ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো বিকল্প বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা এখন প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছে। এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাদের বক্তব্যে এ বিষয়ে ইঙ্গিত করেছেন। সর্বশেষ সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট ও নিরাপত্তা পরিষদের কো-চেয়ারম্যান মেদভেদেভ রাখঢাক না করেই বলেছেন, ব্রিকস তার নিজস্ব রিজার্ভ মুদ্রা তৈরি করতে পারে। পতনশীল ইউরোর বিরুদ্ধে সর্বোত্তম সুরক্ষা হবে আমাদের নির্ভরযোগ্য অংশীদারদের সাথে বাণিজ্যে নতুন অর্থ দেয়ার পদ্ধতিতে রূপান্তর, যার আওতায় থাকবে রাশিয়ান জাতীয় মুদ্রা রুবল, চীনা ইউয়ান, ভারতীয় রুপি ইত্যাদি ব্যবহার করা। আধুনিক বিশ্বের জন্য ডলার, ইউরো এবং পাউন্ড স্টার্লিং স্পষ্টতই আর যথেষ্ট নয়, ভবিষ্যতে ব্রিকস দেশগুলোর একটি নতুন রিজার্ভ মুদ্রাও তৈরি করতে পারে।
শীর্ষ সম্মেলনের মূল সুর: ব্রিকস দেশগুলো গত ২৩ জুন চীনের বেইজিংয়ে তাদের ১৪তম শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজন করে। সেখানে তারা বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী ও সংস্কার করা এবং আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যৌথ পদক্ষেপ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০-এর দশকের মাঝামাঝি গঠন হওয়ার পর থেকে উদীয়মান অর্থনীতির ব্রিকস গ্রুপ সদস্যদের মধ্যে ব্যাপক সহযোগিতার কথা বলে আসছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রুপটি সদস্যদের অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক ও জনসংখ্যাগত সম্ভাবনাকে তাদের অবস্থানের সাথে আরো ভালোভাবে মেলানোর জন্য ভূ-রাজনৈতিক শক্তির বৈশ্বিক পুনর্বিন্যাসের জন্য চাপ সৃষ্টি করছে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকসের সর্বশেষ শীর্ষ সম্মেলনটি ছিল ব্রিকস সহযোগিতা ইভেন্টের একটি দীর্ঘ সিরিজের অংশ। চীনা নেতা শি জিন পিং এতে সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকটি মূলত ৬ জুন শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় অর্থমন্ত্রী ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরদের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে আর ২৮ জুন ঊর্ধ্বতন জ্বালানি কর্মকর্তাদের কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকের মাধ্যমে শেষ হয়।
সম্মেলনের উদ্বোধনী বক্তব্যে শি বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং অর্থায়নের সুবিধার্থে আন্তঃসীমান্ত অর্থ প্রদান এবং ক্রেডিট রেটিং বিষয়ে ব্রিকস সহযোগিতা প্রসার করার কথা বলেন। তিনি গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই)-এর ব্যাপারে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির (সিসিপি) স্বপ্ন অর্জনের জন্য ব্রিকস দেশগুলোর সাথে একত্রে কাজ করার জন্য প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেন। এর আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ২০২২ সালের এপ্রিলে সিসিপির নেতৃত্বে বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ হিসেবে জাতিসঙ্ঘে জিডিআই উপস্থাপন করেছিলেন। স্পষ্টতই, একটি চীন-নেতৃত্বাধীন, নন-ডলার পেমেন্ট সিস্টেম ব্যবহার করার জন্য সিসিপি যে আহ্বান জানাচ্ছে তা সহজতর করতে এটি সহায়তা করবে বলে বেইজিং আশা করছে।
ব্রিকস সামিটে চীনা নেতা শি ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন উভয়েই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের আধিপত্য কমাতে এবং সুইফট সিস্টেমের মার্কিন নিয়ন্ত্রণ কমাতে অর্থ দেয়ার বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। চীনের রাষ্ট্রীয় মুখপত্র গ্লোবাল টাইমসে বলা হয়, ব্রিকস দেশগুলোর ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদরা মার্কিন ডলারের আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরিতে জাতীয় মুদ্রা এবং ঋণ প্রদানব্যবস্থা প্রসারিত করার সুপারিশ করেছেন। রাশিয়ান ব্যাংক ভেব আরএফ-এর প্রধান ব্যাংকার সের্গেই স্টরচাক গ্লোবাল টাইমসকে বলেছেন, ব্রিকস এবং অন্যান্য আগ্রহী দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব স্বতন্ত্র বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয়ে কথা বলা দরকার। এটি চাইনিজ মুদ্রার ওপর ভিত্তি করে হতে পারে অথবা তারা ভিন্ন কিছুতেও একমত হতে পারেন।
ডলারের প্রতিস্থাপন কি সম্ভব? একটি বিশ্বব্যাপী মুদ্রাব্যবস্থা রিসেট করার কাজ ইতোমধ্যেই যে শুরু হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক কমই রয়েছে। ক্রেডিট সুইসের মতে, এই নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার আওতায় পণ্যভিত্তিক মুদ্রার লেনদেন চার পাশে আবর্তিত হবে। এই পণ্যভিত্তিক মুদ্রাগুলো ইউরো ডলার সিস্টেমকে আরো দুর্বল করবে, যা রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরে অনেক দুর্বল হবে। প্রশ্ন হলো, কিভাবে একটি ‘বিকল্প বাণিজ্য’ মুদ্রার উদ্ভব হবে এবং ডলারের সাথে প্রতিযোগিতা করবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সাধারণত বৈচিত্র্যের জন্য ব্যবহার করে এমন একটি রিজার্ভ মুদ্রার বিপরীতে এই নতুন মুদ্রাটি শুধু দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য নিষ্পত্তির জন্য ব্যবহার করবে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে, ৪০০ বছর ধরে, বৈশ্বিক রিজার্ভ মুদ্রা এসেছে আর চলে গেছে। স্পেন, নেদারল্যান্ডস এবং ব্রিটেনের রিজার্ভ মুদ্রার শতাব্দীকাল জীবন ছিল। অর্থনীতি দুর্বল হওয়ার সাথে সাথে রিজার্ভ মুদ্রার মৃত্যুর কারণগুলোর বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যায়। আর দুঃখজনকভাবে, যখনই বৈশ্বিক শক্তিগুলো তাদের প্রভাবশালী রিজার্ভ স্ট্যাটাস হারায়, তখন সাধারণত রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়। তেমন একটি পরিস্থিতি এখন দেখা দিয়েছে বলে অনেকের ধারণা।
১৯৪৪ সালে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে মার্কিন ডলার তার প্রভাবশালী রিজার্ভ স্ট্যাটাস অর্জন করে। ৪৪টি দেশের মধ্যে চুক্তির মূল বিষয় ছিল যে ডলার সোনার সাথে পেগ করা হবে এবং অন্যান্য সব দেশের মুদ্রা ডলারের সাথে পেগ করা হবে। এটি একটি দুর্দান্ত ধারণা ছিল যত দিন না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সোনা রেখেছিল এবং আর্থিকভাবে দায়ী ছিল। কিন্তু ১৯৭১ সাল নাগাদ, সব আর্থিক শৃঙ্খলা বিদায় নেয় যখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন সোনা থেকে ডলারকে দ্বিগুণ করে ফেলেন। এই পদক্ষেপটি অবিলম্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ধ্বংসাত্মক হয়ে উঠত, যদি ‘পেট্রোডলার’ তৈরি করার দুর্দান্ত পদক্ষেপটি না নেয়া হতো। সৌদি আরব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কটি তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে সৌদি নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতির বিপরীতে মার্কিন ট্রেজারি বাজারে পুনঃবিনিয়োগ করা ডলারের বিনিময়ে রিয়াদ তার তেল বিক্রি করবে মর্মে সমঝোতা হয়। সহজ কথায় বলতে গেলে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় পণ্যে বাণিজ্য করার জন্য ডলারের চাহিদা সব ধরনের আর্থিক অপব্যবহার সত্ত্বেও ডলারের দাম বাড়াতে সাহায্য করেছে।
১৯৭১ সাল থেকে এখন পৃথিবী অনেকটাই বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিশ্ব অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান ঘটেছে আর আর্থিক দায়িত্বহীনতার কারণে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিশ্বাসযোগ্যতা অনেকখানি নষ্ট হয়ে গেছে। বৈশ্বিক বাণিজ্য সম্পর্কও নতুনভাবে বিকশিত হচ্ছে। ২০২২ সালের প্রথম তিন মাসে রাশিয়ান ফেডারেশন এবং ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য ৩৮ শতাংশ বেড়ে ৪৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ৩.২২ বিলিয়ন জনসংখ্যার (বৈশ্বিক জনসংখ্যার ৪০ ভাগ) ব্রিকস দেশগুলোর সম্মিলিত নমিন্যাল জিডিপি সাড়ে ২৬ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থাৎ বৈশ্বিক অর্থনীতির ২৮ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৫.১২ ট্রিলিয়ন ডলারে (বৈশ্বিক রিজার্ভের ৪০ শতাংশ) রফতানি বাণিজ্য ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলার (বৈশ্বিক ২৫ শতাংশ) এবং আমদানি বাণিজ্য দাঁড়িয়েছে ২.৯৭ ট্রিলিয়ন ডলার। নিষেধাজ্ঞা এবং সুইফট সিস্টেমে মার্কিন বিধিনিষেধে কিছু দেশ মরিয়া হয়ে মার্কিন ডলারের বিকল্প খুঁজছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীনের মধ্যে একটি অর্থনৈতিক যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। চীন এর আগে একটি ‘নতুন আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা’র আহ্বান জানায়। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের সাথে, বিষয়গুলো সত্যিই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। চীন যত কিছুই পরিবর্তনের চেষ্টা করুক না কেন চীনা ইউয়ান নিজে থেকে ডলারের প্রতিস্থাপন করতে সক্ষম নয়। কারণ এটি এখনো বৈশ্বিক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের মাত্র দুই শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করে। তবে এর বিকল্প রুট হতে পারে আংশিকভাবে সোনা-সমর্থিত ‘বন্দোবস্ত’ মুদ্রা। এই পথেই ব্রিকস দেশগুলো অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে হয়।
চীন নীরবে তার সোনার মজুদ তৈরি করে চলেছে। দেশটি বিশ্বের বৃহত্তম সোনা উৎপাদক (বৈশ্বিক উৎপাদনের ১২ শতাংশ), আবার বিশ্বের বৃহত্তম সোনা আমদানিকারকও। কোনো চীনা-খনির সোনা রফতানির অনুমতি নেই। সরকারও তার নাগরিকদের সোনা কিনতে উৎসাহিত করে। দেশীয় ও আমদানি করা সোনা কেবল যেন একটি বড় ব্লাকহোলে অদৃশ্য হয়ে যায়। চীনের সোনা সংগ্রহে সতর্কতায় মনে হয়, সম্ভবত তারা চায় না সোনার দাম বাড়ুক। গত ২০ বছরে এর অভ্যন্তরীণ উৎপাদন একাই সাত হাজার টন। অন্য দিকে, আমেরিকার সরকারি সোনার মজুদ দাঁড়িয়েছে আট হাজার ২০০ টন।
কিভাবে একটি সোনা-সমর্থিত সেটেলমেন্ট মুদ্রা কাজ করবে এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ জিম রিকার্ডস সম্প্রতি ব্যাখ্যা করেছেন যে, একটি মুদ্রাকে সম্পূর্ণরূপে সোনা দ্বারা সমর্থিত হতে হবে না। এক শতাব্দী আগে যখন ব্রিটিশ পাউন্ড সোনা দ্বারা সমর্থিত ছিল, তখন এর শুধু ২০ শতাংশ সোনার মাধ্যমে সমর্থিত ছিল।
গোল্ড-ব্যাকড কারেন্সি ট্রেডিং সিস্টেমের জন্য, প্রাথমিকভাবে সিস্টেমটি ব্যবহার করে এমন শুধুমাত্র দু’টি দেশের প্রয়োজন। ইউক্রেনের বিষয়ে রাশিয়ার প্রতি চীনের নিরঙ্কুশ সমর্থন, রাশিয়ার তেল এবং অন্যান্য পণ্যের প্রয়োজনীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে, এটি অকল্পনীয় নয় যে, দেশটি তার নৃত্যের সঙ্গী খুঁজে পেয়েছে।
দুই দেশ মার্কিন ডলার সিস্টেমের বাইরে একটি সেটেলমেন্ট ট্রেডিং কারেন্সি (এটি রিজার্ভ কারেন্সি থেকে আলাদা) তৈরি করতে পারে। তারা একটি ‘নেট সেটেলমেন্ট’ ভিত্তিতে বাণিজ্য করতে সম্মত হতে পারে, যার অর্থ তারা প্রতি ত্রৈমাসিকে পর্যায়ক্রমিক ভিত্তিতে তাদের বাণিজ্য নিষ্পত্তি করবে। সম্প্রতি, রাশিয়ান ব্যাংক ভেব আরএফ-এর একজন বিশ্লেষক পরামর্শ দিয়েছেন যে, রাশিয়ার উচিত ‘গোল্ডেন রুবল’ শিরোনামে একটি সোনা-সমর্থিত স্টেবল কয়েন তৈরি করা। তাদের গবেষণা অনুসারে, পশ্চিমা দেশগুলো এ ধরনের মুদ্রায় পরিচালিত নিষ্পত্তির কার্যক্রমকে বাধা দেওয়ার কোনো সুযোগ পাবে না। কারণ এর বিনিময় হার বিশ্ববাজারে সোনার হারের সাথে নির্ধারণ করা হবে, ডলার বা ইউরো দিয়ে নয়।
যদিও এটি ঠিক যে, সোনা হলো একমাত্র ধাতু যা প্রায় সর্বজনীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো ধারণ করে। প্রশ্ন হলো, যদি এ ঘটনা ঘটে তাহলে বাকি বিশ্ব কী করবে? একটি বিষয় লক্ষ করার মতো, বিশ্বের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশেরও বেশি প্রতিনিধিত্বকারী সরকারগুলো রাশিয়ার অপ্রীতিকর যুদ্ধের নিন্দা করেনি। ভারত ও ব্রাজিলের মতো অর্থনৈতিক শক্তি এবং গ্লোবাল সাউথের বেশির ভাগ নিন্দার দিকে যায়নি। অনেকে রাশিয়ার সাথে ভালো বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে চায়। এ ধরনের পরিবেশে কেউ সহজেই একটি দ্বিখ-িত বৈশ্বিক মুদ্রাব্যবস্থা কল্পনা করতে পারে যেখানে অ-সংযুক্ত দেশগুলো মার্কিন ডলার ব্যবস্থা এবং চীন-রাশিয়া সোনা-সমর্থিত ব্যবস্থা উভয়ের মধ্যেই বাণিজ্য করতে পারে।
লক্ষণীয় হলো, আমেরিকানরা যখন ডিজিটাল কারেন্সির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সোনা কেনার ছন্দে রয়েছে। তারা ২০১০ সালে এটি শুরু করেছিল এবং এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। একই সময়ে তারা তাদের ইউএস ডলারের রিজার্ভ কমিয়েছে, যা এখন ২০০০ সালের ৭১ শতাংশ থেকে মোট রিজার্ভের ৫৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ভৌত সোনা পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে যাচ্ছে।
একই সময়ে, পেট্রোডলার সিস্টেম ক্র্যাক হওয়ার লক্ষণ রয়েছে। সৌদি আরব চীনের কাছে ইউয়ানে তেল বিক্রির বিষয়ে শোরগোল ফেলেছে এবং বাইডেন প্রশাসনের কাছ থেকে উৎপাদন বাড়াতে অনুরোধ করা সত্ত্বেও ওপেক তেল সরবরাহের বিষয়ে রাশিয়ার পাশে রয়েছে। বাইডেন সাম্প্রতিক সৌদি সফরের মাধ্যমে এটি ঠিক করার চেষ্টা করেছেন।
বিকল্প কী সহজ হবে? দেশগুলো কেন আন্তর্জাতিক নিষ্পত্তিতে মার্কিন ডলার ব্যবহার করে? কারণ, তেলের মতো পণ্যের দাম ডলারে হয় এবং ডলার একটি স্থিতিশীল মুদ্রা যা বিশ্বের সর্বত্র সহজেই পরিবর্তনযোগ্য। ব্রিকস মুদ্রার কোনোটিই সম্পূর্ণ রূপান্তরযোগ্য বলে বিবেচিত হয় না। যদি ব্রিকস দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক মীমাংসা চুক্তিতে পৌঁছানো যায়, তবে ব্রিকস মুদ্রাগুলো শুধুমাত্র উদ্ভূত দেশের সাথে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কার্যকর হবে। অন্য কথায়, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ভারত রুপিতে বাণিজ্য নিষ্পত্তি করতে সম্মত হতে পারে। তবে অন্য দেশগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যে রুপি গ্রহণ করবে এমন সম্ভাবনা কম।
আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ীরা আন্তঃসীমান্ত অর্থপ্রদান প্রক্রিয়া করতে ইউএস সুইফট সিস্টেম ব্যবহার করে। কারণ এটি নিরাপদ, দ্রুত ও নির্ভুল। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এটি সুবিধাজনক কারণ ১০০টিরও বেশি দেশের প্রধান ব্যাংকগুলোর সাথে এর সংযোগ রয়েছে। চীন এবং রাশিয়া সুইফটের বিকল্প তৈরি করার চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো সিস্টেমই পশ্চিমা দেশগুলোর ব্যাংকগুলোর সাথে সংযোগ করে না। ফলস্বরূপ, যতক্ষণ বিশ্ব চীনা বা রাশিয়ান সিস্টেম ব্যবহার করতে সম্মত না হয়, ব্রিকস দেশগুলো সুইফটের ওপর নির্ভর করবে। এমনকি যদি একটি চীনা বা রাশিয়ান পেমেন্ট সিস্টেমে সম্মত হয়, তবুও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য কোন মুদ্রা ব্যবহার করতে হবে তা নিয়ে সমস্যা থাকবে। তর্কাতীতভাবে, চীনা ইউয়ান হবে ব্রিকস দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যের জন্য ব্যবহারের সবচেয়ে যৌক্তিক মুদ্রা। বর্তমানে, চীনা ক্রস-বর্ডার ইন্টারব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেম-চিপস ইউয়ানে বাণিজ্য পরিচালনার জন্য সেটআপ করা হয়েছে। কিন্তু ইউয়ানে এবং চিপস-এর মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করতে সম্মত হওয়ার মাধ্যমে, অন্যান্য ব্রিকস দেশ সিসিপি নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্যের মার্কিন নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করতে তারা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবে না। রাশিয়ার পুতিন এবং ব্যাংকারদের একটি বিকল্প সুপারিশ হবে মুদ্রার একটি ঝুড়ি ব্যবহার করা। এই ধারণাটি আইএমএফ-এর এসডিআর-এর আদলে তৈরি করা হয়েছে, যা মার্কিন ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানি ইয়েন এবং ব্রিটিশ পাউন্ডসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রার একটি ঝুড়ির সমন্বয়ে গঠিত। এসডিআর স্থানান্তর বা রিজার্ভ রাখা যেতে পারে। সম্ভবত, ব্রিকস তার পাঁচটি মুদ্রার একটি ঝুড়ি তৈরি করবে, কিন্তু এটি একে অপরের সাথে বাণিজ্য করার জন্য দেশীয় মুদ্রা ব্যবহার করে ব্রিকস দেশগুলোর সমস্যা প্রশমিত করতে খুব কমই কিছু করবে। অন্যান্য দেশ ব্রিকস মুদ্রার একটি ঝুড়ি রিজার্ভ রাখতে চাইবে না। আর ইউএস সুইফট সিস্টেম ব্রিকস মুদ্রার ঝুড়িতে করা লেনদেনের ব্যবস্থা করবে না।
রাশিয়ার কারেন্সি সোয়াপের প্রস্তাব: রাশিয়া ভারতের সাথে ডলারবিহীন বাণিজ্যের জন্য সুইফটের বিকল্প প্রস্তাব করেছে। ভারত সরকার রাশিয়ান পেমেন্ট সিস্টেমে যাওয়ার জন্য মস্কোর প্রস্তাব বিবেচনা করছে, যা দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে সরাসরি রুপি-রুবল স্থানান্তরের অনুমতি দেয়। রাশিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা প্রক্রিয়াটি ডলার-নির্ধারিত বাণিজ্য এড়িয়ে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি করবে এবং বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল গ্রাহককে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে রাশিয়া থেকে ক্রয় চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেবে। এই স্কিমে রাশিয়ার মেসেজিং সিস্টেম, এসপিএফএস-এর মাধ্যমে রুপি-রুবল-নির্দেশিত অর্থপ্রদান জড়িত। ব্লুমবার্গের সূত্র অনুসারে, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া নিয়মিতভাবে দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থার কর্মকর্তাদের সাথে রাশিয়ার এক্সপোজার এবং সর্বশেষ নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকির মতো বিষয় নিয়ে আলোচনা করে। এই ব্যবস্থাটি সুইফট আন্তঃব্যাংক মেসেজিং সিস্টেমের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে এমনকি সর্বশেষ জরিমানা সত্ত্বেও ভারতীয় রফতানিকারকদের রাশিয়ার সাথে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রস্তাবের অধীনে, রুবল ভারতীয় ব্যাংকে জমা করা হবে ও রুপিতে রূপান্তরিত হবে এবং একই সিস্টেম বিপরীতে কাজ করবে। রাশিয়াও চায় ভারত তার ইউনিফাইড পেমেন্টস ইন্টারফেসকে তাদের এমআইআর পেমেন্ট সিস্টেমের সাথে সংযুক্ত করুক যাতে রাশিয়ায় ভিসা এবং মাস্টার কার্ডের কার্যক্রম স্থগিত করার পরে উভয় দেশের ব্যাংকের জারি করা কার্ডের নির্বিঘœ ব্যবহার করা যায়।
বাংলাদেশ কি ব্রিকস বলয়ে যাচ্ছে? ব্রিকস ২০০১ সালে ব্রিক নামে শুরু হয়েছিল। এরই মধ্যে আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো ও তুরস্ক ব্রিকসের পূর্ণ সদস্য হতে দৃঢ় আগ্রহ প্রকাশ করেছে। মিসর, ইরান, নাইজেরিয়া, সুদান, সিরিয়া এবং অতি সম্প্রতি পাকিস্তানও ব্রিকসে যোগদানে আগ্রহী। আর্জেন্টিনা ও ইরান উভয়ই চীনের আমন্ত্রণে এবারের ব্রিকস সম্মেলনে উপস্থিত ছিল। ব্রিকস সম্প্রসারণের ব্যাপারে চীন বিশেষভাবে আগ্রহী। ভারত এই মুহূর্তে সম্প্রসারণ চায় না। রাশিয়া মধ্যবর্তী অবস্থানে। ইরান ও আর্জেন্টিনাকে সদস্য করা হতে পারে আগে। ব্রিকস ফোরামের সভাপতি এক রুশ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, মিসর তুরস্ক সৌদি আরব শিগগিরই ফোরামের সদস্য হতে পারে। বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনো সদস্য দেশের আপত্তি নেই বলে জানা যাচ্ছে। যতদূর জানা যায়, রাশিয়া এবং ভারত দু’টি দেশই বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় বাণিজ্য ও কারেন্সি সোয়াপের প্রস্তাব দিয়েছে। চীনও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়ে থাকতে পারে। তিনটি দেশের সাথেই বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্পর্ক রয়েছে জোরালো। তবে এই বাণিজ্য সম্পর্ক একতরফা আমদানিনির্ভর। বাংলাদেশের পণ্য রফতানির প্রায় ৮০ শতাংশ ইউরোপ আমেরিকানির্ভর। প্রশ্ন হলো, ডলার ইউরো এড়িয়ে রুপি ইউয়ান রুবলে বাণিজ্য করার জন্য পশ্চিমা দেশগুলো কি তাদের বাজার উন্মুক্ত করে রাখবে ঢাকার জন্য? অন্য দিকে, যুক্তরাষ্ট্র একদফা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। যেকোনো দিন তাদের মানবপাচার রিপোর্ট প্রকাশ করবে, যেখানে বাংলাদেশ একধাপ নিচে নামলে বৈদেশিক সহায়তা প্রাপ্তিতে নিষেধাজ্ঞার মধ্যে পড়বে। এসব ঝুঁকির পরও পশ্চিমাদের মুক্ত অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের শর্তের মধ্যে ক্ষমতাসীনরা ক্ষমতা হারানোর শঙ্কা দেখতে পাচ্ছে বলে মনে হয়। এ অবস্থায় ব্রিকসের বন্ধনে বাংলাদেশ একেবারে একাত্ম হয়ে যায় কিনা সেটি দেখার ব্যাপার। মুক্তবাজার ও পাশ্চাত্যে রফতানিনির্ভর দেশ হিসেবে এটি অনেক বড় একটি ঝুঁকির বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। যাদের সাথে বাংলাদেশ যাচ্ছে তাদের সবাই রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের পাশে দাঁড়িয়েছে। মিয়ানমারকে কিলোক্লাস সাবমেরিন দিয়েছে ভারত, এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা আর সু-৩৫ অত্যাধুনিক জঙ্গিবিমান দিচ্ছে রাশিয়া আর চীনের রয়েছে সর্বাত্মক সামরিক সহায়তা। এ ধরনের বলয়ে পূর্ণ আশ্রয় এবং বিপরীত পক্ষের সাথে বৈরিতা বাংলাদেশের সামরিক ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা কতটা নিশ্চিত করবে? mrkmmb@gmail.com