মানুষ এবং জিন জাতিকে সৃষ্টির পেছনে রয়েছে মহান আল্লাহর একটি মহৎ উদ্দেশ্য। আর সেই মহৎ উদ্দেশ্যটি হলো- মানুষ এবং জিন জাতি আল্লাহ তায়ালার ইবাদত বন্দেগি করবে। মানুষ ইবাদত-বন্দেগি করে ঠিকই; কিন্তু এ ইবাদত-বন্দেগি করে মানুষ তা অন্যকে দেখিয়ে নিজের বুজুর্গি জাহির করতে চায়। তাদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।
রিয়ার পরিচয় : রিয়া শব্দের অর্থ হলো লোক দেখানো। মানুষকে উত্তম চরিত্র দেখিয়ে তাদের অন্তরে নিজের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাকে রিয়া বলে। ইমাম গাজ্জালি রহ: বলেন, লোক দেখানো ইবাদতের মাধ্যমে নিজের মহত্ত্ব ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই হলো রিয়া। জেনে রেখো, রিয়া হারাম আর রিয়াকারী আল্লাহ তায়ালার কাছে অভিশপ্ত। কিয়ামতের ময়দানে তার জন্য কঠিন শাস্তির বিধান নিশ্চিত করা হয়েছে। ‘অতএব, দুর্ভোগ সেসব নামাজিদের জন্য যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বেখবর; যারা তা লোক দেখানোর জন্য করে এবং নিত্যব্যবহার্য বস্তু অন্যকে দেয় না’ (সূরা মাউন, আয়াত : ৪-৭)।
রিয়া এক ধরনের প্রতারণা : রিয়া এক ধরনের ধোঁকা ও প্রতারণা হারাম হওয়ায় রিয়াকারীর অন্তরে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ভয়ের চেয়ে দুর্বল বান্দার ভয় বেশি থাকে এমনকি আল্লাহকে বাদ দিয়ে বান্দাকে খুশি করতে আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। এদিক দিয়ে রিয়াকারী বান্দাকে আল্লাহর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়।
রিয়া মুনাফিকের আলামত : রিয়া মুনাফিকের আলামত। তারা ইসলামী রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করার জন্য মুসলমানদের দেখানোর জন্য নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত-বন্দেগি করত। আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। আল্লাহ পাক বলেন, ‘অবশ্যই মুনাফিকরা প্রতারণা করছে আল্লাহর সাথে, অথচ তারা নিজেরাই নিজেদের প্রতারিত করে। বস্তুত তারা যখন নামাজে দাঁড়ায় তখন দাঁড়ায় একান্ত শিথিলতা ও লোক দেখানোর জন্য। আর তারা আল্লাহকে অল্পই স্মরণ করে’ (সূরা নিসা, আয়াত-১৪২)।
রিয়াকারী ভ- ও প্রতারক : রিয়া এক ধরনের প্রতারণা। রিয়াকারী কেবল মানুষের সাথে নয় স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার সাথে প্রতারণা করতে চায়। তাই সে বড় প্রতারক ও ভ-। জনৈক ব্যক্তি রাসূল সা:-কে জিজ্ঞেস করলেন, কিয়ামত দিবসে আমার নাজাতের উসিলা কী হবে? উত্তরে রাসূল সা: বললেন, তুমি আল্লাহকে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করো না। লোকটি বলল, আমি কিভাবে আল্লাহকে ধোঁকা দেবো? নবী সা: বললেন, কাজ তো আল্লাহ যা হুকুম করেছেন তাই করবে কিন্তু উদ্দেশ্য হবে আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু। রিয়া থেকে বেঁচে থাকো, কেননা রিয়া হচ্ছে শিরক। কিয়ামত দিবসে সব মাখলুকের সামনে রিয়াকারীদের চারটি নামে ডাকা হবে- ১. হে কাফের; ২. হে পাপী; ৩. হে দাগাবাজ ও ৪. হে ক্ষতিগ্রস্ত! তোমার সমস্ত আমল বরবাদ, তোমার প্রতিদান হয়ে গেছে। আজ তোমার জন্য কিছুই নেই। হে প্রতারক! তুমি যার জন্য আমল করেছিলে আজ তার কাছ থেকে সওয়াব আদায় করো। আরো বর্ণিত আছে যে, ‘রোজ কিয়ামতে এরূপ একটি প্রকাশ্য ঘোষণা শোনা যাবে যে, তারা আজ কোথায় যারা মানুষের ইবাদত করত? দাঁড়িয়ে যাও এবং যাদের ইবাদত করতে তাদের কাছ থেকেই প্রতিদান গ্রহণ করো’ (ইমাম গাজ্জালি রহ:, মিনহাজুল আবেদিন, বাংলা, পৃষ্ঠা-২৩২)।
রিয়া থেকে বাঁচার উপায় : রিয়া আমলকে নষ্ট করে দেয়, রিয়াকারীর ওপর আল্লাহ তায়ালা অসন্তুষ্ট হন। পরকাল তার জন্য জাহান্নাম নির্ধারিত হয়ে যায়। আর এটি একটি মারাত্মক অন্তরের ব্যাধি। সুতরাং রিয়া থেকে প্রত্যেক মুসলমানকে বাঁচতে হবে। তার পরিবার ও সন্তানদের বাঁচাতে হবে। রিয়া থেকে বাঁচার জন্য কিছু করণীয় উপায় বর্ণনা করা হলো।
প্রথমত, রিয়া প্রদর্শনের মাধ্যমে যেহেতু অন্যের কাছ থেকে মান-মর্যাদা ও প্রশংসা ইত্যাদি পাওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে প্রথমে রিয়াকারীর অন্তর থেকে ওই সব ধ্বংসশীল আশা-আকাক্সক্ষা ধুয়ে মুছে ফেলে দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, রিয়া হলো ইখলাসের বিপরীত, অর্থাৎ যার অন্তরে রিয়া আছে তার অন্তরে ইখলাস নেই। ইখলাস অর্জন করলে রিয়া দূরীভূত হবে। সুতরাং ইখলাসের মাধ্যমে রিয়া থেকে বাঁচা সম্ভব।
তৃতীয়ত, যেহেতু এসব গুনাহের মূল উৎস প্রদানকারী হলো নফস শয়তান। সেহেতু সর্বদা শয়তানি কর্মকা-ের বিপরীত কাজ করতে হবে।
চতুর্থত, এই ব্যাধি থেকে বাঁচার আরেক উপায় হলো হক্কানি-রব্বানি আলেমে দ্বীন ও পীর-মুর্শিদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাজকিয়ায়ে নফস বা আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ করা। নবী করিম সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমরা এমন আলেমের মজলিসে বসো যিনি পাঁচটি (ধ্বংসাত্মক) বস্তু থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে পাঁচটি (কল্যাণকর) বস্তুর প্রতি উৎসাহিত করেন। যথা- এক. দুনিয়ার প্রেম থেকে বের করে তাকে তাকওয়া বা পরহেজগারির প্রতি উৎসাহিত করে। দুই. রিয়া থেকে মুক্ত করে ইখলাসের শিক্ষা দেয়। তিন. অহঙ্কার থেকে নিষ্কৃতি দিয়ে নম্রতার শিক্ষা দেয়। চার. অলসতা থেকে মুক্ত করে উপদেশ দেয়ার প্রতি উৎসাহিত করে। পাঁচ. অজ্ঞতা থেকে মুক্ত করে জ্ঞানের প্রতি উৎসাহিত করে।
প মত, এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে বাঁচার সর্বশেষ পন্থা হলো মহান আল্লাহর দরবারে রিয়ামুক্ত জীবনের জন্য দোয়া করা। আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া ভালো-মন্দ করা না করার কোনো ক্ষমতা কারো নেই।
রিয়া থেকে বাঁচার উপরোল্লিখিত বিষয়গুলো অব্যাহত রাখার সাথে দোয়াও চালু রাখতে হবে। নবী সা: নিজেও এভাবে দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! আমার অন্তরকে নেফাক থেকে, আমার আমলকে রিয়া থেকে, আমার জিহ্বাকে মিথ্যা থেকে এবং আমার চোখকে খিয়ানত থেকে পবিত্র রাখো। চোখের খিয়ানত ও অন্তরে গোপন অবস্থা সম্পর্কে তুমি অবিহিত’ (আবদুল কাদের জিলানি রহ:, গুনিয়াতুত তালেবিন, উর্দু, পৃষ্ঠা-৪৫৫)। লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট