মসজিদের শহর থেকে মোটরবাইকের শহরে পরিণত হয়েছে ঢাকা। শহরের রাস্তায় এখন বেরোনো দায়। মূল রাস্তা থেকে শুরু করে অলিগলি কিংবা ফুটপাথ- কোথাও স্বস্তি নেই। সবসময় একটি ভয় তাড়িয়ে বেড়ায়। এই বুঝি মোটরবাইক নামের দানবটি গায়ে উঠে পড়ল। রাস্তায় জ্যাম কিংবা সিগন্যাল চলাকালেও তারা থামছে না। কোনোরকমে একটু ফাঁক পেলেই চালানো শুরু করে। অনেকে মনের সুখে কানে হেডফোন লাগিয়ে বাইক চালাতে দ্বিধাবোধ করে না। নিজেদের বাহাদুরি জাহির করতে গিয়ে বহু সম্ভাবনাময় ফুটফুটে তাজা প্রাণ বাইক দুর্ঘটনায় অকালেই ঝরে যাচ্ছে। প্রতিনিয়ত দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাইক দুর্ঘটনার খবর আমরা শুনতে পাই।
বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেরা বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর ফলে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে মৃত্যুর মিছিল। আমেরিকায় নিবন্ধিত মোটরবাইকের সংখ্যা প্রায় আট লাখ। সেখানে ৩০৬ বর্গকিলোমিটারের রাজধানী ঢাকায় নিবন্ধিত মোটরবাইকের সংখ্যা সাড়ে ৯ লাখ। সারা দেশে মোটরবাইকের সংখ্যা ৩৭ লাখ এক হাজার ৭৮৬। প্রতিদিন সড়কে ৩৭০টি নতুন মোটরবাইক নামছে ।
দেশে উদ্বেগজনক হারে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তরুণরা দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। এর কারণগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সড়কের ধারণক্ষমতার চেয়ে প্রায় পাঁচগুণ বেশি মোটরবাইক রাস্তায় চলাচল করে। তারা পরিবহন ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এদের আধিপত্যে অন্যান্য যানবাহন ও পথচারীরা কোণঠাসা। ফুটপাথ তাদের যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। একটু অসতর্ক হলেই গায়ের উপরে উঠার ওপক্রম। এই যন্ত্রদানবের বিচিত্র ধরনের কান ফাটানো আওয়াজ আমাদের জীবনকে বিষিয়ে তুলেছে। বিচিত্র ধরনের বিভিন্ন রকমের হর্নের শব্দ- পরিবেশদূষণ ও শব্দদূষণের মাত্রাকে বাড়িয়ে তুলেছে। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির ভাষ্য অনুযায়ী, গত বছরের ঈদুল ফিতরের ছুটির আগে-পরে দুই সপ্তাহে দেশের সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনায় ৩২৩ জন নিহত হন। নিহতের ৪৩ শতাংশই ছিল মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী। নিহতদের বড় অংশই ছিল কিশোর-তরুণ। গত ২৯ এপ্রিল থেকে ৫ মে পর্যন্ত সাত দিনে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। এর মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশই (৩১ জন) মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহী।
গত বছর ৩৭৬ জন ব্যক্তি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং এক হাজার ৫০০ জন আহত হয়েছেন। এর ভেতরে ১৫৬ জন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছেন, যা পুরো দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ। নিরীক্ষায় এটিও দেখা গেছে- ১০ হাজার মোটরসাইকেলের ভেতরে গড়ে ২৮ জন প্রাণ হারাচ্ছেন, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২০২১ সালে দুই হাজার ৭৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে। এতে মারা যান দুই হাজার ২১৪ জন, যা সড়ক দুর্ঘটনায় মোট মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ। ২০২০ সালের তুলনায় ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ৫০ শতাংশ এবং মৃত্যুর সংখ্যা ৫১ শতাংশ বেড়েছে। বুয়েটের গবেষণা তথ্য জানাছে, দুর্ঘটনায় সময় ৮৮ শতাংশ মোটরসাইকেল আরোহী ও চালক হেলমেট ব্যবহার করেনি। এ ছাড়া অর্ধেকের বেশি দুর্ঘটনা বেশি গতির কারণে এবং ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা অসতর্কতাজনিত কারণে ঘটছে। নিহতদের মধ্যে ৪০ শতাংশ বয়সে তরুণ। এদের রয়েছে ভবিষ্যৎ জীবন ও সম্ভাবনা। মহাসড়কে মোটরসাইকেল চালানো নিষিদ্ধ হলেও অবাধে চলছে, তা দেখার যেন কেউ নেই।
অপর দিকে, নির্দিষ্ট সিসির বাইরে অতিরিক্তি সিসির ক্ষমতাসম্পন্ন মোটরসাইকেলের অনুমোদন ও আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন। মোটরসাইকেল যন্ত্রণার ব্যাপারে যদি লাগাম টেনে ধরা না হয় তাহলে এ ধরনের দুর্ঘটনা বাড়তেই থাকবে। বাড়তে থাকবে নিহত ও আহত মানুষের সংখ্যা। বাড়তে থাকবে বাড়িতে বাড়িতে বুকফাটা আর্তনাদের আহাজারি। অসহায় হয়ে পড়বে অসংখ্য পরিবার। এ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে ট্রাফিক বিভাগের আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। ট্রাফিকের দায়িত্ব যারা পালন করবেন তাদের সুষ্ঠু ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা দরকার। পাশাপাশি উপযুক্তসংখ্যক জনবল বাড়ানো দরকার। আমাদের এ কথা ভুলে গেলে চলবে না- একটি পরিবারে যখন এক ব্যক্তি দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় তখন শুধু ব্যক্তিটি হারায় না, হারিয়ে যায় একটি পরিবার। হারিয়ে যায় পরিবারের স্বপ্নগুলো। সারা জীবনের জন্য এই পরিবারটি অথনৈতিকভাবে পঙ্গু ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এটি একটি সামাজিক দায়। এ দায় থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে হলে অনতিবিলম্বে কার্যকর ও কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ ঊসধরষ-shah.b.islam@gmail.com