বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৫:১৮ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম ::
নানা রঙের ফুলে রঙিন ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক কর্মসৃজন কর্মসূচি প্রকল্পে পাল্টে যাচ্ছে মেলান্দহের মাহমুদপুরের চিত্র জগন্নাথপুরে প্রতিপক্ষের হামলায় আহত একজন ওসমানীতে ভর্তি বরিশাল সদর ও বাখেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনের ভোট গ্রহন আজ আজ কেশবপুরে ৬ষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন ৩টি পদে ১৪ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দিতা করছেন হালদায় ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় মাছ রাষ্ট্রিয় মর্যাদায় সৈয়দ বিল্লাল হোসেনের দাফন সম্পন্ন নান্দাইলের কৃতিসন্তান কবি আবদুল হান্নানের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন শ্রীপুরে চেয়ারম্যান প্রার্থীর নির্বাচনী অফিস ভাংচুর যুবদল সভাপতি টুকুর মুক্তির দাবিতে তারাকান্দায় বিক্ষোভ মিছিল

আশরাফী বিনতে আকরাম
  • আপডেট সময় শুক্রবার, ২৬ আগস্ট, ২০২২

বাংলাদেশে বিহারি
আশরাফী বিনতে আকরাম
‘তেলের শিশি ভাঙল বলে
খুকির উপর রাগ করো
তোমরা যেসব বুড়ো খোকা
বাঙলা ভেঙ্গে ভাগ করো
তার বেলা?’
দেশভাগের বেদনায় ব্যথিত লেখক অন্নদাশঙ্কর লিখেছিলেন ওপরের কবিতাটি (শাহরিয়ার, ২০২১)। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানে ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ যখন ধর্ম ভিত্তিতে দুই দেশে বিভক্ত হয়ে যায়, তখন ভারতের অনেক এলাকায় জাতিগত দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে (মাইনরিটি রাইটস গ্রুপ ১৯৮২; রশীদ ও আকরাম, ২০০৩)। যেমন ১৯৪৭ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে ৩০ হাজার মুসলিম হত্যার মধ্য দিয়ে ইতিহাসে ‘গ্রেট বিহারি কিলিং’ হয় (বিজু, ২০১০)। জাতিগত সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার ফলে ধর্মীয় আবাসভূমি হিসেবে পাকিস্তান থেকে বহু হিন্দু ও শিখ ভারতে এবং ভারত থেকে মুসলমানরা পাকিস্তান চলে আসে। এ সময় ১০ লাখ, মতান্তরে ১৩ লাখ মুসলমান ভারতের বিহার, পশ্চিম বাংলা, আসাম, ওড়িশা, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, ত্রিপুরা, সিকিম থেকে পূর্ব পাকিস্তানে (বর্তমান বাংলাদেশ) চলে আসে (www.stalesspeopleinbangladesh, আবরার, ১৯৯৮)। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত অভিবাসনের এ ধারা অব্যাহত থাকে। ১৯৭১ সালে অবাঙালি জনগণের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ লাখ (আবরার, ১৯৯৮)। এত বিপুলসংখ্যক অবাঙালি জনগণের মধ্যে বিহার থেকে আগত মুসলিম অধিবাসীরা ছিল সংখ্যাধিক্য। বিহার অঞ্চল থেকে আসার কারণে তারা বিহারি নামে পরিচিতি পায় (আহমেদ, ২০০৪)।
১৯৪৭-এর আগেই ঔপনিবেশিক আমলে অনেক বিহারি আবাস বদল করে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস শুরু করে (রামরু, ২০০৭)। পরবর্তী সময়ে জাতিগত দাঙ্গার কারণে বিহারিরা ভাষাগত (উর্দু) মিল থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানে না গিয়ে, ভৌগোলিক নৈকট্য বিহারিদের পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে (প্রিতম, ২০১৬)। পাকিস্তানের গভর্নর অবিভক্ত পাকিস্তানে বিহারিদের ‘মুহাজের’ (পশ্চিম পাকিস্তানে বিহারিরা করাচিতে বাস করে) নাম দেন (আহমেদ, ২০২০)। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিহারিরা বিভিন্ন শহর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। শিল্প-কারখানার কর্মী, রেলকর্মী, মেকানিক, শ্রমিক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কেরানি ইত্যাদি পেশায় যুক্ত হয়। যারা শিক্ষিত ছিল তারা সরকারি চাকরিতে যোগদান করে (নাহার, ২০০০)। ১৯৬০ সালের মধ্যে তাদের অনেকেই এ দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি নিয়ে গৃহায়ন প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা নগরীর শহরতলিতে পুনর্বাসিত হয় (রশীদ এবং আকরাম, ২০০৩)। সে সময় তাদের সংখ্যা ছিল ৪,৫০,০০০ (ম-ল, ২০১৯)।
পূর্ব পাকিস্তানে অভিবাসিত বিহারি এই জনগোষ্ঠী শুরু থেকেই বাঙালিদের সঙ্গে একীভূত হতে পারেনি। ১৯৪৭-৭১ পর্যন্ত তারা নিজেদের একটি স্বতন্ত্র ভাষা-সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী হিসেবে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে (বিজু, ২০১০)। নিজেদের অস্তিত্বের সংকটের কথা (পাকিস্তানে বাঙালিরা যদি ক্ষমতা লাভ করে উর্দুভাষী হিসেবে সংখ্যালঘু হয়ে যাবে) চিন্তা করে ভাষাগত মিলের কারণে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও সম্পৃক্ততা বাড়াতে শুরু করে, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল (রশীদ এবং আকরাম, ২০০৩; সাউথ এশিয়া ফোরাম ফর রিফিউজি রাইটস, ২০০৪)। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন এবং ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে এ বিহারি জনগোষ্ঠী মুসলিম লীগকেই সমর্থন করে আসছিল(www.safhr.org)। বাঙালিবিরোধী এই মনোভাব থেকেই বিহারি জনগোষ্ঠী প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপক্ষে নিজেদের অবস্থান গড়ে তোলে। এদের মদদে সংঘটিত হয় একাধিক হত্যাকা- (রশীদ এবং আকরাম, ২০০৩)। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাঙালিদের মধ্যে গড়ে ওঠা বিহারি-বিরোধী মনোভাবের কারণে বিহারি জনগোষ্ঠীর একটি বিরাট অংশ তাদের ভূ-সম্পত্তি ও জীবিকা হারায়। উচ্ছেদ হয় নিজেদের আবাসস্থল থেকে (রামরু, ২০০৭)। অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে সেই সময় বিহারি পরিবারগুলো চাকরিস্থল, ঘরবাড়ি ছেড়ে একত্র হয় এবং পাকিস্তান যাওয়ার আশায় বেছে নেয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অবস্থিত আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সংস্থার ক্যাম্পগুলো (রশীদ এবং আকরাম, ২০০৩; রামরু ২০০৭; হাসান ২০০৩)। এভাবে এ বিহারি উর্দুভাষীদের ক্যাম্প জীবন শুরু হয়। এদের আখ্যায়িত করা হয় ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’ (হাসান, ২০০৩)। ১৯৭২ সালে ক্যাম্পগুলোতে এদের সংখ্যা ছিল ১,০৮,৬৮০ (বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়, ১৯৮২)।
বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে বিহারিদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্য রাষ্ট্রপতি আদেশ ১৪৯ ঘোষণা করে (বিজু, ২০১০)। যে আদেশে এই আটকে পড়া পাকিস্তানিদের কাছ থেকে সিদ্ধান্ত চাওয়া হয় তারা পাকিস্তান প্রত্যাবাসন করতে চায় নাকি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব চায়। বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে ছয় লাখ বিহারি এ প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ৫,৩৯,৬৬৯ জন পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, যারা আইসিআরসির (ইন্টারন্যাশনাল কমিটি ফর দ্য রেড ক্রস) মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনের জন্য আবেদন করে (রামরু, ২০০৭; বিজু, ২০১০)। কিন্তু তৎকালীন ইসলামাবাদ সরকার পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্স এবং পাকিস্তান আর্মির লোকদের ছাড়া অন্য বিহারিদের গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিল না। কারণ পাকিস্তান সরকার এদের ‘ইন্ডিয়ান রিফিউজি’ ভাবত (সোকলফ, ২০০৫)। পাকিস্তান সরকারের এহেন মনোভাব সত্ত্বেও এ জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই পাকিস্তান যাওয়ার পক্ষে ছিল (নাহার, ২০০০; ইসলাম, ২০০৩)। কেননা যুদ্ধকালীন তাদের একাংশের ভূমিকার জন্য সমগ্র বিহারি জনগোষ্ঠীর প্রতি বাঙালিরা ক্ষুব্ধ ছিল। তাই এ দেশে বসবাস করা তাদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে (হক, ২০০৩)। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার পাকিস্তান সরকারকে বিহারিসহ অবাঙালিদের প্রত্যাবাসনের জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকে। অবশেষে পাকিস্তান সরকার ১৯৭৩ সালের নয়াদিল্লি চুক্তি এবং ১৯৭৪ সালের ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে বিহারিদের গ্রহণ করতে সম্মত হয় (ইসলাম, ২০০৩; বিজু, ২০১০)। চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭৪ সালের জুন মাসে প্রথম আইসিআরসিতে আবেদন করা ৫,৩৯,৬৬৯ জন বিহারির মধ্যে ১,০৮,৭৫০ জন ইউএনএইচসিআরের (দ্য ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস) সহযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিত হয় (আবরার, ১৯৯৮)। পরবর্তী সময়ে ইউএনএইচসিআর ফান্ডের স্বল্পতার কারণে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া স্থগিত করে। ১৯৭৪ সালে মুজিব-ভুট্টো সামিটে বাংলাদেশ সরকার বিষয়টি উত্থাপন করলেও পাকিস্তান সরকার আগ্রহ দেখায় না (www.safhr.org)।
মুজিব-পরবর্তী সরকার ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে এ প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করতে। সেই সময় সরকার ইসলামী দেশগুলোর সহযোগিতা নেয়, যারা পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে এবং এ সমস্যা সমাধানে সাহায্য করার আশ্বাস দেয়। সেই সময় পাকিস্তানি রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক মানবিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিহারি সমস্যা সমাধানে ইচ্ছাও পোষণ করেন। ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় সফরকালে জিয়াউল হক বলেন, পর্যাপ্ত ফান্ডের ব্যবস্থা হলেই পাকিস্তান সরকার বিহারিদের পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসন করবে। এ মর্মে ১৯৮৮ সালে পাকিস্তান, রাবিতা আল-আলম আল-ইসলামির (ইসলামিক চ্যারিটি অর্গানাইজেশন, মক্কা) সাথে একটি চুক্তি করে বিহারি প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে (বিজু, ২০১০; রামরু, ২০০৭; চৌধুরী, ২০২১)। কিন্তু ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। বেনজির ভুট্টো এ বিহারি প্রত্যাবাসনের ঘোর বিরোধিতা করেন। তিনি পাকিস্তান পিপলস পার্টির রাজনীতি এবং তার বাবার রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন। তিনি স্পষ্টত ঘোষণা দেন, ‘বাংলাদেশে আটকে পড়া বিহারিরা পাকিস্তানি নন, এরা বিহারি’ (রহমান, ২০০৩)। এমনকি, ১৯৭৭ সালে যে ১ লাখ বিহারি পাকিস্তানে প্রবেশ করেছে তারা অবৈধ এবং যারা বাংলাদেশে রয়েছে তাদেরও নাগরিকত্ব দেবেন না বলে ভুট্টো-কন্যা জানিয়ে দেন। বরং ১৯৮৯ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন তখন তিনি বিবৃতি দেন যে বাংলাদেশ সরকারের উচিত বিহারিদের স্থায়ী করা এবং উল্টো তিনি বাংলাদেশ সরকারকে ইসলামিক দেশগুলো থেকে ফান্ড উত্তোলনে সহযোগিতা করবেন বলে আশ্বাস দেন (বিজু, ২০১০)। এরপর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজ শরিফ ক্ষমতায় এলে তিনি বিহারিদের ফিরিয়ে নেয়ার বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ নেন। তিনি পাঞ্জাবে বিহারিদের জন্য পুনর্বাসন এবং গৃহ হস্তান্তরের জন্য আইডি কার্ড প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৯৩ সালের ১০ জুন ২৩৫ জন বিহারিকে ফিরিয়ে নেয়া হয়। বস্তুত, নওয়াজ-পরবর্তী সব সরকারই বিহারিদের ব্যাপারে উদাসীন ছিল মূলত রাজনৈতিক কারণে (সোকলফ, ২০০৫)। ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির সমাপ্তির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১,৭০,০০০ বিহারি সর্বশেষ পাকিস্তানে প্রত্যাবাসিত হয় (হেফেরম্যান, ২০০২)। বস্তুত বিহারিদের নাগরিকত্বের সমস্যার প্রকৃতি ছিল অন্য রকম। কেননা বাংলাদেশ সরকার তাদের বহিরাগত বিবেচনা করে মনে করত তাদের পাকিস্তান যাওয়া উচিত। অন্যদিকে পাকিস্তানে তাদের কখনো বসতি ছিল না। তারা অনেকটা রিফিউজিদের মতোই বিহার থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করে। তাই পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন সময় তাদের অভ্যন্তরীণ জাতিগত দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ভয়ে বিহারিদের গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায় এবং ১৯৯৯ সালে পুনর্ব্যক্ত করে যে বিহারিরা বাংলাদেশের নাগরিক। ততদিনে বিহারিদের নতুন প্রজন্মও বাংলাদেশের মাটিতেও জন্মগ্রহণ করেছে (ইউএস কমিটি ফর রিফিউজিস, ২০০৩)। রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও বিহারিদের নিজস্ব সংগঠনের ভূমিকাও আশাব্যঞ্জক ছিল না। ১৯৭৮-৭৯ সালে এসপিজিআরসি (স্ট্যান্ডার্ড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপ্যাট্রিয়েশন কমিটি) নামক একটি সংগঠন গঠিত হয় এবং এ সংগঠনের নেতা হিসেবে নাসিম খান আন্দোলন শুরু করেন (হাসান, ২০০৩)। ১৯৮১ সালে সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আইসিভিএ (ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব ভলান্টারি এজেন্সিজ) সম্মেলনে এসপিজিআরসি, ইউএনএইচসিআরের কাছে আবেদন করে তাদের যেন ‘রিফিউজি’ মর্যাদা দেয়া হোক। ইউএনএইচসিআর তাদের রিফিউজির মর্যাদা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কেননা ইউএনএইচসিআরের রিফিউজির সংজ্ঞা অনুসারে বিহারিরা সেই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় না। বরং তারা ‘আটকে পড়া পাকিস্তানি’, যাদের স্থানচ্যুতি হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট সরকার এ সমস্যার সমাধান করবে। আইএলও, আইসিআরসি, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ এ সম্মেলনে অংশগ্রহণ করলেও পরবর্তী সময়ে ২০০৮ সালের আগ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রবিহীন গোষ্ঠী’ হিসেবে ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছিল (খান, ২০০৪)।
২০০৩ সালের মে মাসে বাংলাদেশ সরকার হাইকোর্টের নির্দেশ অনুসারে দশজন বিহারিকে আবেদনের প্রেক্ষাপটে প্রথম নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার প্রদান করে (ওয়ালিউর, ২০০৩)। ২০০৮-এর ১৯ মে, ঢাকা হাইকোর্ট ১,৫০,০০০ শরণার্থী যারা ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় ছিল, তাদের নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার অনুমোদন করে (ফাহমিদা, ২০০৮; ঢাকা রয়টার্স ২০১৭)। একই সঙ্গে যারা যুদ্ধের পর জন্ম নিয়েছিল তারাও নাগরিকত্ব ও ভোটের অধিকার অর্জন করে (আলী, ২০০৮)। বাংলাদেশ সরকার বিহারিদের পুনর্বাসনের জন্য সারা দেশে ৩৩৯৮৬.১৮৩ একর জমি ক্রয় করেছে (দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০১৪)। নাগরিকত্ব দেয়ার ঘোষণার পর ২০১৬ সালে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগ মন্ত্রণালয় একটি তালিকা তৈরি করে। তখন বলা হয়েছিল, ঢাকার মোহাম্মদপুরেই ১৪ হাজার ২১২টি পরিবার রয়েছে। যেখানে বসবাস করে ১ লাখ ৮ হাজার ১৯ জন। দুর্যোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ তালিকার ভিত্তিতে পরিবারপ্রতি ৩ শতাংশ হারে পুনর্বাসনের জন্য ৫২৬ একর জমি বরাদ্দের কথা বলা হয়। কিন্তু ‘পরিকল্পনার মধ্যেই’ আটকে যায় সে উদ্যোগ (চৌধুরী, ২০২১)। ১৯৯৩ সালে রাবেতা আলমে আল ইসলামী, পাকিস্তান দূতাবাস এবং এসপিজিআরসি মিলে যে জরিপকাজ চালায় তাতে বাংলাদেশের ১৬টি জেলায় (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, যশোর, দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, পাবনা, খুলনা, জামালপুর , ঠাকুরগাঁও ও নীলফামারী) ৭০টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। বিবিসি বাংলা অনুসারে সারা দেশে এ ক্যাম্পের সংখ্যা ১১৬টি (আক্তার, ২০১৭)। এসপিজিআরসির তথ্যানুযায়ী, এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছে ৪৫টি। জেনেভা ক্যাম্প সেগুলোর মধ্যে তুলনামূলক বড়। তবে সারা দেশে কতটি ক্যাম্প রয়েছে, ক্যাম্পগুলোতে শুরুতে কতজন ‘বিহারি’ আশ্রয় নেয়, পরবর্তী সময়ে কতজনকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছে এবং বর্তমানে কতজন বাসিন্দা রয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছে (হোসাইন, ২০২১)। বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম (২০১৯) এর এক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে আটকে পড়া উর্দুভাষী পাকিস্তানিদের সংখ্যা পাঁচ লাখের বেশি। এদের মধ্যে তিন লাখ এখনো শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করে। কেউ কেউ এ সংখ্যা ছয় লাখের মতো বলে মতামত প্রকাশ করেছে (আক্তার, বিবিসি বাংলা, ২০১৭)। ঢাকা ও উত্তরাঞ্চলের সৈয়দপুরে এ জনগোষ্ঠীর বাস সবচেয়ে বেশি (রামরু, ২০০৭; পারভীন, বিবিসি বাংলা, ২০১৭)। বর্তমান লেখাটি প্রস্তুত করার জন্য লেখক তার দল নিয়ে উত্তরবঙ্গের সৈয়দপুরে গিয়েছিলেন বিহারিদের বর্তমান জীবন স্বচক্ষে দেখার জন্য। বর্তমান লেখাটি প্রস্তুত করতে লেখক মাঠ পর্যায়ে বিহারিদের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন সৈয়দপুরে ২২টি বিহারি ক্যাম্প রয়েছে। তাদের উর্দু ভাষাভাষী বলা হলেও তারা মূলত উর্দু-হিন্দির সঙ্গে আঞ্চলিকতার মিশেলে কথা বলেন (লেখক, ২০২২)। বিহারি সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের সঙ্গে বাংলায় কথা বললেও নিজেদের মধ্যে তারা উর্দু-হিন্দি মিশেলে কথা বলছিলেন। প্রতিষ্ঠিত মতামত অনুযায়ী, বিহারিরা শিয়া মতাদর্শের। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে, বিহারিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় তাদের সবাই সুন্নি মতাদর্শের। তাদের মতে, ‘আমাদের মধ্যে ১ শতাংশ জনগোষ্ঠীও শিয়া নয়’ (লেখক, ২০২২)। মহররম তারা শিয়াদের মতো করে পালন করলেও তারা নিজেদের শিয়া বলতে রাজি নয়। কিন্তু স্থানীয় মুসলিমদের সঙ্গে তাদের মাজহাবগত পার্থক্য আছে। স্থানীয় মুসলিমরা হানাফি মাজহাবি হলেও বিহারিরা কাদিয়ানি মতাবলম্বের। তারা বলেন, তারা শরিয়তের অনুষ্ঠান পালন করে থাকেন, যেমন ঈদ, রোজা, মহররম, ঈদে মিলাদুন্নবী। ঈদে মিলাদুন্নবী তাদের বিশেষভাবে ধর্মীয় উৎসব। প্রত্যেক মহররমে তারা ইমামবাড়া স্থাপন করেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে মহররম পালন করেন। সৈয়দপুর রেলওয়ে মেস ক্যাম্পে ঢুকতেই একটি বিশাল ইমামবাড়া দেখতে পাই আমরা।
এছাড়া উর্দু গজল, কাওয়ালি গানও বিহারি সংস্কৃতির একটি অংশ। বিহারিরা সাধারণ বাঙালিদের মতোই খাবার গ্রহণ করে। বিরিয়ানি, রুটি, চাপ, কাবাব তাদের প্রিয় খাবার। তারা এসব রান্নায় বেশ পারদর্শী। বিশেষ করে ঢাকার জেনেভা ক্যাম্পের বোবার বিরিয়ানি সারা দেশে বিখ্যাত।
সব ক্যাম্পেই যে সমস্যা প্রকট তা হলো আবাসন সংকট। সরকারি জমির ওপর ক্যাম্পগুলো তৈরি বলে উচ্ছেদের আতঙ্কে থাকে বিহারিরা। তবে এ আতঙ্ক সব ইনফরমাল সেটলমেন্টের জন্যই প্রযোজ্য। তাই এ চিত্র শুধু সৈয়দপুরে নয়, দেশের অন্য ক্যাম্পগুলোরও প্রধান সমস্যা। ক্যাম্পের মাত্র প্রায় ১৯-২০ ফুট একটি ছোট কক্ষে পুরো পরিবারের ৮-৯ জন সদস্য বাস করেন। একই কক্ষে শ্বশুর-শাশুড়ি, ছেলে, বৌমা, ভাই বোন, সন্তানাদি নিয়ে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করেন এবং যা লজ্জাজনকও বটে। কেননা যে ছিল একসময় শিশু, আজ সে প্রাপ্তবয়স্ক যুবক। সে বিবাহিত, তার নিজের পরিবার আছে কিন্তু তাদের থাকার জন্য আলাদা কোনো ঘর নেই। ফলে একই ঘরে খাটের ওপরে ছেলে-ছেলের বউ থাকছে, নিচে থাকছে মা। আবার বিবাহিত মেয়েরা বিয়ের পর রুমের অভাবে জামাই নিয়ে বাপের বাড়িতে একদিনের জন্যও থাকতে পারে না। ক্যাম্পগুলোতে প্রতিটি পরিবারেই একসঙ্গে দুই-তিন প্রজন্ম থাকছে। তাই পরিবারগুলোকে বলা যায় বর্ধিত বা যৌথ পরিবার। কিন্তু একান্ত নিরুপায় হয়ে অনেক পরিবারের এক প্রজন্ম ক্যাম্পের বাইরে চলে যাচ্ছে। গড়ে তুলতে বাধ্য হচ্ছে একক পরিবার।
বিহারি ক্যাম্পের কক্ষগুলো পুরনো হয়ে যাওয়ায় দেয়াল খসে পড়ছে, বৃষ্টির পানি কক্ষে ঢোকে, মেঝেগুলো স্যাঁতসেঁতে এবং কক্ষের পাশে ময়লা-আবর্জনা ও মশার উপদ্রব। বাংলাদেশের কোনো ক্যাম্পে কোনো বিহারিকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয় না। তাদের ভাষ্যমতে, মক্কাভিত্তিক ট্রাস্ট রাবেতা ফাউন্ডেশন তাদের বিদ্যুৎ বিল বহন করে।
ক্যাম্পগুলোর ভেতরের রাস্তা অত্যন্ত সংকীর্ণ। পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা দুর্বল। সৈয়দপুরের রেলওয়ে মেস ক্যাম্পে গিয়ে লেখক দেখেন, ৪০টি পরিবারের জন্য মাত্র তিনটি নলকূপ এবং চারটি বাথরুম ও টয়লেটের ব্যবস্থা। ক্যাম্পবাসী নাহিদ (৩৫) জানান, মাত্র কয়েক মাস আগে এনজিও ব্র্যাক তাদের চারটি বাথরুম স্থাপন করে দেয়, না হলে আগে আরো করুণ অবস্থা ছিল তাদের। বাথরুম হওয়ার আগে কিশোরী, নারীদের মাসিক ব্যবস্থাপনাও যেন সবার সামনে উন্মুক্ত ছিল। ক্যাম্পবাসী আর্থিকভাবে অসচ্ছল। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা খুব বেশি না থাকায় তারা ভালো চাকরিও পায় না। বিহারিদের মধ্যে বেশির ভাগ বর্তমানে ভ্যান চালায়, রিকশা চালায়, অস্থায়ী খাবারের দোকান চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেক বিহারি ক্যাম্পে মহিলারা হাতের সেলাই বা কারচুপি-জারদৌসির কাজ করে পরিবারকে সাহায্য করে। তবে অর্থের অভাবে তারা তাদের সন্তানদের খুব বেশি দূর পড়াতে পারে না। ভারত-পাকিস্তান ভাগের পেরিয়ে গেছে প্রায় ৭৫ বছর। প্রত্যাবাসিত বিহারিরা বেশির ভাগই মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু মৃত্যুর আগ পর্যন্ত প্রবীণদের মাঝে পাকিস্তানে ফেরার একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল। প্রায় পাঁচ-ছয় প্রজন্ম পর বর্তমান প্রজন্ম আর কখনোই ফিরতে চায় না পাকিস্তানে। বরং তারা স্বাভাবিক বাঙালি হিসেবেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৬ মার্চ, ২০২২ ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিহারিদের সম্পর্কে বলেন, পাকিস্তান কোনোদিন বিহারিদের গ্রহণ করেনি।… তারা (বিহারি) খুব কর্মঠ, বিভিন্ন কাজ তারা খুব দক্ষতার সঙ্গে করে। প্রধানমন্ত্রী তাদের ভাল বাসস্থান এবং দক্ষতার ভিত্তিতে কর্মসংস্থানের বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেন। (দ্য ডেইলি স্টার, ২০২২)।
মিরপুরের বিহারিরা গয়না ও রেশম শাড়ি, চট্টগ্রামের বিহারিরা কারচুপি-জারদৌসিতে নিজেদের দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছেন। যেহেতু বিহারিরা বর্তমানে বাংলাদেশে স্থায়ী, তাই সরকারের উচিত তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করে দক্ষতা অনুযায়ী মানবসম্পদে পরিণত করা।
তথ্যসূত্র: ১। রশীদ, এস. আর. এবং আকরাম, এম. এস. (সম্পাদিত). (২০০৩). ক্যাম্পের বিহারী জনগোষ্ঠী: নতুন প্রজন্মের ভাবনা. ঢাকা, সমন্বয়কারী: রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিট
২।  Biju, M.R.(Ed.). (2010). Development Issues in Contemporary India. New Delhi: Concept Publishing Company PVT.LTD.
লেখক: আশরাফী বিনতে আকরাম: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় asrafiakram.soc@gmail.com




শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর









© All rights reserved © 2020 khoborpatrabd.com
Theme Developed BY ThemesBazar.Com