বাংলাসাহিত্যে এক অনিবার্য নাম মোশাররফ হোসেন খান। কবিতার সাথে যার ঘরবসতি, গল্পের সাথে যার অটুটপ্রেম, উপন্যাসনদীতে যিনি নিরলস মাঝি, প্রবন্ধের বন্ধনে যিনি আটপাকে বাধা, শিশুসাহিত্যের সাথে যার স্বপ্নখেলা, সম্পাদনার সাথেও যিনি সংসার গড়েছেন একান্তভাবে। শয়ন স্বপন জাগরণে সার্বক্ষণিক তাঁর অস্থিমজ্জায় খেলা করে লেখালেখির প্রজাপতি। পড়া লেখা এবং সম্পাদনাÑ এ উম্মাদনায় তিনি পার করেন জীবনের শীত-বসন্ত; সময়ের নদী। সাহিত্যের পরশ, সুস্থ-সংস্কৃতির আবহাওয়া পেয়েছেন তিনি জন্মগতভাবেই। যশোর মানেই সবুজ সাহিত্যভূমির ছোঁয়া। ঝিকগাছার বাঁকড়া গাঁয়ের খান পরিবারের ঐতিহ্যে স্বপ্নবাজ হয়েই বেড়ে উঠেছেন মোশাররফ হোসেন খান। কৈশোর-তারুণ্যেও পেয়েছেন সবুজাভ চেতনার সোনালি সহযাত্রী। সেই শেকড়সন্ধানী তৃষ্ণা আর আদর্শিক বলয় তাঁকে কক্ষচ্যুত করেনি কখনো। তিনি লিখে চলেছেন মানবতার জন্যে, সবুজ পৃথিবীর জন্যেÑ সর্বোপরি চিরকালীন সফলতার মাইলস্টোন স্পর্শ করার প্রত্যাশায়।
কবিতা এক ধরনের প্রেরণা। সমাজ-সংসারে ঘটে যাওয়া নানা অসংগতির বিরুদ্ধে নান্দনিক প্রতিবাদ, মহামিলনের কোমল হাওয়া। কবিকে তাড়িত করে সম্বৃত-বেগ। মনোনায়ক কবিকে লিখতে উদ্বুদ্ধ করে। সেই তাড়না থেকেই জন্ম হয় কবিতার অস্তিমজ্জা। এ তাড়নায় প্রায় প্রত্যেক মানুষের মনোনায়কই আপ্লুত ও প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। সৃষ্টি হয় ভালোবাসার কোমল মৃত্তিকা কিংবা বিধ্বংসী বারুদ। আর তাইতো কবি অমিয় চক্রবর্তীর ভাষায় বলা যায়, ‘রাস্তায় ঘাটে কবিতা ছড়ানো; সিঁড়ির ধাপে, ঐ পাশের দরজায় পিতলের কড়াটা পর্যন্ত।’ কবিতার এতো ছড়াছড়ি চোখে পড়লেও সকলেই কবি হয় না, কেউ কেউ কবি হয়। আর এ ধরনের ‘কেউ কেউ’ এর অন্যতম কবি মোশাররফ হোসেন খান।
‘পাথরে পারদ জ্বলে, জলে ভাঙ্গে ঢেউ/ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে জানি গড়ে যাবে কেউ’- এটা পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম। ভাঙা-গড়ায় খেলায় নিজেকে সাহসী সৈনিকের আসনে প্রত্যেক মানুষ। তবুও হেরে যায় অনেকেই। অনেক কবিও হেরে যায়। শুধু হারে না স্বপ্নচোখের নিশান, বিশ্বাসী চেতনার প্রশান্ত আত্মা। কবি মোশাররফ হোসেন খান সেই সারিতেই নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। যদিও ইতিহাসের পথ আগলে নিজেকে আবিস্কারের নেশায় অন্ধকারকেও স্মরণ করেন ‘পলাশীর ইতিহাসের মতো/ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে আমার শৈশব।/ পোড়াবাড়ির অস্পৃশ্য দরোজার মতো/ আমিও একাকী, বেদুইন যাযাবর।’ হতাশাবাদী হয়ে নয় বরং বিবর্ণ পৃথিবীর ছবি আঁকতেই তিনি পিছনে তাকিয়েছেন। মূলত খুঁটিবিহীন জংলাবৃক্ষের মতো হাজার ঝড়েও নূয়ে পড়েন না তিনি। তাইতো সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন, ‘মূলত মানুষ আমি/ শতাব্দীর শীর্ষচূড়া/ সীমাহীন জ্যোতির উদ্ভাস।’ [পাথরে পারদ জ্বলে]। সমস্যার কফিন তাঁকে আরো বেশি সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়, স্বপ্ন গড়ে দেয় নতুন ভোরের।
কবিতার সাথে ঘরবসতি গড়েছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান- এ কথা আগেই বলেছি। প্রেম, দ্রোহ, মানবতা, ইতিহাস, ধর্মবোধ, সর্বোপরি লাল-সবুজের বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মাটি ও মানুষকে চিরায়ত স্বভাবে বুকের সাথে আগলে নিয়েছেন কবিতার ভালোবাসায়। ১৯৮৬ সালে ‘হৃদয় দিয়ে আগুন’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশনার মধ্যদিয়ে কবিতার মাঠে নিজের অবস্থান জানান দেন তিনি। সূচনাকবিতাতেই তিনি সাহসের সাথে উচ্চারণ করেন, ‘আমার কবিতা পড়ে যদি কোন রমণী/ প্রসব করে বসে হিং¯্র শাবক/ যদি কোন শিকারী কৃষকের গান ভুলে/ যুদ্ধের গান গাইতে গাইতে তাক করে বসে/ পাপিষ্ঠ বুক/ তবে আমার কি দোষ?’ আর থেমে থাকেনি তাঁর কাব্যযাত্রা। সময়ের ধারাবাহিকতায় নেমে আসে কবিতার ঝর্ণা। নেচে ওঠা সমুদ্র, আরাধ্য অরণ্যে, বিরল বাতাসের টানে, পাথরে পারদ জ্বলে, ক্রীতদাসের চোখ, নতুনের কবিতা, বৃষ্টি ছুঁয়েছে মনের মৃত্তিকা, দাহন বেলায়, কবিতাসমগ্র, সবুজ পৃথিবীর কম্পন, পিতার পাঠশালা, স্বপ্নের সানুদেশ’ কাব্যগ্রন্থগুলো তাঁকে পর্বে পর্বে কবিসত্তার উন্নত শিখরে তুলে এনেছে। বিশেষকরে ‘পাথরে পারদ জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি পাঠকমহলকে ব্যাপকভাবে চমকে দেয়। গ্রন্থের শিরোনাম কবিতাটি সাহিত্যের ইতিহাসে অমরতার স্বীকৃতি বয়ে আনে বলে সমালোচকগণ মনে করেন।
‘কবিতাকে আমি অনুপ্রাণিত সংলাপ বলে অনুভব করি। কবিতার ভেতরে আমি জীবন-অভিজ্ঞতার সার আবিস্কার করি। সংকেতে প্রতীকে রূপকল্পে কবিতা আসলে তুলে ধরে আমাদেরই আশা হতাশা, বোধ ও বিবেচনা, আনন্দ দুঃখ, আর আমাদেরই অস্তিত্বের সংকোচন ও সম্প্রারণের সংবাদ।’ কবি সৈয়দ শামসুল হকের এমন বক্তব্যের অনুরণন খুঁজে পাই কবি মোশাররফ হোসেন খানের কবিতায়। নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্নে তিনি বলে উঠেন, আমার হাতের তালুতে সুন্দর শিশুর মতো/ নিরাপদে হেসে ওঠে উজ্বল পৃথিবী।’ কিন্তু এ স্বপ্নগুলোকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে কতিপয় ক্ষমতালোভী নরপিশাচ এবং মানুষরুপী কিট। কবির ভাষায় – ‘বলো, কিভাবে আমরা শব্দ সঙ্গীত কিংবা প্রেমকলায় মুগ্ধ হবো/ লম্পট ষাঁড়েরা দেখ ক্রমাগত ঢুকে যাচ্ছে আমাদের সজীব শস্যক্ষেতে/ চীনের প্রাচীর টপকে ইঁদুরেরা ঢুকে যাচ্ছে আমাদের বসত ভিটেয়/ আর একটা বাজপাখির ডানার ঝাপটায় প্রকম্পিত এশিয়ার হৃৎপি-।’ তাইতো কবিকেও বিদ্রোহী হয়ে উচ্চারণ করতেই হয়- ‘আমার এখন ইচ্ছে হয় একজন বিদ্রোহীর মতো বারুদ বিষাদে জ্বলে উঠতে/ ইচ্ছে হয় আগুনের লাল শিখায় দগ্ধিভূত করে স্বাধীনতার আজন্ম নগ্নদেহ/ ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেই বেলুনের মতো শূন্যে, ভাসমান বাতাসে, অদৃশ্য গোলকে/ একটি স্বাধীনতার জন্যে, একটি পবিত্র মুখের জন্যে আর কতকাল অপেক্ষা করবো/ আর কতকাল পুষে রাখবো আহিমাদ্রি স্ফুলিঙ্গ, শেকল ভাঙ্গার বাসনা/ হে স্বাধীনতা/ হে স্বকাল/ তোমার দেহের অপবিত্র নগ্নতা ঢাকতে দেশদ্রোহী কিংবা নির্বাসনে যেতেও প্রস্তুত/ আমি শুধু দেখতে চাই তোমার আবৃত বুকের ওপর গজিয়ে ওঠা সাদা গম্বুজ/ যে গম্বুজের নিশান ছুঁতে পারে না কোন শকুন কিংবা বাজের নখর।’
তারুণ্যের উচ্ছ্বলতায় টগবগে স্বপ্নগাঁথা কবিতার বীজ বুনিয়ে চলেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে তারুণ্যের গান শুনিয়েছেন, জাগিয়ে দিয়েছেন সুপ্ত মনন; কবি মোশাররফ হোসেন খানও আধুনিকতার স্পর্শদিয়ে তারুণ্যের অগ্নিস্ফুলিঙ্গকে প্রোজ্বলিত করার প্রয়াস চালিয়েছেন। বুকের ভেতর দহন দুপুর কাব্যগ্রন্থে তিনি বিদ্রোহের তেমন সাহসী সঙ্গীতের উচ্চারণ করেছেন অবলীলায়। ‘আয়রে আমার প্রলয় তরুণ/ তীব্র দহন দীপ্র অরুণ! অচল ঘড়ি ভাঙরে দেখি, ভাঙরে তোরা গভীর গহন/ নতুন জগত গড়বি তোরা, গড়ার ভার র্কনা বহন।’ ‘ফের মিছিলে জাগবে সাড়া জাগলে তুমি জাগবে দেশ/ শত মিছিল সামনে আছে এক মিছিলে নয়তো শেষ।’ এমন প্রেরণার মশাল জ্বালিয়ে তিনি তারুণ্যকে উদ্দীপ্ত করেছেন।
কবিতার উপমা-উৎপ্রেক্ষা, ছন্দবিজ্ঞান, অলংকার কিংবা বিষয়ের উপযোগিতায় মোশাররফ হোসেন খান অনন্য। ‘অগ্নি-বলাকার ঠোঁট থেকে ঝরে পড়ছে ঘৃণার বৃষ্টি’ ‘টেবিলের উপর কাত হয়ে পড়ে আছে অশেষ বিষণœতা’ ‘টেবিলের নিচে হাঁটু ভেঙ্গে বসে আছে ব্যর্থতা’ ‘সিল্কের পর্দার মতো ঝুলে আছে আধেক জোছনা/ রাতের শরীর থেকে খসে পড়ছে পিঙ্গল বসন’ ‘শুধুমাত্র একটি নক্ষত্রÑ দলছুট গাঙশালিকের মতো/ অসীম নীলের উঠোনে পায়চারী করছে’ ‘বারুদের শিঙে ঝুলে আছে বিপন্ন পৃথিবী’ ‘প্রতিবাদী হরিণীর শিঙে ঝুলে আছে সাদা চাঁদ’ ‘আমার কণ্ঠস্বরে কোমর দুলিয়ে হেসে উঠলো রাতের দেহ। কেঁপে উঠলো অন্ধকার। কেঁপে উঠলো শীতল হাওয়ায় মেঘের পালক।’ ‘আমি বারুদের ধোঁয়া ঠোঁটে মেশিন গানের তলপেট ভেদ করে ভূমিষ্ট হয়েছি’ এমন অসংখ্য পঙক্তি বাংলা কাব্যসাহিত্যকে অমরত্ব দান করেছে।
কথাসাহিত্যের ক্ষেত্রেও সফলতা ছুঁয়েছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। প্রচ্ছন্ন মানবী, সময় ও সাম্পান, ডুবসাঁতার, জীবনস্রোত প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ তাঁকে কথাসাহিত্যে সমাদৃত করেছে। শিশুসাহিত্যেও তিনি একজন সফল লিখিয়ে। ছড়া, কিশোর কবিতা, শিশুতোষ গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ শিশু-কিশোরদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিশেষকরে তাঁর পাঁচখ-ে প্রকাশিত ‘সাহসী মানুষের গল্প’ তরুণ প্রজন্মকে আলোর পথে হাঁটতে রাহবারের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এছাড়াও রহস্যের চাদর, অবাক সেনাপতি, দূর সাগরের ডাক, কিশোর কমান্ডার, ছড়ির তরবারি, কিশোর গল্প ১-২, জীবন জাগার গল্প, সুবাসিত শীতল হাওয়া, আগুন নদীতে সাঁতার, অবাক করা আলোর পরশ, ছোটদের বিশ্বনবী প্রভৃতি গ্রন্থসমূহ শিশু-কিশোর গদ্যসাহিত্যে বিশেষ আসন দখল করতে সক্ষম হয়েছে। হাজী শরীয়তুল্লাহ, সাইয়েদ নিসার আলী তিতুমীর, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মুনশী মোহাম্মদ মেহেরউল্লাহ, তিন নকীব প্রভৃতি জীবনীগ্রন্থও তাঁকে প্রিয় সাহিত্যিক হিসেবে স্থান করে দিয়েছে মননশীল তরুণ প্রজন্মের কাছে। সেইসাথে বিপ্লবের ঘোড়া, সাগর ভাঙার দিন, ঝিমায় যখন ঝিকরগাছা, কিশোর উপন্যাসসমগ্র, স্বপ্নের ঠিকানা, বাঁকড়া বিলের বালি হাঁস, কিশোর গল্পসমগ্র মোশাররফ হোসেন খানকে ভিন্ন আঙ্গিকে পরিচিত করেছে।
মোশাররফ হোসেন খান মূলত একজন প্রবাহমান নদী। ১৯৫৭ সালের ২৪ আগষ্ট বাবা-মায়ের কোল আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন তিনি। স্কুল জীবন থেকে অদ্যাবধি দুকূল ছাপিয়ে স্বকীয় ঢঙে তিনি এগিয়ে চলেছেন সাহিত্যের বহমান নদীতে। প্রাকৃতিক শস্যের ন্যায় তিনি উৎপাদন করে চলেছেন সাহিত্যের সুস্বাদু শষ্যদানা।
বিশুদ্ধতার পতাকা হাতে খান জাহান আলীর আদর্শে এগিয়ে চলেছেন লাল-সবুজের এ প্রিয় ভূখ-ে। পাললিক জনপদে তিনি সবুজের চাষবাসে নিমগ্ন একজন কবিপুরুষ। নানামুখি বঞ্চনা তার গতিকে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করলেও তিনি এগিয়ে যাচ্ছেন সামনের গতিপথে সমান তালে। বাহ্যিক চাকচিক্যময় সফলতাকে তিনি আমলে না নিয়ে একজন সত্যিকারের স্বপ্নসাধক হিসেবে জাতিকে সামনের দিকে আহ্বান করে যাচ্ছেন। শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবাসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে তিনি লক্ষ্যপানে এগিয়ে নেয়ার স্বপ্নে বিভোর। অসহায় দুর্বল এমনকি মৃত্যুপথযাত্রীকেও তিনি স্বপ্নাতুর প্রভাতের আলো দেখাতে চান। কবি বলেন, ‘খাটিয়াতে যে লাশ গোরস্থানমুখী/ তিনিও ঘুরে দাঁড়ান/ মুখ ফেরান স্বপ্নাতুর প্রভাতের দিকে।’ ‘পাতালের গুহা থেকে জেগে ওঠো সাহসের ঘোড়া/ জেগে ওঠো জনপদ- হিমালয়, পর্বতের চূড়া/ মানুষ তরঙ্গ হও, মুছে ফেলো শোকের ললাট/ মানুষ সমুদ্র হও, ভেঙ্গে চলো কালের কপাট।’ পরিশীলিত সাহিত্যের চাষবাসে হৃদয়মৃত্তিকায় বেড়ে উঠবে সবুজাভ বৃক্ষ, প্রশান্তির পরশ ছড়িয়ে পড়বে বাংলাদেশ থেকে গোটা পৃথিবীর উঠোনে- এ স্বপ্ন খেলা করে মোশাররফ হোসেন খানের চোখে-মুখে। হৃদয়মৃত্তিকার এ কবিকে আমরা কালের সাহসী মুয়াজ্জিন হিসেবে দেখতে পাই। দেখতে পাই নিরাপদ পৃথিবীর স্বপ্ননির্মাতা হিসেবে। লেখক: অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়