তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগেই যাচ্ছে নাকি! গত সপ্তাহজুড়ে দুনিয়ার কোনায় কোনায় এই আশঙ্কা-আলোচনা শুরু হয়েছে। ‘পাগলা বাইডেন’ কি ক্রমান্বয়ে সব খুইয়ে এখন চীনের সাথে যুদ্ধ লাগিয়ে দেবেন? আর তা থেকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের জল্পনা এজন্য; কারণ, এমন যুদ্ধ একবার লেগে গেলে তা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়ানোর সম্ভাবনায় পরিপূর্ণ! মানে বাইডেনের এই পাগলামি হলো, শিশু বয়সে খেলাপাতি খেলার বয়সকালে শিশুরা সময়ে যেমন ‘হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে’ আচরণ করে বসে, সেটাই। কিন্তু বাস্তবেই বাইডেন শিশু নন, খেলাপাতি খেলার বয়েসেরও না। বরং তিনি এতই বয়স্ক যে কারণে তার দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই বলে নিজের দলেই আলোচনা আছে। তাহলে শিশু বয়সের হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বেমানান আচরণ তিনি কেন করছেন? সে এক বিরাট বিস্ময় বটে!
গত ২ আগস্ট মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি, তার এশিয়া সফরের মধ্যে তাইওয়ান সফর অন্তর্ভুক্ত ছিল না। অথচ কোনো আগাম ঘোষণা ছাড়াই তাইওয়ানের ভূমিতে তিনি নেমে পড়েছিলেন। রয়টার্স লিখেছে, তাও সেটা আবার এক আমেরিকার এক সামরিক কার্গো বিমান যাতে তিনি ভ্রমণ করছিলেন। আর যে বিমানকে আবার আমেরিকার আরো আটটা সামরিক বোমারু বিমান দুই পাশে পাহারা দিয়ে নিয়ে গেছে। কিন্তু কেন এমন যুদ্ধ সাজের রব? বিবিসি লিখেছে, মার্কিন ‘যুক্তরাষ্ট্র বলে, তাইওয়ান কোনো স্বাধীন দেশ নয়, কিন্তু একই সাথে তারা তাইওয়ানকে মিত্র বলে গণ্য করে।’ অর্থাৎ বিবিসিও বাইডেনের স্ববিরোধিতার পক্ষে দাঁড়াতে অস্বীকৃতির অবস্থানে। মানে হলো, কোনো বিদেশী রাষ্ট্র মোদিকে পাশ কাটিয়ে, না জানিয়ে যেমন মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে স্বীকৃতি বা সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে না; করার মানে হয় না; সেরকম। কারণ, পশ্চিমবঙ্গ ভারত থেকে কোনো স্বাধীন ভূখ- নয়। তাহলে তাইওয়ান কোনো স্বাধীন দেশ-ভূখ- নয় স্বীকার করেও আমেরিকা কেন তার সাথে মিত্রদের মতো আচরণ বা তাকে সামরিকভাবে রক্ষার প্রতিশ্রুতি দিতে চায়?
আবার জাতিসঙ্ঘের ১৯৭১ সালের ২৫ অক্টোবরের সিদ্ধান্ত-প্রস্তাব হলো, চীন বলতে ‘পিপলস রিপাবলিক অব চায়না’ (পিআরসি) বা মাওয়ের চীনই, এটাই একমাত্র চীন। ফলে তাইওয়ান এই একক চীনেরই ভূখ- অংশ মাত্র। জাতিসঙ্ঘ তাই এর বাইরে গিয়ে, তার চোখেও তাইওয়ান কোনো স্বাধীন দেশ-ভূখ- নয় মনে করে।
এ ছাড়াও, চীন কোনো দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক বিনিময় বা ওই দেশকে স্বীকার করে তখনই যখন ‘চীন বলত’ ওই দেশ একটাই, চীন আর সেটা পিআরসি- এটা স্বীকার করে নেয় (এটাই চীনের ‘একচীন নীতি’)। আমেরিকাও এটা স্বীকার করে নিয়েছিল বলেই ১৯৭৮ সালের পয়লা জানুয়ারি থেকে চীন-আমেরিকার প্রথম কূটনৈতিক সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিল। তবে অনানুষ্ঠানিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক হতে পারে। যেমন, এখনো তাইওয়ানের সাথে চীনেরও এমন সম্পর্ক আছে। কাজেই ন্যান্সির এই সফর পরিপূর্ণ দায়িত্বজ্ঞানহীন উসকানিমূলক। আর ঠিক এ কথাটাই সাহসের সাথে কলাম লিখে বলেছেন নিউইয়র্ক টাইমসের নামকরা সাংবাদিক থমাস ফ্রিডম্যান।
আমেরিকান বকোয়াজি ‘সংসদের স্বাধীনতা’: কথা উঠেছে বাইডেন নাকি স্পিকার ন্যান্সিকে তাইওয়ান সফরে না যাওয়া নিয়ে কিছুই বলেননি; এমনকি না যেতে পরামর্শও রাখেননি। এদিকে যদিও কিছু মিডিয়ার দাবি আমেরিকার আভ্যন্তরীণ ক্ষমতা কাঠামোতে তাদের কংগ্রেসের (সংসদের) স্পিকার হলেন তিন নম্বর ব্যক্তি; মানে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্টের পরেই, তাই। কিন্তু বিবিসি বাংলা এক সাফাই দিয়ে লিখেছে যে, ‘প্রেসিডেন্ট বাইডেন অবশ্য ন্যান্সি পেলোসিকে থামানোর চেষ্টা করেননি, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে কংগ্রেস হচ্ছে নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন।’ আবার এই বক্তব্যের বিরোধী বক্তব্য দিয়েছেন সাংবাদিক থমাস ফ্রিডম্যান। তিনি নিউইয়র্ক টাইমসে লিখেছেন, ‘প্রেসিডেন্টের উচিত ছিল ন্যান্সিকে তাইওয়ান না যেতে পরামর্শ দেয়া।’ অর্থাৎ এর মানে হলো, প্রেসিডেন্ট না যেতে নির্দেশ দিতেই যদি পারেন, অন্তত পরামর্শ দেওয়ার ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের আছে ও ছিল যা প্রেসিডেন্ট ব্যবহার করেননি।
তার চেয়ে বড় কথা, এ কেমন ‘সংসদীয় স্বাধীনতা’ যে, তিনি নির্বাহী প্রেসিডেন্টের পররাষ্ট্র নীতি উল্টে দিতে বা হাত ঢুকিয়ে দিতে পারেন? এটা অ্যাবসার্ড। এক খামোখা বকোয়াজের নীতি অবশ্যই। পেলোসির এই সফর, এই আচরণে চীনের প্রতিক্রিয়ার মধ্যে তো কোনো ভিন্নতা নেই, থাকার কথাও না। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আর স্পিকারের আচরণ- আমেরিকা এ দুই আচরণকে চীন ভিন্নভাবে দেখেনি, দেখবে না। চীনের কাছে দুটোই আমেরিকান সরকারের উসকানি এবং চীনবিরোধী হস্তক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ।
আসলে সব ক্ষেত্রেই ‘স্বাধীনতা’ এই শব্দের সাথে সাথে স্বাধীনতার ‘দায়দায়িত্ব’ এই কথাটাও চলে আসে যার সারার্থ হলো, স্বাধীনতা ভোগ করতে চাইলে দায়িত্ববান হতে হবে, দায় নিতে জানতে হবে। তাহলে কথিত স্বাধীন পেলোসির সফরের কারণে যদি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যায় তবে এর দায় কার হবে- স্পিকারের নাকি প্রেসিডেন্টের? আবার স্পিকার কি যুদ্ধ পরিচালনার নির্দেশ দিতে ক্ষমতা রাখেন না? সেটা এককভাবে নির্বাহী প্রেসিডেন্টের একক এখতিয়ার? কাজেই ‘স্পিকারের স্বাধীনতা’ নামক হাস্যকর কথা বলা- এটা আসলে মাথা খারাপ লোকেদের তত্ত্ব!
স্পিকার ন্যান্সি এখন সফর গুটিয়েছেন, তিনি তাইওয়ান ছেড়ে পরে জাপান সফরও শেষ করে এখন দেশের পথে; ৪ আগস্ট সকালে তিনি তাইওয়ান ছেড়েছিলেন। আর এরপর থেকেই লাইভ অ্যামুনেশনে তাইওয়ানকে ঘিরে ধরে চীনের সামরিক মহড়া শুরু হয়েছে যদিও এটা ঠিক যুদ্ধ শুরু না। তবে তাইওয়ান তাতে আত্মরক্ষামূলক প্যাসিভ মুডে চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। আর গেলে চীনের এই আগ্রাসী অবস্থানের কারণে গোলা খেতে হতো, না হলে যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে হতো। আর সেই সাথে এ নিয়ে ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়ার সুরও বদলাতে থাকে। যেমন ইকোনমিস্টের শিরোনাম হয়ে যায়, ‘পেলোসি তাইওয়ান ছেড়েছেন, আসল সঙ্কট শুরু হবে এখন।’ আর বিবিসির শিরোনাম, “তাইওয়ান : ন্যান্সি পেলোসির সফর যুক্তরাষ্ট্রের ‘এক চীন’ নীতিকে সঙ্কটে ফেলে দিয়েছে।”
আর বিবিসি ভেতরে লিখছে, ‘গত ২৫ বছরের মধ্যে ন্যান্সি পেলোসি হচ্ছেন তাইওয়ান সফরে যাওয়া সবচেয়ে উচ্চপদস্থ মার্কিন রাজনীতিক। চীন-মার্কিন সম্পর্ক এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। কিন্তু প্রেসিডেন্ট বাইডেন যখন সেটিকে ঠিক করার চেষ্টা চালাচ্ছেন, তখন ন্যান্সি পেলোসির এই সফর যেন তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক টেনে আরো নিচে নামাল।’ তাহলে পেলোসি এমন সফর করতে গেলেন কেন? কী লাভ বা অর্জন হলো এতে?
বিবিসি আরো বলছে, ‘তাইওয়ান নিয়ে এই যে একটা ধোঁয়াটে অবস্থান, সেটা সবাই মেনে চলে এবং কেউ নিজের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য একটা আক্রমণাত্মক অবস্থান নেয় না। কারণ সেখানে ভঙ্গুর একটি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এটাকেই ‘মন্দের ভালো’ বলে মনে করে সবাই।’
তাহলে এই ‘ধোঁয়াটে অবস্থান’ বা এই ‘মন্দের ভালো’টাকেই ভেঙে ফেলতে পেলোসি এমন মরিয়া সফরে গেলেন কেন? জবাব নেই! বিবিসি আবার বলছে, ‘কিন্তু তাইওয়ান নিয়ে এই যে, একটা পরস্পর-বিরোধী অস্পষ্ট অবস্থান, সেটার ওপর হঠাৎ যেন খুব কড়া আলো ফেলেছে মার্কিন কংগ্রেসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির ওই দ্বীপে এক সফর। চীন আর যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে সেটি তৈরি করেছে বড় ধরনের টানাপড়েন।’ কিন্তু ১৯৭৮ সালের শুরু থেকে সব বিবাদ মিটিয়েই তো ‘এক চীন নীতি’ মেনে নিয়ে আমেরিকা সম্পর্ক শুরু করেছিল। তাহলে ক্রমান্বয়ে এই ‘সম্পর্কের টানাপড়েন’ আবার কেন? নতুন করে ‘অস্পষ্টতা’ তৈরি কেন?
আসলে বিবিসির এই রিপোর্ট সব স্ববিরোধিতায় ভরা। যেমন বিবিসি এতে আরো দুই এক্সপার্টের মন্তব্য নিয়ে এসেছে। এদের একজন হলেন সাবেক কূটনীতিক ড্যানি রাসেল। তিনি এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের একজন বিশ্লেষক। তিনি বলছেন, ‘বিশ্বে এখন আরো যেসব সঙ্কট মোকাবেলায় বড় দুই পরাশক্তির (চীন-আমেরিকার) মনোযোগ দেয়া দরকার, সেই চেষ্টায় আগে থেকেই ঘাটতি দেখা যাচ্ছিল, এখন সেটা যেন আরো বেশি প- হয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকার তালিকায় সবচেয়ে উপরের দিকে আছে রাশিয়ার প্রতি চীনের যে কূটনৈতিক সমর্থন, সেটা কিভাবে থামানো যায়। এরপর চলমান বাণিজ্য যুদ্ধ তো আছেই। এরপর জলবায়ুর পরিবর্তন মোকাবেলা এবং উত্তর কোরিয়ার পরমাণু অস্ত্র নিয়েও চীনের সহযোগিতা আশা করে যুক্তরাষ্ট্র।’ তার মানে সবকিছু একেবারে ভেস্তে দেওয়ার দিকেই বাইডেন হাঁটলেন। আরেক এক্সপার্টের কথা বলেছে বিবিসি। তিনি জার্মান মার্শাল ফান্ডের একজন বিশেষজ্ঞ বনি গ্লেসার। তিনি এক মারাত্মক কথা বলেছেন এভাবে, তাইওয়ানের ইস্যুটি এখন ‘বিশ্বাসযোগ্যতার প্রশ্ন’ সামনে নিয়ে এসেছে। বলছেন, আমার মনে হয় না প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এখন আর জো বাইডেনের কথায় আস্থা রাখতে পারবেন। বনি গ্লেসার আরো বলছেন, তাইওয়ানের ব্যাপারে এখন যে একটা ‘কৌশলগত অস্পষ্টতা’ আছে, তার পরিবর্তে এখন আসলে সবার উচিত যার যার ‘রেড লাইন’ বা চরম সীমা কোথায়, সেটা পরিষ্কার করে বলে দেয়া। আর এজন্য দরকার একটি অকপট আলোচনা। আসলে সমস্যাটা এখানেই। কারণ এখন সবকিছুকেই বাইডেন ‘কপট’ বানিয়ে ফেলেছেন।
আসুন, বাইডেনের কপট অবস্থানের কিছু আলামত দেখি! ২০২১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দু’বছর হয়নি, কিন্তু এ পর্যন্ত বারবার তাইওয়ান প্রসঙ্গে তাকে মাফ চেয়ে বলতে হয়েছে যে, আমেরিকান পুরান তাইওয়ান নীতি বা এক চীন নীতিতে আমেরিকা এখনো অনড় আছে- এটা অগুণতি। এরই সর্বশেষটা হলো, গত ২৪ মে ২০২২। বাইডেন ঐদিন টোকিওতে কোয়াড মিটিং করতে গিয়ে একদিন আগে তারই করা মন্তব্যের জন্য মাফ চান। যেমন আমেরিকান মিডিয়া সিএনবিসি’র হেড লাইন হলো, ‘বাইডেন বলেন, তার তাইওয়ান নিয়ে মন্তব্য থেকে আমেরিকান পলিসিতে কোনো পরিবর্তন হয়েছে মনে করা ঠিক না, যা চীনকে বিরক্ত করেছে।’ কেন বাইডেন সেবারও সমস্যায় পড়েছিলেন? কারণ তিনি আগের দিন বলে ফেলেছিলেন যে ‘তার প্রশাসন সামরিকভাবে তাইওয়ানকে রক্ষা করতে আগ্রহী।’ তাই পরদিনই তার ‘থুক্কু’ বলা! এভাবে নিয়মিতই তিনি মাফ চেয়ে যাচ্ছেন। এ ঘটনার পরে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী জ্যাক সুলিভানও আবার নিশ্চিত করেন যে, আমেরিকা এখনো ‘একচীন নীতিই’ আঁকড়ে আছে; কোনো বদল হয়নি। বাইডেন গত ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতার শপথ নেয়ার পর থেকে এভাবে অন্তত চারবার মাফ চেয়ে বা ভুল না বুঝতে অনুরোধ করে বলে গেছেন, আমরা ‘একচীন নীতিতেই আছি’। এক কথায় ব্যাপারটা বাইডেন একেবারে ছেঁচড়ামোর পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। তাই পেলোসির সফরের পরে জার্মান মার্শাল ফান্ডের বিশেষজ্ঞ বনি গ্লেসার এমন মন্তব্য করছেন যে, ‘তিনি মনে করেন না আর বাইডেন চীনের বিশ্বাসযোগ্যতায় থাকতে পারবেন।’
কেন এমন হচ্ছে: এখন অবশ্য পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, বাইডেন গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নিজের প্রার্থিতায় আগ্রহ দেখানোর আগে থেকেই যে হবু পলিসির কথা ভেবেছিলেন সেখানেই এটা ছিল যে- ‘তিনি চীনবিরোধী একটা পশ্চিমা ব্লক ওয়েস্টার্ন ফোর্স জমায়েত করবেন; ইইউকে সাথে নিয়ে; যার মূল ইচ্ছা-করণীয় হবে চীনের গ্লোবাল নেতৃত্বে চলে আসা ঠেকানো যদিও এটা একটা অসম্ভব কল্পনা মাত্র। কারণ এটা প্রাকৃতিক ভূমিকম্প বা ঘূর্ণিঝড়কে যেমন মানুষ ঠেকাতে পারে না তেমনই ফেনোমেনা। কারণ, সাবজেক্ট মানুষের পক্ষে এমন প্রাকৃতিক ফেনোমেনাকে ঠেকানো অসম্ভব। তবু সম্ভবত বাইডেন মনে করেন এটা জিদ ধরে বসে থাকলেই হয়ে যাবে। কেননা তিনি ইউরোপ বা ইইউকেও সাদা শ্রেষ্ঠত্বের সুড়সুড়ি জাগাতে পারবেন যে, চীনের গ্লোবাল নেতৃত্ব মানে গত ৫-৬ শ’ বছরের লাগাতারভাবে সাদাবাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব; এই শাসন যাতে না লোপ পেয়ে যায়, এই ভয় দেখিয়ে তিনি ইউরোপকে সাথে রাখতে পারবেনই। এরই প্রথম ধাপ হলো ইউক্রেনের যুদ্ধ যেখানে তিনি রাশিয়াকে বধ করার ইচ্ছা নিয়ে আগাচ্ছেন। এতে আরো কল্পনা ছিল যে, রাশিয়াকে উদ্ধার করতে পরে চীন এগিয়ে এলে সেও এতে জড়িয়ে যাবে এবং সেটা সামরিকসহ সবভাবেই। কিন্তু এই শেষের অংশটা ঘটেনি। বাস্তবে চীন রাশিয়ার পাশে গেছে ঠিকই কিন্তু সরাসরি কখনো সামরিকভাবে নয়। তাই এবার বাইডেনের সেকেন্ড উদ্যোগ হলো তাইওয়ান ইস্যুকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে চীনকেও উসকানো। কিন্তু সমস্যা হলো, আমেরিকার এক চীন নীতিতে সম্মতি দেয়া আছে, চীন-আমেরিকার সম্পর্কের সেই শুরু থেকে, ১৯৭৮ সালের আগে থেকে। আর সেখান থেকে এখন বাইডেনের হাতে আমেরিকার সরে যাওয়া মানে হবে, চীনের সাথে আমেরিকার যতসব ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে সব ভেঙে যাওয়া। সেটা আমেরিকান ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা সবাই মানে বলতে একেবারে ওয়াল স্ট্রিট সংশ্লিষ্ট সবাই- এদের পক্ষে তা গ্রহণ করা অসম্ভব। কিন্তু এটা ছাড়া বাইডেনের হাতে আর কোনো মোক্ষম অস্ত্র নেই। তাই লজ্জার মাথা খেয়ে বারবার একচীন নীতি ভাঙছেন আবার মাফ চাচ্ছেন। এছাড়া এসবের সাথে বাইডেনের হাতে আরেক সাফাই বয়ান আছে। সেটা হলো, বাইডেন অ্যান্ড গং তার ভাষায় ওয়েস্টার্ন ফোর্স বা পশ্চিমা ব্লক এদের ‘মূল্যবোধ’ নাকি আলাদা, আর তা নাকি অনেক উন্নত। তুলনায় চীন, এরা ছোটলোক যেন। আর এর ইঙ্গিতেই প্রায় সব জায়গায় বাইডেনের সঙ্গী-সাগরেদরা বলে থাকেন- তারা হলেন ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডারের’ পক্ষের লোক। মানে হলো, ১৯৪৫ সালে গঠিত যে ‘জাতিসঙ্ঘ এবং আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক’ ইত্যাদি, এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যে গ্লোবাল ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেটা আমেরিকার নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল। তাই তারা শ্রেষ্ঠ। আর এখন আগামীতে চীনের নেতৃত্বে যা কিছু গড়ে উঠবে এরা নিচা জাত যেন। ফলে এখন এটি বাইডেন গংয়ের কাছে মূল্যবোধের লড়াই। এটাই সাদা শ্রেষ্ঠত্ব এই রেসিজমের বয়ান। আর এর ওপর ভর করেই বাইডেন জিততে চান।
কিন্তু যদি প্রশ্ন করি, আইএমএফকে পাশ কাটিয়ে খেয়াল খুশিমতো যাকে ইচ্ছা তাকে ডলার-অবরোধে ফেলে দেয়া; এটা কোন ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডারের’ কা-? রুলের কথা যদি তোলে, তবে আমেরিকাকে মানতে হবে যে, আইএমএফ-ই এক সঠিক অথরিটি যারা ডলার-অবরোধ কাউকে দিতে হলে তা নির্ধারণের বৈধ কর্তা। আইএমএফের বদলে এটা আমেরিকার খেয়ালে ইচ্ছামতো আরোপ মানে হলো, এটা আমেরিকার ক্ষমতার অপব্যবহার। ঘটনা আরো আছে। যেমন, আবার সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়ার মাঝের মালাক্কা প্রণালী বন্ধ করে চীনের আমদানি-রফতানি-বন্দর আটকাতে যেতে হবে, এই স্ট্র্যাটেজিক কৌশলের চিন্তা আমেরিকার সিনেট রিপোর্টে যেটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে- এমন এক আমেরিকান পদক্ষেপ। এখন এই পদক্ষেপ কোন মহান ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডারের’ নমুনা? আর আমেরিকান এই মহান কাজে নেমে যাবার জন্য এতে স্বভাবতই, চীন নিজের জন্য বিকল্প পথ ও পোর্টে প্রবেশপথ খুঁজবে, নয়া কিছু গড়ে নিয়ে চেষ্টাও করবেই। এরই বাস্তব রূপ হলো, গোয়াদর, হাম্বানটোটা, বার্মা, বাংলাদেশ ইত্যাদি গভীর সমুদ্রবন্দর গড়ে সেখান থেকে চীনের পশ্চিম দিক দিয়ে চীনে প্রবেশের রাস্তা, গভীর সমুদ্রবন্দর সংযোগ খুলতে চেষ্টা করবেই। চীন সাড়ে তিন দিক দিয়ে ভূমিতে বা সুউচ্চ হিমালয়ের মতো পর্বতমালায় আবদ্ধ এমন এক ভূখ-। সেখানে ওর পুবদিকের বন্দরের প্রবেশপথ আমেরিকা বাধা দিয়ে বন্ধ করতে গেলে চীন তো বিকল্প বের করতে চাইবেই। অথচ এই চেষ্টা করলেই এবার প্রপাগান্ডা- এসব বন্দর গড়া হচ্ছে নাকি ভারতকে মুক্তমালার মতো চার দিক থেকে ঘিরে ধরার জন্য। ভারতে আমেরিকান থিংকট্যাংকের শাখা খুলে এবার তাদের দিয়ে এই প্রপাগান্ডা চালানো হয়েছে। আবার একই কারণে চীন, পূর্ব চীন সাগরে কোনো নিয়ম মেনে চলার আর তাতে নিজের আধিপত্য রাখার চেষ্টার দিকে আমেরিকা তাকে ঠেলে দিয়েছে। কিন্তু এবার বলা হচ্ছে চীন ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার’ মানে না। জাতিসঙ্ঘের আনক্লজে (ইউএনসিএল ও এস) ফিলিপাইনের সাথে বিরোধ মীমাংসায়, চীনা বিচারক বদলে দেওয়ার অনুরোধ উপেক্ষা করে এক জাপানি বিচারককে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ আনক্লজ- এটি তো ঠিক শাস্তি দেয়ার কোনো আদালত নয়, বরং আর্বিট্রেশন বা সালিশ আদালত ধরনের। মানে যেখানে আপসে সমাধান বের করা যায়। তাই এখানে বিচারক বদলে দেয়ার অনুরোধ করা যায়। অথচ সেই নীতি কাজ করতে দেয়া হয়নি। ফলে প্রতিবাদে চীন আর ওই আদালতে অংশ নেয়নি। অথচ প্রপাগান্ডা হলো, চীন তাদের কথিত ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার’ মানে না। আর বিপরীতে মহান আমেরিকা নাকি সমুদ্রে ঘুরেফিরে বেড়ানোর মুক্ত স্বাধীনতা চায়! আর চীন সেটা দিতে চায় না। এই হলো মুক্ত দুনিয়ার মানুষের কারবার!
আসলে, আমেরিকা কত মুক্ত দুনিয়ার মানুষ তা কী আমরা আমাদের ‘ওয়ান-ইলেভেন’ এর সময় দেখিনি? ভারতের হাতে বাংলাদেশকে তুলে দেয়ার মুক্ত দুনিয়ার বাসিন্দা আমেরিকার কায়কারবার কি আমরা দেখিনি? এটাইবা কোন ‘রুল বেইজড ইন্টারন্যাশনাল অর্ডারের’ অধীনে করা হয়েছিল? কে দেবে এর জবাব? হাসিনা বা আমেরিকা কেউ কি দেবে? আজ উল্টা আমরা আমেরিকার থাবায় আটকে পড়েছি। (দৈনিক নয়াদিগন্তের সৌজন্যে) লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক goutamdas1958@hotmail.com