন্দেহে একটি মারাত্মক পরিণতি। কারণ আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন বা যা কিছু বলি না কেন, আমাদের স্বাস্থ্য ভালো না থাকলে কোনো লাভ নেই। আমাদের সন্তানরা যদি ভালো না থাকে, আমরা যদি অসুস্থ হয়ে যাই, তাহলে এতো উন্নয়ন দিয়ে কি করবো? আমরা যে পলিসি গ্রহণ করি, সেটি দেশীয় আছে এবং আন্তর্জাতিকও আছে। প্রাইভেটকারকেন্দ্রিক যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, সেখান থেকে কিন্তু দূষণ বেশি হচ্ছে। ইটভাটা মারাত্মক দূষণ করছে, অধিকাংশ ভাটার প্রযুক্তিগত বিষয়গুলো উন্নয়ন করা হয়নি। অনেক ধরনের ইলেকট্রনিক বর্জ্য সম্পদে রূপান্তরের প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হচ্ছে। এগুলো খুব দূষণ করছে। উৎস বন্ধ করতে না পারলে আমরা কিন্তু মারাত্মক পরিণতির দিকে যাচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে। এছাড়া বয়স্ক যারা আছেন, গর্ভবতী মায়েরাও ঝুঁকিতে পড়ছেন। শিশুরা পৃথকভাবে যে ভালো থাকতে পারবে সেটি তো নয়। বায়ুদূষণ হলে সবাই প্রভাবিত হবে। তবে মাস্ক পরলে কিছুটা রক্ষা পেতে পারে, কিন্তু কতক্ষণ তাদের মাস্ক পরিয়ে রাখা সম্ভব। সেই জায়গাগুলো থেকে আমাদের ভাবতে হবে বায়ুদূষণের উৎস যদি বন্ধ করতে না পারি তাহলে কিন্তু আমাদের বাচ্চারাও ভালো থাকবে না আমরাও ভালো থাকব না।
ঢাকায় বায়ু ও শব্দমানের পরিস্থিতি নিয়ে ওয়াটার কিপার্স বাংলাদেশ কনসোর্টিয়াম’র করা এক জরিপে দেখা গেছে, ঢাকার বাতাসে অতি সূক্ষ্ম বস্তুকণা পিএম২.৫ এর উপস্থিতি আদর্শ মানের (১৫ মাইক্রোগ্রাম) চেয়ে প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। পিএম১০ বস্তুকণার উপস্থিতি আদর্শ মানের চেয়ে দুইগুণ বেশি। শাহবাগ এলাকায় বাতাসে পিএম২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ৮৫ মাইক্রোগ্রাম। পিএম২.৫ এর উপস্থিতি সবচেয়ে কম জাতীয় সংসদ এলাকায়, যার পরিমাণ ৭০ মাইক্রোগ্রাম। ঢাকার ১০টি স্থানের মধ্যে গুলশান-২ এলাকায় শব্দের সর্বোচ্চ মান পাওয়া যায়। সেখানে শব্দের মান ছিল ৯৫ দশমিক ৪০ ডেসিবেল, যা আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবেল) থেকে ১ দশমিক ৭ গুণ বেশি। গুলশান-২ এলাকায় ১৩২ ডেসিবেল পর্যন্ত উচ্চশব্দের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এছাড়া তেজগাঁও এলাকায় ৮৯ ডেসিবেল, আবদুল্লাহপুর এলাকায় ৯৫ ডেসিবেল ও জাতীয় সংসদ এলাকায় ৩১ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ পাওয়া গেছে। স্টামফোর্ড বায়ুম-লীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকাসহ অন্যান্য শহরে অন্যতম প্রধান পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বায়ু ও শব্দদূষণ। বায়ুদূষণের জন্য শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ, শিশুদের উচ্চতা মাটির কাছাকাছি। ফলে রাস্তায় চলাচলের সময় গাড়ি থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হয়, সেটি শিশুদের বেশি আক্রান্ত করে। শিশুদের ইমিউনিটি সিস্টেম তুলনামূলকভাবে অন্যদের তুলনায় ব্যতিক্রম থাকায় তারা আক্রান্ত হয় বেশি। তাদের ফুসফুস ছোট এবং দুর্বল থাকার কারণে দূষণটা তাদের ফুসফুসের গ্রোথকেও (বৃদ্ধি) বাধাগ্রস্ত করে। বায়ুদূষণে শিশুদের হাঁপানি, অ্যালার্জি, নাক-চোখ ও কানে ইনফেকশন হতে পারে। তিনি বলেন, এই বায়ুদূষণ দেখে আমাদের সমাজব্যবস্থার প্রতি শিশুদের মনে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তারা আশপাশের পরিবেশকে নোংরা হিসেবে চিহ্নিত করে। তারা ভার্চুয়াল লাইফে টিভি বা ইউটিউবের মাধ্যমে যে সুন্দর পরিবেশটা দেখে আর বাস্তবতায় তারা যখন অন্ধকারাচ্ছন্ন ঢাকার রাস্তা দেখে, তাতে তারা হীনমন্যতায় ভোগে। এতে মানসিকভাবে তাদের যে গ্রোথ সেটি কমে যায়। ক্যাপস পরিচালক আরও বলেন, বায়ুদূষণ শিশুদের শারীরিক এবং মানসিক দুদিকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে। এখনকার শিশুরা আগের তুলনায় অনেক সচেতন। সে কারণে যারা দূষণ করছে তাদের প্রতিও শিশুরা এক ধরনের ঘৃণা নিয়ে বড় হয়। যারা দূষণ করছে তাদের কিন্তু শিশুরা বন্ধু ভাবতে পারছে না। এখন যে শিশুরা বড় হচ্ছে তারা কিন্তু দূষণকারীদের বড় প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে বড় হচ্ছে। এটি কিন্তু আগামী দিনের জন্য আমাদের ভালো মেসেজ (বার্তা) দিচ্ছে না।-জাগোনিউজ২৪.কম