বিজিবি সদর দপ্তর প্রতি মাসে একটি বুলেটিন প্রকাশ করে। সেখানে বাহিনীর নানা অর্জন, কার্যক্রম ও বাহিনীর সদস্যদের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করা হয়। ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত প্রকাশিত তথ্য সন্নিবেশ করে দেখা গিয়েছে, এ সময়ের মধ্যে কর্তব্যরত অবস্থায় ৫১ বিজিবি সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩৮ জন হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, লিভার সিরোসিস, ক্যান্সার, নিউমোনিয়া ও কিডনিজনিত বিভিন্ন ধরনের দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছেন। বাকি ১৩ জনের মধ্যে একজন আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদের মৃত্যু হয়েছে জ্বর, সর্দি-কাশি, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত আঘাতের কারণে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সিলেট ব্যাটালিয়নে নায়েক (সিগন্যাল) হিসেবে কর্মরত অবস্থায় গত বছরের ২১ জুন মারা যান মো. রেজাউল করিম। মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে চিকিৎসকরা দেখতে পান, বিজিবির এ সদস্য দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগে আক্রান্ত ছিলেন। মৃত্যুর সময় তার শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতার পাশাপাশি ছিল তরলের তীব্র ঘাটতি। দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপেও ভুগছিলেন তিনি। সব মিলিয়ে বেশ জটিল শারীরিক অবস্থায় মৃত্যু হয় তার।
বিজিবি সদর দপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে কর্তব্যরত অবস্থায় মারা যাওয়া বাহিনীটির সদস্যদের ৯০ শতাংশই দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন এবং খাদ্যাভ্যাসের কারণে কিডনি জটিলতা, হৃদরোগ, লিভার ও ফুসফুসে সংক্রমণ এমনকি ক্যান্সারের মতো দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বিজিবি সদস্যরা। যদিও নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, জীবনযাপনে পরিবর্তন এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।
সুশৃঙ্খল এ আধাসামরিক বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের সীমান্ত সুরক্ষা, চোরাচালান প্রতিরোধ, নারী ও শিশু এবং মাদক চোরাচালান প্রতিরোধে সীমান্তে অতন্দ্রপ্রহরীর দায়িত্ব পালন করেন। সীমান্তের অধিকাংশ ক্যাম্প নো ম্যানস ল্যান্ডসংলগ্ন হওয়ায় সেখানে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পাওয়া বেশ কঠিন। কুড়িগ্রাম ব্যাটালিয়নের হয়ে এমনই একটি সীমান্তবর্তী ক্যাম্পে কর্তব্যরত ছিলেন সিপাহি আবু সাঈদ। গত বছরের ১৬ অক্টোবর মারা যান তিনি। পরে জানা যায়, আবু সাঈদ হূদরোগে আক্রান্ত ছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে এ রোগে আক্রান্ত থাকায় একপর্যায়ে তিনি ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পরে দ্রুত সময়ের মধ্যে তার ফুসফুস ও লিভারেও জটিলতা তৈরি হয়। ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সার হলো এমন এক ধরনের ক্যান্সার, যা নাকের পেছনের অংশকে মুখের পেছনের অংশে সংযুক্ত করে। অঞ্চলটি ন্যাসোফ্যারিনক্স নামে পরিচিত। এটি মাথার খুলির গোড়ায়, মুখের ছাদের ঠিক ওপরে অবস্থিত। যখন কেউ বাতাসে শ্বাস নেয়, তখন সেই বাতাস ফুসফুসে পৌঁছার আগে নাক, ন্যাসোফ্যারিনক্স ও গলায় প্রবেশ করে। ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল এলাকার কোষগুলো নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে বাড়তে শুরু করলে ন্যাসোফ্যারিঞ্জিয়াল ক্যান্সারের সৃষ্টি হয়। তবে নিয়মিত রেডিয়েশন থেরাপির মতো চিকিৎসার মাধ্যমে এ ক্যান্সার নিরাময় করা সম্ভব বলে জানান চিকিৎসকরা। প্রায় একইভাবে প্রথমে হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে পরে মাল্টি অর্গান ডিজঅর্ডার সিনড্রোমে আক্রান্ত হন নায়েক মো. রাসেল মিয়া। এরপর তিনি কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। পর্যায়ক্রমে তার শরীরে আরো বেশকিছু দীর্ঘমেয়াদি জটিলতা তৈরি হলে মারা যান বর্ডার সিকিউরিটি ব্যুরোতে (বিএসবি) কর্মরত এ বিজিবি সদস্য। বিজিবির মারিশ্যা ব্যাটালিয়নে কর্তব্যরত অবস্থায় গত বছরের ৫ আগস্ট মারা যান সিপাহি গৌতম। তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। চিকিৎসকরা বলছেন, নিউমোনিয়ার কারণে তার ফুসফুস মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাশাপাশি সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ায়ও আক্রান্ত হয়ে পড়েন তিনি। পরবর্তী সময়ে মাল্টিপল অর্গান ডিজফাংশনাল হয়ে মৃত্যু হয় তার। সীমান্তের অপরাধ দমনের পাশাপাশি পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করতে হয় বিজিবি সদস্যদের। দুর্গম পাহাড়ি এলাকাগুলোতেও তাৎক্ষণিক ওষুধসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম মেলা দায়। একাধিক পাহাড় পাড়ি দিয়ে জেলা শহরে গিয়ে প্রয়োজনীয় ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করতে হয়। খাগড়াছড়ি ব্যাটালিয়নের হয়ে এমনই একটি দুর্গম ক্যাম্পে কর্তব্যরত ছিলেন হাবিলদার মো. বেলায়েত হোসেন। গত বছরের ২ মে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পর দেখা যায়, বেলায়েত হোসেন দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগে ভুগছিলেন। তার বাম পাশের কিডনিতে কোষ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়ে দুই কিডনির মধ্যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি করেছিল।
স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানবদেহে প্রায় সব রোগ অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার ও খাদ্যাভ্যাসের সঙ্গে জড়িত। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ও অসংক্রামক রোগগুলোর বেশির ভাগই প্রতিরোধযোগ্য। স্রেফ অসচেতনতার কারণে এসব রোগ বৃদ্ধি পেয়ে মৃত্যুর কারণ হয়। বিজিবি সদস্যদের জটিল শারীরিক সমস্যার জন্য প্রভাবক রোগগুলো শনাক্ত হলে সহজেই এগুলো থেকে নিরাময় পাওয়া যেত।
আমাদের দেশে রোগ নিরাময়ের চেয়ে তা প্রতিরোধে তুলনামূলক কম গুরুত্ব দেয়া হয় বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, বিজিবির যেসব সদস্য দীর্ঘমেয়াদি ও জটিল রোগে মারা গিয়েছেন, তাদের হয়তো নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়নি। বছরে দুবার না হলেও অন্তত একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা জরুরি। এতে প্রাথমিক পর্যায়েই রোগ শনাক্ত ও প্রতিরোধ করা সম্ভব। হূদরোগ, কিডনি জটিলতা, লিভার, স্ট্রোক, ক্যান্সার থেকে শুরু করে বিভিন্ন জটিল রোগে এসব সদস্য মারা গিয়েছেন। তাদের প্রায় সবার মধ্যেই উচ্চরক্তচাপ ও ডায়াবেটিস মেলিটাস রয়েছে। অথচ আক্রান্তদের অনেকেই তা জানতেন না। এ রোগ দুটি মারাত্মক স্বাস্থ্য জটিলতা তৈরি করে। ডায়াবেটিস শনাক্ত হলে নিয়ন্ত্রণ ছাড়া উপায় নেই। উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিসকে প্রভাবিত করে আবার ডায়াবেটিসও উচ্চরক্তচাপকে প্রভাবিত করে। এসব রোগ অন্যান্য রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে, যা দেখা গিয়েছে বিজিবি সদস্যদের ক্ষেত্রে। অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সালের মতে, বিজিবির সদস্যদের খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচার রোগগুলোকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। দেশের বেশির ভাগ মানুষের খাদ্যগ্রহণের সময় বিজ্ঞানসম্মত নয়। যেভাবে, যখন, যে খাবার খেতে হয় তা খাওয়া হচ্ছে না। আবার শরীরে কোনো রোগ থাকলে জীবনাচার যেন রোগের সহায়ক না হয় তার জন্য সচেতন হতে হয়। তবে এমন সচেতনতা বেশির ভাগ মানুষের মধ্যে নেই।
দুর্গম ও সীমান্ত এলাকার ক্যাম্প ও বিওপিতে দায়িত্ব পালন করা বিজিবি সদস্যদের স্বাস্থ্যসেবায় নেয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে বিজিবি সদর দপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, দুর্গম এলাকায় প্রতিটি ইউনিটে মেডিকেল অফিসার রয়েছেন। তারা নিয়মিত সীমান্তে অবস্থিত ক্যাম্প ও বিওপিগুলো পরিদর্শন করেন এবং বিজিবি সদস্যদের স্বাস্থ্যসংক্রান্ত বিষয় তদারক করেন। বিজিবি সদস্যদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষাও করা হয়। সীমান্তবর্তী প্রতিটি ক্যাম্প বা বিওপিতে মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে ফার্স্ট এইড কোয়ালিফায়েড বিজিবি সদস্য দায়িত্ব পালন করে থাকেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে তারা মেডিকেল অফিসারের সঙ্গে যোগাযোগ করে বিজিবি সদস্যদের চিকিৎসা দেন। এছাড়া প্রত্যেক বিজিবি সদস্যকে প্রতি মাসে একবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হয়। দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে এরই মধ্যে হেলথ কার্ড কার্যক্রম চালু করা হয়েছে জানিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, বাহিনীর সদস্যদের চিকিৎসার জন্য ঢাকা, গুইমারা, চুয়াডাঙ্গা, সাতকানিয়া ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিজিবির নিজস্ব হাসপাতাল রয়েছে। শ্রীমঙ্গলে আরো একটি ৫০ শয্যাবিশিষ্ট বিজিবি হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ নিয়ন্ত্রণে মহাপরিচালকের নির্দেশে বিজিবি সদস্যদের স্বাস্থ্যসচেতন করার লক্ষ্যে ২০১৬ সাল থেকে ৩৫ বছরের বেশি বয়সী সদস্যদের জন্য হেলথ কার্ড প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে সংশ্লিষ্ট সদস্যের উচ্চতা, ওজন, রক্তচাপ, রক্তে শর্করা ও চর্বির মাত্রা, ইসিজি ও মূত্র পরীক্ষার ফলাফল সন্নিবেশিত থাকে। তাছাড়া মাসিক স্যানিটারি পরিদর্শনে স্বাস্থ্য পরীক্ষার সময় মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে প্রত্যেক সদস্যের হেলথ কার্ড হালনাগাদ আছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া মেডিকেল অফিসারের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিজিবি সদস্যদের নিয়মিত প্রেষণাও দেয়া হয়। সূত্র: বণিক বার্তা