শক্তির প্রধান উৎস হলো সূর্য। সূর্যের আলো না পেলে গোটা পৃথিবী অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে পড়বে। জীবকুল সরাসরি সূর্যের ওপর নির্ভরশীল। যুগের পরিবর্তনে, প্রযুক্তির কল্যাণে মানুষ সূর্যের আলো প্রয়োজনানুসারে বিভিন্নভাবে ব্যবহার করছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো সোলার প্যানেল বা সৌরবিদ্যুৎ। বেললাব কর্তৃক মহাকাশ কার্যক্রমে সৌরবিদ্যুতের প্রায়োগিক ব্যবহার শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এর উদ্দেশ্য ছিল রকেটের জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে এর ওজন হ্রাস করা। আসমান থেকে জমিনে এর ব্যবহার শুরু হয় সত্তরের দশকে। আর বাংলাদেশে এর যাত্রা শুরু হয় ২০০২ সালের দিকে।
বাংলাদেশের মতো ছোট আয়তনের ঘনবসতিপূর্ণ দেশের উন্নয়নের অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জ্বালানির অভাব। দেশে উত্তোলিত কয়লার প্রায় পুরোটাই নি¤œমানের। কারণ এতে কার্বনের পরিমাণ খুবই কম। গন্ধক ও ছাইয়ের পরিমাণ বেশি। দেশে খনিজসম্পদ থাকার মধ্যে আছে শুধু প্রাকৃতিক গ্যাস। তাও দেশের বিভিন্ন উৎপাদন কাজে কিংবা জনগণের চাহিদার তুলনায় কম। তাছাড়া এই গ্যাস যানবাহনের জ্বালানি, শিল্পকারখানায় ইঞ্জিন চালনা, সার উৎপাদন ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে দেশে বিদ্যমান গ্যাসের মজুত ক্রমশ শেষ হয়ে আসছে। এসবের মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশেও এর প্রভাব নেহাত কম নয়। বিশ্ববাজারে তেলের দাম মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় বেশি দামে কিনে দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর চাহিদা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে সরকার তেলের মাধ্যমে চলা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রেখেছে। এতে করে দেশে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন অনেকাংশে কমে গেছে। এই পরিস্থিতি সামলাতে সারা দেশে রুটিন করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং করে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এমতাবস্থায়, আশার আলো দেখাতে পারে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ‘সৌরশক্তি’। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে, প্রতি বর্গমিটারে সূর্য প্রায় ১ হাজার ওয়াট শক্তি বর্ষণ করে। সূর্যের এই শক্তিকে কাজে লাগাতে মানুষ বহুকাল ধরেই চেষ্টা করে চালাচ্ছে বৈকি। বর্তমানে সূর্যের আলোক শক্তিকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে ক্যালকুলেটর, বৈদ্যুতিক বাতি, পাখা ঘোরানো, সেচ পদ্ধতি এবং কৃত্রিম উপগ্রহের গায়ে সোলার সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর গুরুত্ব অপরিসীম। সৌরদ্যুৎকে সর্বাধিক প্রাধান্য দিয়ে আমরা জ্বালানি সমস্যা কাটিয়ে উঠতে পারি। তাছাড়া এর সবচেয়ে ভালো দিক হলো এটি সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব।
বাংলাদেশে বিগত দুই দশক ধরে সোলার প্যানেলের ব্যাপক বিস্তার শুরু হয়েছে। দেশে ইতিমধ্যে প্রায় ৪৫ লক্ষাধিক বাড়ি, দোকানপাটে সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। যার ফলে ২ কোটিরও বেশি মানুষ উপকৃত হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে সড়ক-মহাসড়কে রোড লাইটের খুঁটির মাথায় সোলার প্যানেল লাগানো হচ্ছে। যা সারাদিন চার্জ হয় এবং সূর্য ডুবলেই প্যানেলে থাকা সেন্সরের মাধ্যমে লাইট নিজে থেকে জ্বলে ওঠে। এভাবে সারারাত নিরবচ্ছিন্নভাবে আলো দেয়। এর ফলে একদিকে ঘাটতি পূরণ হয়, অন্যদিকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর চাপ কম হয়। এই দৃষ্টান্তকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন কলকারখানা ও যানবাহনে গ্যাসের সরাসরি ব্যবহার কমিয়ে এক্ষেত্রে সোলার প্যানেল ব্যবহৃত হলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যাবে। আমাদের দেশে শহরের তুলনায় গ্রামে বিদ্যুতের ভোগান্তি বেশি। এক্ষেত্রে গ্রামে সৌরবিদ্যুতের ব্যাপক প্রসারের বিকল্প নেই।
বিশেষ করে গ্রামের রাস্তাঘাট-বাজারে। এতে করে গ্রামে চুরিডাকাতি, ছিনতাই ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি গ্রামীণ উন্নয়নের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ফল পাওয়া যাবে। ইতিমধ্যে সরকারিভাবে ইউনিয়ন পরিষদের তত্ত্বাবধানে গ্রামের রাস্তায় সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করেছে সরকার। আমাদের দেশে সৌরবিদ্যুৎ ব্যবস্থায় প্রচুর দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে। সাম্প্রতিক এক তথ্যে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক যে সৌরবিদ্যুৎ কার্যক্রম চলছে তাতে বছরে বিনিয়োগ হচ্ছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। সমগ্র দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসার ঘটাতে পারলে বিদ্যুৎ ঘাটতি চিরতরে দূর করা সম্ভব হবে। আমাদের এখন সম্মিলিতভাবে সে লক্ষ্য পূরণেই কাজ করতে হবে।লেখক : শিক্ষার্থী, বরেন্দ্র কলেজ, রাজশাহী