শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৮ অপরাহ্ন

তেলের দামে গরিবের নাভিশ্বাস

হাবীব ইমন
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ১২ আগস্ট, ২০২২

আন্তর্জাতিক বাজার আর দেশের বাজার সবখানেই চলছে স্মরণকালের ভয়াবহতম মূল্যস্ফীতি। দেশের মানুষ দিশেহারা। এই পরিস্থিতির মধ্যেই সরকার গত শুক্রবার রাতে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দিল। ডিজেল ও কেরোসিনের লিটারপ্রতি দাম বেড়েছে ৩৪ টাকা। পেট্রলে ৪৪ টাকা এবং অকটেনে বেড়েছে ৪৬ টাকা। শুক্রবার রাত ১২টার পর থেকেই নতুন দাম কার্যকর হয়েছে। আর জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, এখন থেকে ডিজেলের দাম হবে প্রতি লিটার ১১৪ টাকা, যা এত দিন ৮০ টাকা ছিল। কেরোসিনের নতুন দামও ডিজেলের সমান, অর্থাৎ ১১৪ টাকা। পেট্রলের নতুন দাম প্রতি লিটার ১৩০ টাকা, যা এত দিন ৮৬ টাকা ছিল। আর অকটেনের দাম আগের ৮৯ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৩৫ টাকা।
সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, আইএমএফ ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবেই সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম বাড়াতে হয়েছে সরকারকে। কিন্তু কে না জানে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হলে সব ধরনের ভোগ্য ও নিত্যপণ্যেরই দাম বেড়ে যায়। তেলের দাম বাড়ানোর পরদিনই রাস্তাঘাট, বাজার থেকে শুরু করে সবখানেই তার উত্তাপ টের পাওয়া যাচ্ছে। সংগত কারণেই আশঙ্কা হচ্ছে মূল্যস্ফীতির পরিস্থিতি এবার হয়তো নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু আমরা জানি এতে দেশের বেশিরভাগ সম্পদের মালিক অতিধনীদের কিছুই আসবে যাবে না। দ-মু-ের হর্তাকর্তা ধনী-উচ্চবিত্ত কিংবা সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলাদেরও কোনো সমস্যাই হবে না। বরং তাদের অনেকেরই আঙুল আরও ফুলেফেঁপে কলাগাছ হয়ে উঠতে থাকবে। সব বোঝা যাদের বইতে হয় সেই খেটে খাওয়া গরিব মানুষেরাই বিপদে পড়বে। তাহলে ব্যাপক আয়বৈষম্যের এই দেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব মানুষ এখন কোথায় যাবে? তাদের কথা কে ভাববে? এই পরিস্থিতিকেই সম্ভবত গরিবের পেটে লাথি মারা বলে।
দুই. কিন্তু আমরা বাংলাদেশকে এই অবস্থায় নিয়ে এলাম কীভাবে? মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত বাংলাদেশের প্রথম সরকার রাষ্ট্রকে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ ঘোষণা করেছিল। এর মানে জন্মলগ্ন থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মূলনীতি হলো শ্রমজীবী আর সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পাহারাদার। সেজন্যই রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির দ্বিতীয়টিই ছিল ‘সমাজতন্ত্র’। অথচ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল, পাঁচ বছরে অতিধনীর সংখ্যাবৃদ্ধির বিচারে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেছে। ওই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদের মালিক অতিধনীর সংখ্যা বেড়েছে বার্ষিক ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। দ্রুত অতিধনী হওয়া তালিকার শীর্ষে থাকা বাংলাদেশে দারিদ্র্য কমছে খুবই মন্থরগতিতে। অন্যদিকে ধনী ও গরিবের বৈষম্য বাড়ছেই। অথচ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বড় মন্ত্র ছিল, বড় আকাক্সক্ষা ছিল, একটা বৈষম্যমুক্ত সমাজ তৈরি করা। সেটি আজ কতদূর? গত ১৫ বছরে ধনিক শ্রেণির আয় যে পরিমাণ বেড়েছে, তা দিয়েই দেশের চরম দারিদ্র্য দূর করা সম্ভব। কিন্তু তাদের আয় কি দেশে আছে?
তিন. দেশের আয় ও সম্পদের এমন পুঞ্জীভূত উদ্ভূত আয়বৈষম্য বাংলাদেশের রাজনীতিকে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের’ নিকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরছে। মাঝে সংবিধানে অনেক কাঁটাছেড়া হওয়ার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চারটি মূলনীতির মধ্যে ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে আবারও ‘সমাজতন্ত্র’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১১ সালে সংসদে পাস হওয়া সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সে রায়কে সংবিধানে ফিরিয়ে আনলেও সরকার এখনো ‘মুক্তবাজার অর্থনীতির’ মধ্যে মেতে রয়েছে। ২০০১-২০০৫ পাঁচ বছরে বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে পাঁচবার বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেছিল। আর এখন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করল ধনকুবেরের সংখ্যাবৃদ্ধির দৌড়ে।
চার. জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্থনৈতিক উন্নয়নের সূচক। কিন্তু সেটাই অগ্রগতির একমাত্র সূচক নয়। বাংলাদেশ যদি প্রকৃত অর্থে সামনে এগিয়ে যেতে চায়, তাহলে সব ধরনের সম্পদের বৈপ্লবিক পুনর্বণ্টন করতে হবে; স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা ও সামাজিক সুরক্ষার বিধান করতে হবে। আয়বৈষম্য যে পর্যায়ে গেছে, তাতে মজুরি অবশ্যই বাড়াতে হবে, ধনীদের মুনাফা ও নির্বাহীদের আয়ের সীমা নির্ধারণ করে দিতে হবে। আর এটা করতে হলে ‘নয়া উদারনৈতিক নীতি’ পরিহার করতে হবে।
পাঁচ. খবরের পাতা খুললেই ইদানীং বড় বড় হরফে মূল্যস্ফীতি আর একের পর এক নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ে না। অন্যদিকে বছরের পর বছর ধরে শিরোনাম হতে থাকে দুর্নীতি, অনিয়ম, ধর্ষণ, আত্মহত্যার মর্মান্তিক সব ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দুর্নীতি, নিয়ম-না মেনে চলা ইত্যাদি গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কোথাও কোনো কাজ যদি সহজে, টাকা-পয়সার লেনদেন ছাড়াই হয়ে যায়, তাহলে আমরা আজকাল চমৎকৃত হই। নিজের মনেই ভাবি, আজ সকালে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম! কোনো সৎ, ঋজু শিরদাঁড়ার মানুষ দেখলে মনে হয় ঈশ্বর দর্শন হলো বুঝি। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্পকলা, সিনেমা, সব কিছুতেই দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শাসকের মন জুগিয়ে-না-চলা বেয়াড়া লোকদের শায়েস্তা করার সংস্কৃতি। তাই সবক্ষেত্রে স্তাবকতা ও চাটুকারিতার হিড়িক। যেভাবেই হোক, নিজের আখেরটুকু গোছাতে হবে।
ছয়. এই পরিস্থিতি দেখে থমকে দাঁড়াই। দেশের মানুষ এখনো স্পষ্টভাবেই দুই ভাগে বিভক্ত: এক ভাগ বিদ্যুতের আবরণে এসির বাতাসে সিক্ত, আরেক ভাগ বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে সন্তানকে বিক্রি করছেন। কিন্তু এর বাইরেও আরও কতগুলো ভাগ আছে। এক ভাগে আছে যারা পলকহীন চোখে এসব কা-কীর্তি দেখে আঙুল চোষেন। আরেক ভাগ আছেন যারা এসবের কিছুই দেখছেন না। ঘরের দরজা বন্ধ করে ছোট্ট চিলতে জানালা দিয়ে আকাশ দেখছেন। অসহায় অবয়বে অসহায় চোখ, তারা জানেন, জেনে এসেছেন ওই আকাশে আমাদের স্রষ্টা থাকেন! কোথায় আছেন তা জানেন না। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে ভাষণ দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘পৃথিবী আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এক ভাগে শোষক শ্রেণি, আরেক ভাগে শোষিত।’ বঙ্গবন্ধু শোষিতের দলে ছিলেন। আমরা কোন দিকে আছি? লেখক : সহকারী সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন emonn.habib@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com